নতুন গল্পের
খোঁজে আর প্রায় এক দশক পুরোনো ভালোবাসার অমোঘ টানে দূর্গাপুজোর পরেই কলকাতার
হাল্কা শীতের আমেজ আর শহরময় ছাতিমের মায়াবী ঘ্রাণের আকর্ষণ উপেক্ষা করে বিভূতি
এক্সপ্রেস ধরলাম।
পরেরদিন বারাণসী। সঙ্গী বলতে
একটা ব্যাকপ্যাক আর ক্যামেরা। স্টেশন থেকে অটোয় লাহুরাবির চৌক। ব্যাঙ্কে মিশ্রাজীর
কাছ থেকে বিশালের ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে রওনা দিলাম। দুপুরের চড়া রোদ উপেক্ষা করে
বিকেলেই দশাশ্বমেধ। সুদূরপ্রসারী ঘাট। তবে গঙ্গা চার বছর আগের তুলনায় যেন একটু
সংকীর্ণ লাগল। বাঁয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাটে একটা জটলা চলছে। ডানদিকে
কোণাকুণি পেছনে সূর্য অস্তায়মান। আমার মাথার অনেকটা ওপরে পায়রার একটা ঝাঁক গোল করে
একটা পাক খেয়ে আবার দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেল। সন্ধ্যে নামছে।
ঘাটে সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে।
বারাণসীতে কর্মরত আমার ব্যাঙ্কের দুই বন্ধু বিশাল শেঠ এবং শরদিন্দু মিশ্রা এবার
যোগ দিল। সন্ধ্যারতি শেষে গঙ্গার বুকে প্রদীপ ভাসানো গেল মনোষ্কামনা জানিয়ে। নৌকায়
গঙ্গাবিহারের অভিজ্ঞতাও হল। কালভৈরব মন্দির অবধি যাচ্ছে নৌকো। যাতায়াতের পথে
মণিকর্ণিকা ঘাটে দেখা গেল দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। পঞ্চভূতে মিশছে নশ্বর দেহ। কথিত
আছে, ভগবান শিবের কানের মণি পড়েছিল এখানে, সেই থেকে এই ঘাটের নাম। ফেরার পথে পায়ে
হেঁটে কাশী বিশ্বনাথ, দূর্গামন্দির ও কালভৈরব দর্শন করে রামকাটোরা চৌকের
অন্নপূর্ণা হোটেলে তন্দুরী রুটি আর পনীর বাটার মশালা খেয়ে বাড়ি।
পরেরদিন রামনগর। চেতগঞ্জ
চৌক থেকে অটোয় গোধূলিয়া গিয়ে ওখান থেকে কানেক্টিং অটোয় লঙ্কা। এখান থেকেই পরের
অটোয় রামনগর কেল্লা। সতেরোশো পঞ্চাশে কাশী নরেশের তৈরী ফোর্ট। সরস্বতী ভবন
মিউজিয়ামে দেখলাম আড়াইশো বছরের পুরোনো গাদাবন্দুক, সড়কি, তীর-ধনুক, পালকি,
অস্ত্রশস্ত্র, হাতির মাথার মুকুট। রয়েছে একশ বছরের পুরোনো ফোর্ড, ক্যাডিল্যাক,
প্লাইমাউথ ও মিনার্ভা গাড়ি। কেল্লার পেছনে ব্যাসকাশীও দর্শন হল।
সন্ধ্যেবেলা কাশী হিন্দু
বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে শ্রীবিশ্বনাথের মন্দির। ফেরার পথে হোটেল বাটি-চৌখায় সাত্তু
আর পনীর বাটির সাথে চৌখার স্বাদ অনন্য।
পরের দিনটা
ফাঁকা। চূণার যাওয়ার গাড়ি না আসায় পরিকল্পনা বদলানো গেল। পায়ে হেঁটে আর অটোয়
বারাণসীর অনেকটা ঘুরলাম। ভগওয়ানপুরে সানবীম ইংলিশ স্কুল দেখে তুলসী ঘাট থেকে নৌকোয়
দ্বারভাঙ্গা ঘাট। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-খ্যাত মছলিবাবার কথা মনে পড়ল। ঘাটের ওপরেই বৃজ
রামা প্যালেস, যেখানে পরে ফেলুদা মছলিবাবার ছদ্মবেশ ও পিস্তল খুঁজে পাবে। বর্তমানে
ঘাটের ওপর শ্বেতাঙ্গী বিদেশিনীর ধ্যানমগ্ন ছবি ক্যামেরাবন্দী হল। ফেরার পথে
‘দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউস’ চোখে পড়ল। এখানেও শ্যুটিং করে গেছেন সত্যজিৎ রায়।
দুপুরের খাওয়া সম্পন্ন হল বাঙালি হোটেল ‘জলযোগ’-এ। লস্যি এবং পানের পর্ব চুকিয়ে
ফিরলাম বাড়ির দিকে, ত্রিশ ঘন্টা লেটের হিমগিরি এক্সপ্রেস মাঝরাতে ধরতে হবে।
শহরের জন্মের সময়
থেকে শুরু করে বারাণসী আক্রান্ত হয়েছে বারবার। কিন্তু এই শহরের শিকড় আছে অনেক
গভীরে। বারাণসীর শিকড় মানুষের হৃদয়ে, শহরের অন্ধকার, ঘিঞ্জি, আঁকা-বাঁকা গলিতে,
পানমশলার সুগন্ধীতে, রঙবেরঙের চুড়ির টুংটাং আর কারুকার্য করা বেনারসী শাড়ির ভাঁজে।
ভোরের আধা আলোয় কেদার ঘাটে অচেনা সাধুর ‘রঞ্জিশ হি সহি, দিল হি দুখানে কে লিয়ে
আ...’ গেয়ে ওঠায়, সূর্যাস্তে মুন্সী ঘাটের ওপরে একান্তে হাতে হাত রাখায়, দুই দশক
আগে ছেড়ে আসা শহরের একান্ত অবসরে স্মৃতি রোমন্থনে।