পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোটুকু
আমার ঘরের জানলা দিয়ে খাটের ওপর এসে পড়ে। সময়টা শীতের শেষ, তাই মিঠে রোদের
আমেজটুকু নিতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু মানুষের একাকিত্ব, সে তাকে ছাড়েনা কোথাও।
তাই মনে পড়ে যায় তাদের কথা, যাদের একসময় ভালোবেসেছিলাম। বলা, না-বলা কত কথা। যা যা
বলতে পারিনি, সব। যা চেয়েও দিতে পারিনি, তাও। বিশেষ করে সেই দুটি উপহার, যা অনেক
চেয়েও দিয়ে উঠতে পারিনি দুজনকে। আজ সেই কথাই বলব।
একটি লাল গোলাপ।
শ্রীজিতার দিকে তাকালে প্রথমেই যা মনে পড়ে। টুকটুকে একটি লাল গোলাপ যেন ফুটে আছে। লেক
মার্কেটের পাশ দিয়ে রোজ আমাদের একসাথে ফেরা। রাসবিহারি অব্দি এসে ও নেবে অটো, আর
আমি বাঁ দিকে সোজা হাঁটা লাগাব নিজের বাড়ির দিকে। তা রোজ এই লেক মার্কেটের পাশ
দিয়ে আসার সময়েই ফুলের দোকানগুলোর দিকে নজর পড়ে। এক একটা গোলাপ কি সুন্দর।
শ্রীজিতাকে দিতে খুব ইচ্ছে করে। একদিন বাড়ি থেকে ঠিক করে গেলাম, আজ ফেরার পথে
গোলাপ কিনব। এবং ওকে দেব। শ্রীজিতা কি বলবে? হাসবে? ফিরিয়ে দেবে? হাসলে ওকে খুব
মিষ্টি লাগে। মনে হয় পৃথিবীর যত ভালোবাসা আছে, ওকে দিয়ে দি। মনে পড়ল একদিন ও
বলেছিল, হোষ্টেলের ছেলেরা খুব রাফ অ্যান্ড টাফ হয়। অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। পরে মনে
মনে বলেছি, শুধু বাইরেটাই দেখলি... ভেতরে উঁকি দিয়ে একবার মনটা তো দেখলি না? এই মন
ভালোবাসা চায়। দিতে চায়। নিতে চায়। পাশে থাকতে চায়। একবার সুযোগ দিয়ে দেখ।
সেদিন ফেরার পথে আমি
একা। শ্রীজিতার খোঁজ নেই। একাই চলেছি। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক। শ্রীজিতা এসেছে। এবং
সঙ্গে আরো কেউ একজন। খানিকটা চেনা, খানিকটা অচেনা। আমি আমার উপহারের স্বপ্নে
মশগুল। শ্রীজিতা এবং ছেলেটি তাদের সদ্য জমে ওঠা বন্ধুত্বে। অন্ধকার শহরের বুক চিরে
তিনটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে চলে। দুটি একসাথে। একটি একটু তফাতে। কিছুক্ষণ পরে আমার হুঁশ
ফেরে। এ জিনিস আলাদা। শ্রীজিতার চোখ এত চকচক করছে! এ জিনিস তো আমার সাথে থাকলে হয়
না। ছেলেটি হাত পা নেড়ে কিছু বোঝাচ্ছে। শ্রীজিতা শুনছে। বলছে। হাসছে। এদিকে আমার
লেক মার্কেটের দোকান এগিয়ে আসছে। ওরা দেখলাম থেমে গেছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে
পড়েছি। ওরা খেয়াল করেনি। আমিও না।
‘কিরে, পিছিয়ে পড়ছিস
যে?’ শ্রীজিতার প্রশ্ন।
শরীরে কেমন একটা
তরঙ্গ খেলে গেল। পিছিয়ে পড়ছি! চোখ দুটো চলে গেল পায়ের কাছে। একটা ইউক্যালিপটাসের
পাতা। এ জিনিস এখানকার নয়। হরিদ্বারে গেছিলাম যখন, অনেক ইউক্যালিপটাসের গাছ
দেখেছিলাম। দেরাদুনেও তাই। মাথা উঁচু করে দেখলাম, হ্যাঁ, এটা ওই গাছই বটে। হয়তো
কেউ কোনওদিন লাগিয়েছিল, আজ থেকে বহু বছর আগে।
তুলে নিলাম পাতাটা
মাটি থেকে। শ্রীজিতা আর ছেলেটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। নিজেকে কিরকম একটা
শান্ত লাগছে। সৌম্য নামটা মা আমাকে এমনি এমনি দেয়নি। কিছু কিছু পরিস্থিতিতে অদ্ভুত
রকমের শান্ত হয়ে যাই। পাতাটা তুলে এনে, মাঝখানটা ছিঁড়ে নাকের কাছে আনতেই সেই
সুগন্ধ ভেসে এল। আহ, সেই হরিদ্বার আর দেরাদুনের কথা মনে পড়ছে। হেসে শ্রীজিতাকে
বললাম, ‘ইউক্যালিপটাসের গাছ। অসাধারন গন্ধ। তাই দেখছিলাম।’
এবারে কথা একটু কমল।
আস্তে আস্তে লেক মার্কেটের সব ফুলের দোকানগুলো আমার পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেল। আমার
সাধের গোলাপ আর কেনা হলনা। কেউ একজন আমাকে পেছন থেকে টেনে যেন বলল, ‘সৌম্য, এ
গোলাপ শ্রীজিতার জন্য নয়।’ অবাক হলাম। কারন সে গলা আমার নিজের।
সেইদিন নতুন
বন্ধুত্বর সাথে শ্রীজিতা আরেকটা জিনিসও পেল। দূরত্ব। অনেক দূরে চলে গেলাম আমি। শ্রীজিতার
চোখে ভালোবাসা দেখেছিলাম, অন্য একজনের জন্য। তাই বুঝেছিলাম, আমি একাই ভালো। এই দূরত্ব হয়তো
শ্রীজিতাকেও শান্তি দেবে। তারপর একদিন, অনেক দিন পরে, টের পেলাম সেই মোহ কেটে
গেছে। ছেলেটি চলে গেছে, শ্রীজিতাকে উজাড় করে নিয়ে। কেউই রইল না। শ্রীজিতাও চলে
গেল। পড়ে রইল আমার না দেওয়া একটি উপহার মাত্র। একটি লাল গোলাপ। টুকটুকে লাল,
একখানা গোলাপ। আমার রক্তাক্ত হৃদয়ের চিহ্নস্বরুপ।
এর পর বহুদিন কেটে
গেল। ভেবেছিলাম, আর কাউকে ভালোবাসব না। এ শুধু ব্যাথা ছাড়া আর কিছুই দেয়না। কিন্তু
কিভাবে যেন, হঠাৎ একদিন, একজন বন্ধু পেয়ে গেলাম। দেবলীনা। আমার মনের কথা, যত
দুঃখের কথা, সব বলে ফেললাম একদিন। সেও কিছু কিছু বলল। মনে হল, একজন বন্ধু পেলাম। দেখা
হল। কথা হল। সে আমাকে গান গেয়ে শোনালো। আরো কথা। আরো হাসি। আবার দেখা।
ভালোবেসে ফেললাম। আর
তারপরেই এল আঘাত। সে তার মন দিয়ে ফেলেছে। অন্য একজনকে, অনেক দিন আগে। আমারই এক
বন্ধুকে। বুঝে ফেললাম, এবার এই গল্পে ইতি টানার পালা। নিজের ভালোবাসাকে ছুরি দিয়ে
পিষে ফেলে ছলছুতো করে ঝামেলা বাধালাম। চলে গেল দেবলীনা। মনে শান্তি পেলাম। ভাবলাম,
এই ভালো। আমাকে ঘৃণা করবে, কিন্তু নিজের ভালোবাসার পথে বাধা পাবেনা।
তারপর অনেক দিন কেটে
গেল। দেবলীনা বুঝে ফেলল হঠাৎ যে আমি তাকে ইচ্ছে করে সরিয়ে দিয়েছি। ফিরে এল। কিন্তু
আমি মন শক্ত করে বসে রইলাম। ত্রিকোণ প্রেম আর হতে দিচ্ছিনা। নিজের ভালোবাসাকে
পারলে দশবার কচুকাটা করব। ফিরে এসে আগের মতোন কথা বলতে চাইল। আমি পাত্তা দিলাম না।
ভাবুক আমাকে যা ভাবতে চায়। কিছুদিন পর আবার কথা বলল। কিন্তু এবার আর থাকতে পারলাম না।
মনে হল যেন ও হারিয়েছে যাকে চাইত তাকে। আমার পাথরের মতোন প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে গেল।
দেবলীনা একা। কিভাবে? কেন? কোনও উত্তর নেই।
বড়দিন এগিয়ে এল। মনে
পড়ল এই সময়ে আগের বছর আমাদের দেখা হওয়ার কথা। চব্বিশে ডিসেম্বরের বিকেলে বেরিয়ে
পড়লাম বাড়ি থেকে। দেবলীনার জন্য কিনে ফেললাম একটা ওয়াল হ্যাঙ্গিং। ভাবলাম, দেখা
হলে সারপ্রাইজ দেবো। গোলপার্কের মোড় থেকে অটো না পেয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। দেবলীনা
এটা পেয়ে কি বলবে? হাসবে? নাকি ফিরিয়ে দেবে? নাকি বলবে, ‘তুমি জানলে কি করে আমার
এখন ঠিক এই জিনিসটাই দরকার?’
আমি বলব... ‘বলেছিলাম
না, আমি ম্যাজিক জানি। আমি জানি তোর বেডরুমের দেওয়াল বেগুনি। তার সাথে এটা ম্যাচ
করবে কি? তোর পছন্দ?’
দেবলীনা হেসে বলবে, ‘খুব
পছন্দ।’
এর উত্তরে আমি হাসব।
দেবলীনা কি তারপর আমার হাতের ওপর হাত...
উঃ...!
জোর একখানা ঠোক্কর
খেলাম। রাস্তার মাঝে এক ইঁট। পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিলাম। বাঁ পায়ে চোট লেগেছে। এই
পায়েই কিছুদিন আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে চোট পেয়েছিলাম। খুব ব্যাথা করছে। রাস্তার পাশে
সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ব্যাথা জায়গাতেই কেন বারবার চোট লাগে? নোখটা ফেটে গিয়ে
রক্ত পড়ছে। গোড়ালিতেও ব্যাথা করছে। অটো না নিয়ে যে ভুল করেছি এবার বুঝলাম।
ভেবেছিলাম লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে যাব। এই রাস্তায় দেবলীনার সাথে
দুবার হেঁটেছিলাম, আগের বছর। এবছর সবকিছু আলাদা হয়ে গেল।
ধীরে ধীরে হাঁটার
চেষ্টা করলাম। এইভাবে বাড়ি পৌঁছানো যাবে না। মনে জোর আনার চেষ্টা করলাম। দেবলীনার
মুখটা মনে পড়ল। হাসি হাসি। মুক্তোর মতোন সাজানো দাঁত। সুন্দরী বললে রাগ করত। কপট
রাগ। হেসে ফেললাম। বলত, ‘আমাকে সুন্দরী বলবে না।’ চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। হাঁটতে
খুব কষ্ট হচ্ছে। ভাবতে চেষ্টা করলাম দেবলীনাকে ওয়াল হ্যাঙ্গিংটা দেখালে ওর মুখটা
কিরকম দেখতে হবে। কাউকে ভালোবাসলে তার হাসি মুখটা দেখতে ইচ্ছে করে বারবার। দাঁতে
দাঁত চেপে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলাম। নিজেকে বললাম, ‘She came back
for you. No one else did. But she came back. She knew you fell in love with
her. You can do this. You’ll have to do this, for her.’
সেদিন কিভাবে বাড়ি
পৌঁছলাম, জানিনা। তবে যন্ত্রণা আর ভালোবাসা দুটো জিনিস খুব কাছাকাছি। একে অন্যকে
ছাড়া থাকতে পারেনা। তাই আমার কাছে, এক মুহূর্তের ভালোবাসার জন্য হাজার মুহূর্তের
যন্ত্রণা কবুল।
এর পর কিছুদিন কাটল।
দেবলীনা আস্তে আস্তে সরে গেল। জানিনা কেন। হয়তো ও আগের মতোন টান আর অনুভব করতে
পারেনি। হয়তো ও বুঝেছিল, যে ‘She’ll have to respect herself enough to walk away
from anything that no longer serves her, grows her or makes her happy.’ হয়তো ও বুঝেছিল, আগের মতোন আর সেই আকর্ষণটা
আমাদের মধ্যে নেই। আর আমারও দুহাত বাঁধা। বেকার যুবকের প্রেম নিয়ে বড়াই করা
বাহুল্য। মুখ ফুটে বলতেও পারিনা, ভালোবাসি। চলে গেল দেবলীনা। কঠিন ছিল কি ওর জন্য
সরে যাওয়াটা? হয়ত ছিল। হয়ত বা নাও। একজন চব্বিশ বছরের বেকার যুবকের ভালোবাসার
মূল্য কত? দু-এক আনাও নয়। বুকটা ভেঙ্গে গেল। কিন্তু ভাঙ্গলনা আমার সেই না দেওয়া
উপহার। সেই ওয়াল হ্যাঙ্গিং।
এর পর দিন ঘুরছে।
মাস ঘুরবে। বছরও। দেখতে দেখতে আমি ভুলে যাব। যে ফুল আমি শ্রীজিতাকে দিতে চেয়েছিলাম
সে ফুল অন্য কারো কাছে গেছে। হয়তো কোনও প্রেমিক দিয়েছে তার প্রেমিকাকে। ফিরে
পেয়েছে তার ভালোবাসা। কেউ হয়তো দিয়েছে তার ভগবানকে। পেয়েছে তার প্রার্থনার জবাব। যে
উপহার দেবলীনাকে দেব ভেবেছিলাম, তা রয়ে গেছে আমার ক্যাবিনেটের ভেতরে। হয়তো রয়ে
যাবে অনেকদিন। দেবলীনার জিনিস আর কাউকে দিতে পারবনা। আর আমার স্বপ্নে আমি রচনা করব
আমার স্বপ্নপুরীর, যেখানে আমি আর কোনও একা, দুঃখী ছেলে নই, আমি রাজপুত্র। আর সেখানে
রাজকন্যারা এসে আমার হাত ছুঁয়ে নিয়ে যাবে আমার দেওয়া উপহার। সেই স্বপ্নপুরী আমার।
আমার নিজের।
But what
about his own happiness?
No one knew, in fact.
Perhaps, in some distant, or not-so-distant future, the lonely wandering boy
will find happiness in the wild bushes and flowers of the forest, in the steep
hillside fruits and red and purple coloured flowers, in the quiet waters of the
ocean, in the scorching heat of yellow deserts, in winter, summer or monsoon,
in the serene faces of unknown children of villages and unknown towns, in the
birds and animals and people from all parts of the world, wherever he goes, in
his moments with himself, in poetries, stories, and novels, in people's lives,
in several more things, small and big.
Or maybe, never.