(১)
প্রায় পনেরো
মিনিট হয়ে গেল সন্ধ্যে নেমেছে বারাণসীর ঘাটে। অবশ্য ঘাট থেকে সূর্যাস্ত সরাসরি
দেখা যায় না। আমার পেছনে ঘাটের অন্যপ্রান্তে কোণাকুণি বাঁয়ে সূর্য্য অস্ত গেছে।
ঘাটের ওপরে এখন গাঢ় অন্ধকার। একটা ঘন কালো পর্দা যেন রাজা হরিশ্চন্দ্র ঘাটের
সিঁড়িগুলো থেকে শুরু হয়ে গোটা গঙ্গা নদীটার ওপর বিস্তৃত হয়েছে। বাঁদিকে বেশ কয়েকশ’
গজ দূরে দশাশ্বমেধ ঘাটে চলছে সন্ধ্যারতি। জায়গাটায় আলোর রোশনাই, লোকে লোকারণ্য।
অনেকে আবার নদীর বুকে নৌকা ভাড়া করে বসে সেখান থেকে সন্ধ্যারতি দেখছে। মাঝখানের ঘাটগুলো
একেবারেই জনশূণ্য। ওপাশে দশাশ্বমেধের ডানদিকে আহিল্যাবাঈ, মুন্সী, দ্বারভাঙ্গা ঘাট
হয়ে রাণা মহলা আর কেদার ঘাট পেরিয়ে এই ঘাট। রাজা হরিশ্চন্দ্র ঘাট।
এখন সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা। ঠিক
চার ঘন্টা আগে এই ঘাটে বেশ কিছু চেনা মুখ ছিল। পূরবীর বাবা, মা, অন্যান্য
আত্মীয়রা। অস্থিবিসর্জনের সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া শেষ হতে না হতেই ঘাট প্রায় ফাকা।
সময়টা এখন নভেম্বরের শুরু। পুজোর পর প্রায় দিন দশেক কেটে গেছে। এই সময়টায় এখানে
রাত্রে যেমন হঠাৎ ঝপ করে ঠান্ডা পড়ে যায়, তেমনি দিনের বেলা অতিরিক্ত রোদ। অসহ্য
গরম। তাপমাত্রার এই হেরফেরটার সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে সর্দিগর্মি হতে বাধ্য।
ওরা কখন আসবে,
আমি জানতাম না। তবে এটা জানতাম যে, ওরা আসবে। ভোর পাঁচটা বেজে কুড়ি মিনিটে দু
প্যাকেট বিস্কুট আর এক বোতল জল নিয়ে গিয়ে বসেছিলাম রাজা হরিশ্চন্দ্র ঘাটে। পাঁচটা
বেজে কুড়ি মিনিটে নদীর ওপারে কোণাকুণি ডানদিকে রক্তিম একটা আভা দেখা গেল। ঠিক তার
চার মিনিট পর সূর্য্য উঠল। অদূরে রাণা মহলা ঘাটে কয়েকটা আট-দশ বছরের বাচ্চা একটা
জটলা শুরু করে আবার দূরের দিকে চলে গেল। আর ঠিক তার পরেই বামদিকে কেদার মন্দিরের
সংলগ্ন সরু একটা গলি দিয়ে হাতে কমন্ডলু আর পরণে গেরুয়া বেশধারী দাড়ি-গোঁফওয়ালা
একজন সাধু বেরিয়ে কেদার ঘাটের সবচেয়ে উঁচু বেদীটায় এসে বসলেন।
ভোরের দিকে ঠান্ডা একটা
শিরশিরানি ভাব থাকে বাতাসে, তাই গেস্ট হাউস থেকে একটা শাল নিয়ে গিয়েছিলাম। শালখানা
গায়ে ভালো করে জড়িয়ে ঘাটের শেষ প্রান্তে একটা পায়রার ঝাঁকের কীর্তিকলাপ লক্ষ্য
করছি, এমন সময়ে আওয়াজটা ভেসে এল।
শান্ত ভোরে বারাণসীর নির্জন
ঘাটে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে গঙ্গা আছড়ে পড়ছে। ছোট্ট তরঙ্গগুলোর মাথায় পুবের লাল
সূর্য্যের রঙ। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে কানে ভেসে আসছে আহির ভৈরবের একটা মিষ্টি সুর।
একটা গান। গাইছে ওই
গেরুয়াধারী।
“ছলিয়া... মোরে বাঁকে ছলিয়া,
মোরে ডগরিয়া চলে আও ছলিয়া ।
নজর ভর ভর, পিয়া মা ঘর ঘর...
বস তোঁহে দেখু দিন রেইন রে সাওরিয়া ।
আঁখিয়া পসারে হ্যাঁয় মোরি গলিয়া
জাগি হ্যাঁয় রাতিয়া, বাকি হ্যায় বতিয়া...
চকোরি বন বন তোঁহে দেখু রে ছলিয়া
মিসরি সি তোরী হ্যাঁয় সিরি বতিয়া
জানে হ্যাঁয় সখিয়া, জ্বলে মোসে সখিয়া...
অঞ্জুরি ভর ভরকে পিঁউ রে ছলিয়া
মোরে বাঁকে ছলিয়া, মোরে বাঁকে ছলিয়া,
মোরে ডগরিয়া চলে আও ছলিয়া ।।”
গান শেষ হল। আমার পেছনে বামদিকে
কেদার মন্দিরের ঘন্টা বাজিয়ে পুজো শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী
আমার পাশ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে কমন্ডলুতে গঙ্গাজল ভর্তি করে আবার যে পথে এসেছিলেন
সেই পথেই ফিরে গেলেন। শুধু উপহার দিয়ে গেলেন একটা বিষণ্ণ সকাল। আর তার চেয়েও বড়
কথা পূরবীর চলে যাওয়াটা আরও বেশী করে মনে করিয়ে দিলেন।
আটদিন আগে পূরবী
মারা গেছে। বা বলা ভালো, ওকে মারা হয়েছে। কেন, কেউ জানে না। কিভাবে, সেটা অবশ্য
সবাই জানে। আর সেই নৃশংসতার কথা মনে পড়লেই চোখে জল চলে আসছে বারবার।
ঠান্ডা শিরশিরে
একটা বাতাস বইছিল এতক্ষণ। এখন একটা দমকা হাওয়া ঘাটের দিক থেকে নদীর দিকে বইতেই
ঘাটের ওপরের দিকের সিঁড়িগুলো থেকে একটা দলা পাকানো কাগজ উড়ে এসে সামনের সিঁড়িটায়
পড়ল। কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে টানটান করে পড়ার পর বুকপকেট থেকে সাতদিন আগে কলকাতায়
পাওয়া একটা চিরকুট খুলে পাশাপাশি রেখে দুটোর মধ্যে মিল খোঁজার চেষ্টা করলাম।
চিরকুট দুটোর হাতের লেখা এবং বয়ান একই।
“আমাদের দেখা
হওয়া দরকার ।।”
কাগজদুটো ভাঁজ করে আবার
বুকপকেটে রেখে দিলাম।
আমি বারাণসী
এসেছি গতকাল সন্ধ্যে। পরশু মাঝরাতের বিভূতি এক্সপ্রেস বারাণসী পৌঁছেছে সন্ধ্যে
সাড়ে ছ’টা নাগাদ। বারাণসীতে আমার দুই পুরোনো বন্ধু বিশাল শেঠ এবং শরদিন্দু মিশ্রা
আমার জন্য গেস্ট হাউস বুক করে রেখেছিল, সেখানেই আশ্রয় নিলাম। গতকাল সন্ধ্যেবেলাতেই
শরদিন্দু আর বিশাল জোরাজোরি শুরু করেছিল একবার কাশী বিশ্বনাথের মন্দির দর্শন করার
জন্য। আমি রাজি হইনি। তার কারন যে শুধু আমার মনের অবস্থা তাই না, যে কারনে আমি
বারাণসী এসেছি সেটা মন্দির দর্শন নয়।
পূরবীর সাথে আমার
দেখা হয় আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে। সেন্ট জেভিয়ার্সে আমাদের কলেজের থিয়েটার গ্রুপ
সেবার একটা নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য নন্দন থিয়েটার রিজার্ভ করে। নাটকের নাম,
‘একবিংশ শতাব্দীর ডেসডিমোনা’। কলম আমার। মূল পুরুষ চরিত্রেও আমিই রইলাম। পরিচালনার
ভার যথারীতি নিলেন তৃতীয় বর্ষের রায়ান-দা। রায়ান গুহঠাকুরতা – যে কয়েক বছর পরে থিয়েটারকেই
পেশা হিসেবে বেছে নেবে। নায়িকা এবং মুখ্য ভূমিকার জন্য বেছে নেওয়া হল
মাইক্রোবায়োলজির ডাকসাইটে সুন্দরী ঋতমা-কে।
কিন্তু নাটক উপস্থাপনার এক
সপ্তাহ আগে ঘটল বিপদ। ঋতমার একসিডেন্ট। পায়ের হাড় ভেঙ্গে হাসপাতাল। অগত্যা খোঁজ
খোঁজ। কিন্তু ডেসডিমোনার চরিত্রে নতুন মেয়ে আর পাওয়া যায় না। কোনও মেয়েই এক
সপ্তাহের প্র্যাক্টিসে এত বড় চরিত্র করতে রাজি নয়। তখনই পাওয়া গিয়েছিল পূরবীকে।
কলেজের একজন জুনিয়র একদিন ক্যান্টিনের সামনে নিয়ে এসেছিল ওকে। সাদা টি-শার্ট আর
নীল জিনস পরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পূরবী বলেছিল, “আমি করতে রাজী আছি ডেসডিমোনার
চরিত্র।” যাদবপুরের ইংলিশ অনার্সের মেয়ের চোখের নীল তারা আর উন্নত উদ্ধত গ্রীবায়
চাপা গর্ব। নাটকের ডেসডিমোনার চরিত্র থেকে কয়েকটা লাইন অভিনয় করে দেখাতে বলেছিলাম
ওকে, তখনই।
কয়েকটা লাইন নয়।
নাটকের শেষ দৃশ্যে ডেসডিমোনার সাত মিনিটের মোনোলগটা যখন পূরবী অভিনয় করা শেষ
করেছিল, তখন ক্যান্টিনের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করে দিয়েছে। ওর উত্তর
কলকাতার বাংলা উচ্চারণ, বেশভূষা, আয়ত চোখের নীল তারা, ফোয়ারার মতন হাসি সকলকে
মোহিত করে দিয়েছিল।
ভালোবেসে ফেলেছিলাম। পাঁচদিন ধরে
নাটকের প্র্যাক্টিস চলার ফাঁকেই আমাদের গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ষষ্ঠদিন
সন্ধ্যেবেলা প্র্যাক্টিসের শেষে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম আমি, ওর কাঁধদুটো ধরে।
পরের দিন ছিল নন্দনে নাটকের মঞ্চন।
“আবার কী হল?”
অবাক হওয়ার ভান করে হেসে জিজ্ঞেস করেছিল পূরবী।
কিছু বলতে পারিনি
প্রথমে। ওর চোখের দিকে নিঃশব্দ জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়েছিলাম। দশ সেকেন্ড ধরে চার চোখ
মিলে গিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। নিঃশব্দ সেন্ট জেভিয়ার্সের মাঠে সন্ধ্যের অন্ধকারে
দুজন মানুষের ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ।
“উত্তর চাই।” আমি
বলেছিলাম।
চোখ নামিয়ে
নিয়েছিল ও, পলকের জন্য। তারপর মুহুর্তের মধ্যে চোখ তুলে তাকিয়ে বলেছিল, ‘কাল কথা
হবে।’
পরেরদিন
নন্দন প্রেক্ষাগৃহের প্রতিটি দর্শক প্রত্যক্ষ করেছিল কিভাবে একজন অনামী অভিনেত্রী
বিগত কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়াই মঞ্চের ওপর দাপটে দেড় ঘন্টার একটা জোরালো, আঁটোসাটো পারফরমেন্স
করতে পারে। শেষ দৃশ্যে মঞ্চের এক কোণায় স্পটলাইটের আলোর নিচে আমি একা দাঁড়িয়ে, আর
মঞ্চের ঠিক মাঝখানে আহত বাঘিনীর মত পূরবীর একা পায়চারি, দ্বিধা, হাসি, কান্না
মেশানো সাত মিনিটের মোনোলগ। ডেসডিমোনার মুখে হাসি আর চোখের কোণে জলের মধ্যেই নেমে
আসে পর্দা। মঞ্চের এপাশে পর্দার আড়ালে আমি আর পূরবী দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম দর্শকদের
হাততালির আওয়াজ। আর তার মধ্যেই পূরবী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে। মিশে গিয়েছিল
আমার ওষ্ঠ পূরবীর অধরে। একবার, দুবার, তিনবার... বারে বারে নিষ্পেষণ করে গিয়েছিল
আমাদের ঠোঁট দুটো একে অপরকে।
সেটা আজ থেকে সাত বছর আগেকার কথা।
আর ঠিক আট দিন
আগে মারা গেছে পূরবী। কোনও এক অজানা আততায়ীর হাতে। ওর বাড়ি থেকে অনতিদূরে একটা কাঠচাঁপা
গাছের তলা থেকে ওর ক্ষতবিক্ষত দেহটা যখন উদ্ধার করা হয়, তখন সেই দেহে আর প্রাণ ছিল
না। খবরটা শুনে আমি তৎক্ষণাৎ গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম ওর বাড়িতে। তারপর হাসপাতাল,
মর্গ এবং শ্মশান। সারা দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে শ্মশানের পাশেই একটা বেঞ্চে শুয়ে
পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম পকেটে একটা চিরকুটের অস্তিত্ব। চারভাঁজ করা ছোট্ট
কাগজটায় গোটা গোটা অক্ষরে চারটে শব্দ লেখা ছিল ---
“আমাদের দেখা হওয়া দরকার ।।”
ঘাটের ওপরে
সন্ধ্যের আলোগুলো একে একে নিভতে নিভতে কখন মাঝরাত নেমে এসেছে বুঝতে পারিনি। আমার
সামনে কোণাকুণি ডানদিকে অস্পষ্ট একটা জ্বলন্ত চিতা, সামনে ঘাটের সিঁড়িগুলোর ওপর
অন্ধকারাচ্ছন্ন অদৃশ্য মৃদু ঢেউগুলোর ছলাৎ ছলাৎ স্পষ্ট শব্দ, সারি সারি নৌকোগুলো
একে অপরের সাথে বাধা... আর তারও দূরে সুবিস্তীর্ণ জলরাশি। কুয়াশার সাদা একটা পর্দা
গঙ্গার বুকজুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু তার থেকেও জমাট ধোঁয়াশা আমার
মনে।
কেউ একজন আমার
সাথে দেখা করতে চায়।
কে সে? সেই কি
খুনী? নাকি সে এই হত্যার ব্যাপারে কিছু জানে? আমার সাথে সে দেখা করতে চায়ই বা কেন?
বিস্তীর্ণ
গঙ্গাবক্ষে ধূসর সাদা কুয়াশার পর্দা, আশা-আশংকার দোলাচল, রাজা হরিশ্চন্দ্র ঘাটের দাউদাউ
করে জ্বলে চলা চিতা নিদ্রাবিহীন রাত কাবার করে দিল। তারপর অনেক পরে নদীর অপর
প্রান্তে ডানদিকে কোণের আকাশটায় দেখা দিল একটা রক্তিম আভা। আর তারপর আধ ঘন্টার
মধ্যে সূর্য্যটা একটা প্রকান্ড লাল থালার মতো দিগন্তের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে
চারপাশটা ঝলমলে আলোয় ভরিয়ে দিল। আর তার সাথেই শুরু হয়ে গেল জনমানুষের আনাগোনা,
সাধু-সন্ন্যাসীদের যাতায়াত, পর্যটকদের সূর্যোদয় দেখার জটলা, সারা রাত ঘাটের ধারে
বেঁধে রাখা নৌকোগুলোর মাঝনদীতে ব্যাস্ততা।
বারাণসীর ঘাটে আমার দ্বিতীয় সকাল।
প্রায় চব্বিশ
ঘন্টা কেটে গেছে কিছু না খেয়েই। তাই সকাল ন’টার দিকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে এঘাট ওঘাট
পায়চারি করছি উদ্দেশ্যহীনভাবে, এমন সময়ে একটা জিনিষ চোখে পড়ল।
দ্বারভাঙ্গা ঘাটের ঠিক সামনে, ঘাটের ওপর
সদ্য স্নান সেরে তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে ব্যস্ত একজন যুবক। চেহারা লম্বা, কোঁকড়ানো
চুল, পরিষ্কার কামানো দাড়ি। আর তার সাথে কানে আসছে ব্যস্ত সকালেও গলা ছেড়ে তার
গানের কয়েকটা লাইন...
“অব তেরে বিন, জি লেঙ্গে
হম।
জহর জিন্দেগি কা, পিই
লেঙ্গে হম।
কেয়া হুয়া, যো ইক দিল টুট
গয়া ।।”
গানের লাইনগুলো অতি পরিচিত পুরোনো এক
হিন্দি সিনেমার। ওতে সন্দেহ নেই। কিন্তু...
ওই গলা !
গানের ওই গলা
আমার চেনা। এই গলার মালিককেই আমি গতকাল ভোরবেলা কেদার ঘাটের সবচেয়ে উঁচু বেদীতে
বসে আহির ভৈরব গাইতে শুনেছি। তবে সেটা একজন সন্ন্যাসীর বেশে।
কিন্তু এ কোনও
সন্ন্যাসী নয়। লম্বা একহারা চেহারা, কোঁকড়ানো চুল আর বলিষ্ঠ বাহুর অধিকারী লম্বা
লম্বা পা ফেলে এবার এগিয়ে চলেছে দ্বারভাঙ্গা ঘাটের ওপরের সিঁড়িগুলোর দিকে। ঘাটের
শেষের সিঁড়িগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থেকে পায়ের শব্দে আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম যুবকটির
অবস্থান। সিঁড়ি দিয়ে উঠে পায়ের আওয়াজ ঘুরে গেছে বামদিকে। আর তারপরেই একটা দরজার
শেকল খোলার শব্দ। কেউ যেন একটা দরজার শেকল খুলে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে দিল।
দ্বারভাঙ্গা ঘাটের
ওপরেই বামদিকে বৃজরামা প্যালেস। ঠিক পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পরেই দেখলাম এক সাধু
বৃজরামা প্যালেসের দরজার শেকল খুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সোজা হরিশ্চন্দ্র ঘাটের
দিকে চলে গেলেন।
আর তার মিনিট
দুয়েকের মধ্যেই আমি সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠে বামদিকে গিয়ে শেকল খুলে ঢুকে পড়লাম
প্যালেসে। সার দিয়ে ঘরের দরজা চারদিকে। আর মাঝখানে একটা খোলা দালান, ওপরের ছাদ
দেখা যায় দালানটায় দাঁড়ালে। নিচের তলার সবকটা ঘরই দেখলাম বন্ধ। দালানের পাশেই সরু
অন্ধকার একটা সিঁড়ি, দোতলায় যাওয়ার। ওপরের দিকে পা বাড়ালাম।
ওপরের তলায় দুটো ঘর, পাশাপাশি। একটা
ঘরের দরজার কড়াদুটো দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। অন্য ঘরটার দরজা খোলা। খোলা দরজা
দেখে ঢুকে পড়লাম। ঘরটায় একটা তক্তপোষ আর পাশে মেঝেতে দুটো ছোটো সিন্দুক। তক্তপোষের
পাশেই একটা চৌকি। তার পাশে খোলা চওড়া জানালা। জানালার পাশ দিয়ে একটা লম্বা গাছ
সোজা উঠে গেছে ওপর দিকে। আর সেই গাছেরই একটা ছোট্ট ডাল এঁকে বেঁকে এসে জানালার
মধ্যে দিয়ে প্রায় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে।
ঘরটা প্রায়
আসবাববিহীন। এক ওই চৌকি আর সিন্দুকদুটো ছাড়া। চৌকিটার ওপর দেখলাম একটা রেস্তোরাঁর
বিল আর একটা মোবাইল ফোনের সিম রাখা। চৌকির পাশেই মেঝেতে লম্বা মত কিছু একটা পড়ে
আছে মনে হল। নিচু হয়ে হাতে নিয়ে বুঝলাম একটা শক্ত নাইলনের দড়ি। হঠাৎ ঝটপট করে একটা
শব্দ হতেই ঘুরে দেখলাম একটা পায়রা এসে বসেছে গাছের ছোট্ট ডালে, জানালার ধারটায়।
বারাণসীর দ্বারভাঙ্গা ঘাটের ধারে
বৃজরামা প্যালেসের দোতলার একটা ছোট্ট ঘরের কোণে আমি, আমার অন্যমনস্ক হাতে দোদুল্যমান
একফালি সরু নাইলনের দড়ি। আর হাত তিনেক দূরে জানালার ওপরে একটা পায়রা। ব্যস্ত
জনবহুল পৃথিবী থেকে যেন অনেক দূরের একটা নিস্তব্ধ দু’ মিনিটের পৃথিবী।
আর ঠিক সেই সময়ে নীচে, দরজার
শেকলের একটা শব্দ পাওয়া গেল।
ঘরের মালিক
ফিরেছে। আর তার গলা খাঁকরানির শব্দে এটা স্পষ্ট যে সে সিড়ি বেয়ে ওপরেই উঠে আসছে।
চকিতে ঘর থেকে
বেরিয়েই চারপাশটা জরিপ করে নিলাম। আমার বামদিকে আছে নিচে যাওয়ার সিঁড়ি, যা দিয়ে
উঠে আসছে ওই ঘরের মালিক। ডানদিকের অন্য ঘরের দরজাটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। তারও
ডানদিকে ঝুলকালি মাখা দেওয়ালের দিকে একটা রেলিঙ্-এর মত কিছু রয়েছে মনে হল।
পায়ের শব্দ এবার সিঁড়ির একেবারে কাছে।
ডানদিকে ঠিক
সাতটা পা জোর কদমে চালিয়ে যখন জমাদারদের যাতায়াত করার ছোট্ট সিঁড়িটার আড়ালে লুকিয়ে
পড়েছি, বুঝলাম পায়ের শব্দের মালিক সিঁড়ি পার করে দোতলায় উঠেছেন। সিঁড়িটার আড়ালে
লুকিয়ে এক মুহুর্তের জন্য যখন পেছনে ফিরে তাকালাম, তখন দেখলাম, গেরুয়া সন্ন্যাসীর
বেশধারী এক যুবক এক হাতে কমন্ডলু আর অন্য হাতে একটা নকল চুলদাড়ি হাতে প্রবেশ করছে
সেই ঘরটাতে, যেখানে ঠিক আধমিনিট আগে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম।
ভদ্রলোকের চেহারা লম্বা একহারা, কোকড়ানো চুল এবং পরিষ্কার কামানো দাড়ি।
রেলিঙের সিঁড়ি
ধরে নিঃশব্দে নীচে নেমে এলাম। এখানের সরু গলিটা সোজা পৌঁছে গেছে মেন রোডে। পা
চালিয়ে এগিয়ে চললাম গেস্ট হাউসের উদ্দেশ্যে। আজ রাতের ট্রেন আছে বারাণসী থেকে
কলকাতার জন্য। তৈরী হতে হবে।
ওই নকল সাধুর সাথে চিরকুটগুলোর সম্পর্ক
আছে। কিন্তু কি সম্পর্ক, হয়তো সেটা সময়ই বলে দেবে।
রাত সাড়ে ন’টার
হিমগিরি এক্সপ্রেস বারাণসী স্টেশনে যখন ঢুকল তখন রাত প্রায় সোয়া বারোটা। পীঠের
ব্যাগটা সিটের নিচে চালান করে এসি কেবিনের একাকিত্বটাকে অনুভব করার চেষ্টা করা
গেল। গত তিনদিন ঘুম প্রায় আসেনি বললেই চলে। শরীরে অসম্ভব ক্লান্তি, আর চোখদুটো
ভারি হয়ে আসছে। কামরার আলোর সুইচগুলো অফ করে চামড়ার জ্যাকেটটা হুকে টাঙ্গিয়ে শুয়ে
পড়লাম। রেলের এটেন্ডেন্ট দুটো করে চাদর দিয়ে গেছে। ওটাই গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল
দুপুরের মধ্যে ট্রেন কলকাতা ঢুকবে। নকল সাধু, বেনামী চিরকুট, পূরবীর মৃত্যু – এসব নিয়ে
তারপর চিন্তা করা যাবে। বিশাল আর শরদিন্দু জোরাজোরি করছিল আর কয়েকটা দিন বেনারসে
থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু উপায় নেই, ফিরতে হবে। নিজের জন্য না হলেও পূরবীর
মা-বাবার জন্য। কর্তব্যবোধ বলে একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া খুনের কিনারার ব্যাপারে
পুলিশের দিক থেকে সেরকম কোনও সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। পূরবীর অন্য কারও সাথে সম্পর্ক
ছিল না তো?
একটা তন্দ্রামত এসেছিল। ট্রেনের
ঝাঁকুনিতে সেটা হঠাৎ কেটে গেল। এয়ার কন্ডিশনের ঠান্ডাটা খুব বেশী লাগছে। দুটো
চাদরেও কাজ হচ্ছে না দেখে হুক থেকে চামড়ার জ্যাকেটটা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে নামিয়ে
পরে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। এর ওপর চাদর ঢেকে শুয়ে পড়লেই নিশ্চিন্তি।
কিন্তু জ্যাকেটটা
পরতে গিয়ে তার ডানদিকের পকেটে হাত দিতেই কিছু একটা খচমচ করে উঠল। আন্দাজে আন্দাজে
লাইটের সুইচটা অন করে জ্যাকেটের পকেট থেকে হাত বার করতেই তাতে যেটা উঠে এল সেটা আর
কিছুই নয়, একটা চারভাঁজ করা কাগজের টুকরো। আর তাতে গোটা গোটা অক্ষরে চারটে
শব্দ লেখা-
“কাঠচাঁপারা এখনও উত্তর দেয় ।।”
এই চিরকুটের একটাই
মানে হতে পারে। চিরকুটের মালিক যাত্রা করছে আমারই সাথে, একই ট্রেনে।
আমার ভাগ্য,
পূরবীর খুনী, চিরকুটের মালিক, নকল সাধু... সবকটা রহস্যের মায়াজালে জড়িয়ে থাকা ওই চারভাঁজ
করা কাগজের টুকরোটাকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বাকি রাতটা নিদ্রাহীন জেগে বসে রইলাম।
(২)
মাঝে মাঝে মনে
হয়, আমার আমিত্বটা দুভাগে বিভক্ত। দুইয়ের বেশীও হতে পারে অবশ্য। মানুষের মনের
ভেতরটা যে কতটা জটিল হওয়া সম্ভব, তা বোঝা ভার। মুশকিল হচ্ছে, এই যে আমি, আমার
মধ্যে যে অন্য আরো বেশ কয়েকটা আমি আছে, তা শুধু আমার চারপাশের লোকেরাই বুঝতে পারে।
আমি বুঝতে পারি না। কোনও কোনওসময়ে আমার এই আমিটা মরে যায়, জেগে ওঠে আমার অন্য কোন
এক আমিত্ব।
সময়টা ভোর হলেও
বারাণসীর এদিকের ঘাটগুলো অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশী ভীড়। লোকে লোকারণ্য। কোনও এক
সিনেমার শ্যুটিং চলছে। একটা চলন্ত ট্রলির ওপর বড় একটা ক্যামেরার সামনে দিয়ে কেদার
মন্দিরের সংলগ্ন সরু একটা গলি থেকে হাতে কমন্ডলু আর পরণে বেশধারী দাড়িগোঁফওয়ালা একজন সাধু বেরিয়ে এসে কেদার
ঘাটের সবচেয়ে উঁচু বেদীটায় বসলেন। ক্যামেরার ডানদিকে বসে থাকা ছয়ফুট লম্বা একজন
লোক চিৎকার করে বললেন, ‘কাট’।
চামড়ার জ্যাকেটের পকেটে হাতদুটো ঢুকিয়ে
দাঁড়িয়েছিলাম। ডানদিকের পকেটে একটুকরো কাগজ খড়মড় করে উঠতে সেটাকে মুড়ে দলা পাকিয়ে
ঘাটের ওপরের সিঁড়িগুলোর দিকে ছুঁড়ে দিলাম। একটু একটু ঠান্ডা লাগছে। নদী বলে কিনা
জানি না, হাওয়াটা এখানে সবসময়ই আছে। একটু এগিয়ে ঘাটের নিচের সিঁড়িগুলোর মধ্যে
একটায় এসে বসলাম।
একটা গানের আওয়াজ ভেসে এল।
কেদার ঘাটের ওপর শ্যুটিং আবার শুরু হয়েছে।
ঘটনাটা প্রথম ধরা
পড়ে আমার আবাসিক স্কুলে, আমার তখন এগারো বছর বয়স। তিনদিন ধরে তুলি রঙে নিজেরই আঁকা
একটা ছবি ছিঁড়ে কুটি কুটি করতে দেখে এগিয়ে এসে এক ছাত্র বাধা দিতে গিয়েছিল। প্রথমটায়
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। পরে নজর পড়তে দেখি আমার পায়ের কাছে পড়ে ছিল আমারই
একটি সুন্দর সৃষ্টির খন্ড-বিখন্ড অংশ।
বারো বছর বয়সে এক সাইকায়াট্রিস্টের
কাছে আমার চিকিৎসা শুরু হয়। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার। সংক্ষেপে ডি.আই.ডি.। অথবা বলা যেতে
পারে স্প্লিট পার্সোনালিটি। সতেরো বছরের সুদীর্ঘ সময় যাবৎ চিকিৎসাধীন থাকার কারণে
এসম্পর্কে বহু ঘটনার কথা ডক্টরের মুখে শোনা হয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে একটি ঘটনা ছিল
বিলি মিলিগান-এর। উনিশশো সাতাত্তর সালে ওহায়ো ইউনিভার্সিটির কাছে পরপর তিনজন মহিলা
কিডন্যাপড এবং পরে ধর্ষিত হন। এদের মধ্যে একজন মহিলার বক্তব্য, ধর্ষকের ইংরাজীতে
জার্মান একসেন্ট ছিল। অন্য এক মহিলার বক্তব্য অনুযায়ী, ধর্ষক খুবই নরম মনের মানুষ।
তিনটি ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতি ছিল বিলি মিলিগান। বিলির এরেস্টের পর ওর ডি.আই.ডি. ধরা পড়ে। সব মিলিয়ে ওর মধ্যে মোট চব্বিশ ধরণের
পার্সোনালিটি পাওয়া গিয়েছিল, যার মধ্যে একজন ছিল রেগেন – এক য়ুগোস্লাভিয়ান। অন্য
একজন ছিল আডলানা – এক লেসবিয়ান চরিত্র। মিলিগান ছিল প্রথম আমেরিকান নাগরিক যে ডি.আই.ডি.-এর কারণে কোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত হয়।
আরেকজনের ঘটনা
মনে পড়ছে, ট্রুডি চেস। ট্রুডির মতে দু’বছর বয়স থেকে সে তার সৎ বাবার দ্বারা যৌন
নির্যাতিত হয়েছিল। তার মা তাকে বারো বছর ধরে মানিসিকভাবে নিপীড়ন করে। পরবর্তীকালে সাইকায়াট্রিস্টের
সাথে বিভিন্ন সেশনে ট্রুডির মধ্যে মোট বিরানব্বইটি সত্ত্বা বা পার্সোনালিটি পাওয়া
গিয়েছিল, যারা একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই পার্সোনালিটিগুলির মধ্যে একজন
ছিল পাঁচ-ছয় বছর বয়সী একটি মেয়ে। অন্যজন ছিল ইয়ান – একজন আইরিশ কবি এবং আরেকজন
একহাজার বছর বয়সী এক দার্শনিক।
আরও
দুটো ঘটনা – একটা শার্লি মেসনের। মিনেসোটায় জন্ম শার্লির শৈশব ছিল চাইল্ড এবিউসের
শিকার। উনিশশো পঞ্চান্ন সালে মেসন তার ডাক্তার কর্নেলিয়াকে কিছু অদ্ভুত ঘটনার কথা
উল্লেখ করে। তার বিবরণ অনুযায়ী সে বেশ কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে অজানা শহরের অচেনা
কোনও হোটেলে খুঁজে পেত। তার বিবরণীতে এরকম ঘটনারও উল্লেখ ছিল যে সে কোনও দোকানে ঢুকে
হঠাৎ কোনও ভাঙচুর করা জিনিষপত্রের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করত যে ঘটনার কোনও স্মৃতি
তার মনে নেই।
দ্বিতীয় ঘটনাটা আরও অদ্ভুত, এবং গায়ে শিহরণ
খেলিয়ে যাওয়ার মত। উনিশশো নব্বই-এর জুন মাসে মার্ক পিটারসেন নামে এক ব্যক্তি এক
অজানা ছাব্বিশ বছর বয়সী মহিলার সাথে কফিশপে ডেটে যান। এর আগেও তারা দু’বার পার্কে
দেখা করেছিলেন। কফিশপে পিটারশন ওই মহিলার মধ্যে তার একুশটি পার্সোনালিটির কয়েকটির
নিদর্শন পায়। রেস্তোরাঁ থেকে বেরোনোর পর মার্ক ওই মহিলাকে যৌন সঙ্গমের প্রস্তাব
দেয় এবং মহিলাটি সম্মত হয়। কিন্তু এর ঠিক কিছুদিন পরেই মহিলাটির অভিযোগের ভিত্তিতে
যৌন নির্যাতনের অপরাধে মার্ককে গ্রেপ্তার করা হয়। স্পষ্টতই, মহিলাটির মধ্যেকার
দুটি পার্সোনালিটি বা সত্ত্বা সঙ্গমের ব্যাপারটাকে মেনে নিতে পারেনি। এর মধ্যে
একজন ছিল বিশ বছর বয়সী এক তরুণী, সঙ্গম চলাকালীন যার উদ্ভব হয়েছিল। অপরজন ছিল এক
ছয় বছর বয়সী, যে পুরো ব্যাপারটা দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেছিল। ছয় মাস ট্রায়ালের পর
জামিনে পিটারসেন ছাড়া পায়।
ঘাটের ওপরে
সন্ধ্যার আলোগুলো একে একে নিভতে নিভতে কখন মাঝরাত নেমে এসেছে, বুঝতে পারিনি। আমার
সামনে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘাটের সিঁড়িগুলোর ওপর অদৃশ্য মৃদু ঢেউগুলোর ছলাৎ ছলাৎ স্পষ্ট
শব্দ, সারি সারি নৌকাগুলো একে অপরের সাথে ঘাটের ধারে বাঁধা... আর তারও দূরে
সুবিস্তীর্ণ জলরাশি। কুয়াশার সাদা একটা পর্দা গঙ্গার বুকজুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। আমার
সামনে কোণাকুণি ডানদিকে একটা জ্বলন্ত চিতা, শেষ নভেম্বরের মৃদু ঠান্ডায় আলতো গরমের
একটা আভাস দিয়ে যাচ্ছে।
জ্বলন্ত চিতার সামনে কাদামাখা নদীর পাড়ে
একটা ছোটো আলোর উৎস দেখে মনটা উৎসুক হল। একটা হ্যারিকেনকে ঘিরে চারটে অন্ধকার
মাথা। অস্পষ্ট ভাষায় কয়েকটা কথার শব্দ, হাসির আওয়াজ।
তাসের আসর বসেছে।
সম্ভবতঃ ওরা ডোমশ্রেণীর লোক। জ্বলন্ত চিতার দায়িত্বে থাকা চারজন অচেনা মানুষের
রাত্রিযাপনের উপায়। আমি যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে পাঁচ-ছয় ধাপ নামলেই ঘাটের
সিঁড়ির শেষ এবং কাদামাখা পাড়ের শুরু। লোকগুলো প্রায় কুড়ি ফুটের মধ্যে। একজন হাহা
শব্দে বিশ্রী এক পৈশাচিক হাসি হেসে উঠল। খেলা শুরু হল।
তাস ভাগ করে দেওয়া হল চারজনের মধ্যে। চাঁপা
স্বরে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ডাক উঠছে... এক, তিন, পাঁচ। তাস পড়ছে, বারবার। আবার
ব্যস্ত কয়েকটা হাত সেই তাস তুলে নিয়ে নতুন চালের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাত মিনিট পর খেলার
প্রথম হাত শেষ হল। হ্যারিকেনের আবছা হলুদ আলোর প্রতিচ্ছবিতে সাদা দাঁত বের করে একজন
আবার সেই পুরোনো পৈশাচিক হাহা শব্দে হেসে উঠল।
এরপর যা দেখলাম,
তাতে অবাক লাগল। পৈশাচিক হাসির অধিকারী বাদে বাকি তিনজন এগিয়ে গেল চিতার পাশে রাখা
একটা হাঁড়ির দিকে। একটা মস্ত হাতায় করে ঘি বের করে এনে প্রত্যেকে একবার করে ঢেলে
দিতে লাগল ওই জ্বলন্ত চিতার ওপর। একবার, দু’বার, তিনবার। আগুনের লেলিহান শিখা
লাফিয়ে উঠল আকাশের উর্দ্ধপানে। তিনজন এবার ফিরে এসে নিজেদের জায়গায় বসে পড়ল। এর পর
উঠল চতুর্থজন। অর্দ্ধনগ্ন দেহটাকে আগুনের সামনে দিয়ে সাপের মতন এঁকেবেঁকে এগিয়ে
নিয়ে গিয়ে একহাতা ঘি তুলে আনল হাঁড়িটা থেকে। এবং মুহুর্তের মধ্যে ঢেলে দিল নিজের
মুখের মধ্যে। বিজয়ের উল্লাসে মৃতের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত ঘৃত দিয়ে নেশা করছে সে।
ব্যাপারটা আগাগোড়া পৈশাচিক।
দশ-পনেরো মিনিট এরকম চলার পর একটা
অদ্ভুত দৃশ্যে শরীরের সমস্ত রোম একসাথে খাড়া হয়ে উঠল। বামদিকের ঘাটের তলার দিকের
একটা সুড়ঙ্গ থেকে সার দিয়ে পরপর দুটো সাদা নরকঙ্কাল বেরিয়ে এসে ওই চারজনের সামনে
নিঃশব্দে দাঁড়াল। পরক্ষণেই এই চারজন হ্যারিকেনের আলো নিভিয়ে তাস ফেলে লম্বা
লম্বা পায়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলে গেল। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে প্রত্যেকের
চাপা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম – “হর হর মহাদেব, হর হর মহাদেব ।”
ওরা ভয় পেয়েছে।
কঙ্কালগুলো
ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সাজানো চিতা থেকে কি যান খুঁজে বেড়াচ্ছে আর চিতার আগুন
ঘুরে ঘুরে মাতালের মতন পাক খাচ্ছে। সর্বাঙ্গ সাদা ফ্যাটফেটে ওরা...
ওরা কি... ওরা কি মানুষ?
না মানুষ নয়। ওরা
কঙ্কালও নয়। সর্বাঙ্গে সাদা ছাইয়ের পুরু আবরণে মাখা দীর্ঘাঙ্গী ওই পুরুষেরা অঘোরী।
বেনারসের কুখ্যাত সাধু যারা ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য মানুষের মাংস এমনকি মলমূত্রও বাদ
রাখে না। অঘোরী দুজন চিতার কাঠের আবরণ সরিয়ে জ্বলন্ত মৃতদেহের অঙ্গ একত্রীভূত করতে
লাগল। আজ রাতে মৃতের মাংস উদরসাৎ করবে ওরা। শিবের উপাসক ওদের কাছে মৃত মানুষের মাংস
এবং অন্যান্য খাবারে কোনও তফাৎ নেই।
অঘোরী সাধুদ্বয়কে
নিজেদের কাজে লিপ্ত থাকতে দেখে আমিও ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে এসে একটা
ছাউনির মতো জায়গার মধ্যে দেহটাকে এলিয়ে দিলাম। মাথাটা ভার ভার লাগছে। আমি বেনারসে
ঠিক কি করতে এসেছিলাম?
চিকিৎসা চলাকালীন
একটা সেশনে সাইকায়াট্রিস্ট বলেছিলেন, আমার একটা সত্ত্বা জীবনের অন্ধকার দিকটাকে
চায়, সর্বদা সেটাই খোঁজে। সে জীবনবিমুখ। আলো ঝলমলে জীবন্ত পৃথিবীর কোনও কিছুই সে
বরদাস্ত করতে পারেনা। তার ডান চোখের তারা সবুজ। জীবনের সমস্ত সুখকে মুছে ফেলাই তার
লক্ষ্য। আমার অন্য সত্ত্বাটি প্রেমিক। সে জীবনের প্রতিটি দুঃখের মধ্যে প্রেম ও
জীবনের গান খুঁজে নিতে পারে। তার বাম চোখের তারা নীল। সেখান থেকে ঝলকে পড়ে খুশি আর
আনন্দের ফোয়ারা।
আফশোস হল, এই দুই সত্ত্বা একে অপরের
সাথে কথা বলেনা।
সকালের
রৌদ্রোজ্জ্বল আলোয় আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম বারাণসীর এক সংকীর্ণ গলিতে। আমার পেছনে
পঞ্চাশ গজ দূরে ঘাটে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। বামদিকে পেছনে উঁচু বাড়িটার গায়ে ছোট্ট
একটা শ্বেতপাথরে খোদাই করে লেখা ‘বৃজরামা প্যালেস।’ এটা দ্বারভাঙ্গা ঘাটে আসার
রাস্তা।
এগিয়ে চলতে গিয়েও থেমে গেলাম। একটা
ঝটপটানির শব্দ আসছে কোথাও থেকে। ঘাড় তুলতে প্যালেসের দোতলার দিকে নজর চলে গেল। দোতলার
ঘরগুলোর পেছনের দিকের একটা জানালা খোলা। লম্বা একটা গাছ উঠে গেছে জানালার পাশ
দিয়ে, আর সেই গাছেরই একটা ডাল জানালার মধ্যে দিয়ে প্রায় ঘরের অন্দরে প্রবেশ করেছে।
আর সেই ডালেই
ফাঁসিতে ঝুলে আছে একটা পায়রা। শক্ত নাইলনের একটা দড়িতে অদ্ভুতভাবে কোনোরকমে গলার
ফাঁসে জড়িয়ে পড়েছিল হয়তো। মিনিট দুই-তিনেক ডানা ঝাপটানোর পর শব্দটা থেমে আসে। পাখির
চোখ এখন বন্ধ। মাথাটা সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে। নিঃশব্দ গঙ্গার ঘাটে নিঃসঙ্গ একটা
মৃত্যু।
মাঝে মাঝে ভাবি, মৃত্যুই জীবনের একমাত্র
সত্য। বাকি যা কিছু আছে – ভালোবাসা, হাসি, সম্পর্ক... সব কিছুই মিথ্যে। একটা বিশাল
বড় প্রতারণা। একটা গাছের ছবি মাথার মধ্যে হঠাৎ করে ঘুরপাক খেয়ে গেল। উঁচু, ঝাঁকড়া
গাছ। হলুদ হলুদ ফুল। কাঠচাঁপা।
জানিনা এই স্মৃতিটা
আমার কোন সত্ত্বার। জানিনা আমি বারাণসী কেন এসেছিলাম। জানিনা এই টুকরো টুকরো
স্মৃতিগুলো কি বলার চেষ্টা করে। আমার অন্য সত্ত্বার সাথে যদি কোনওভাবে যোগাযোগ করা
যেত...
রাতের খাবারটা স্টেশনেই সেরে নিয়ে
পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের ধারে একটা খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে পড়লাম। এখন
সাড়ে ন’টা। ট্রেন প্রায় তিন ঘন্টা লেট। হিমগিরি এক্সপ্রেসের কোনও একটা বগিতে আগুন
লেগে বিভ্রাট। কামরাকে বিচ্ছিন্ন করে মেরামতির কাজ শেষ করে ট্রেন রওনা দিয়েছে।
মাথার ভেতরটা ধক
ধক করছে। হালকা যন্ত্রণা। একটা কাঠচাঁপা গাছের ছবি বার বার স্মৃতিতে ফিরে আসছে। আমি
জানি ওই স্মৃতি আমার নিজের নয়। অন্ততঃ আমার এই সত্ত্বার তো নয়ই। মাঝে মাঝে মনে হয়,
যদি অন্যান্য সত্ত্বাগুলোর সাথে দেখা হত, সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারতাম, ভালো হত।
চেষ্টা যে একদম করিনি, তা নয়। কিন্তু আমার অন্যান্য সত্ত্বা যারা, তারা তো আমার
মধ্যেই। কথা বলে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। এ যেন অন্ধকার একটা স্টেজের ওপর
একাধিক চরিত্রের সমাগম। যখন যার ওপর আলো একমাত্র তখনই সে দৃশ্যমান। কিন্তু তার কথা
স্টেজের ওপর উপস্থিত বাকিরা কেউ শুনবে না। আঁধারে বিলীন হয়ে থাকবে। যতক্ষণ আমার
ওপর আলো, অন্য সত্ত্বাদের সাথে আলাপচারিতার সম্ভাবনা নেই।
অন্য উপায় অবশ্য আছে। কিন্তু তাতে কি
সেই অন্য সত্ত্বা সাড়া দেবে?
মাথার মধ্যে
কাঠচাঁপা গাছটার ছবি আবার একবার ঘুরপাক খেয়ে গেল। এর বিরাম নেই। যতক্ষণ না অন্য‘জন’
দেখা দিচ্ছেন, এ জিনিষ চলবে। মন খারাপ হয়ে গেল। হয়তো এই স্মৃতির মালিক আমার যে
আমি, সে কষ্টে আছে, দুঃখে আছে। হয়তো এই স্মৃতি তার জন্য খারাপ কোনও অভিজ্ঞতার ভাষা
বয়ে নিয়ে বেড়ায়।
অথবা
হয়তো এই স্মৃতি কোনও সংকেত। হারিয়ে যাওয়া কোনও পাজলের শেষ অংশ।
ব্যাগ থেকে একটা
কলম বের করে আনলাম। এই ধাঁধার হাত থেকে নিজেকে বের করার একমাত্র উপায়। যে স্মৃতি
আমার নয়, আমাকে তা ফিরিয়ে দিতে হবে সেই স্মৃতির আসল মালিকের কাছে। হাতনোটের
মাধ্যমে। কোনও না কোনও সময়ে নিশ্চয়ই চিরকুট হাতে পাবে সেই ‘আমি’। হয়তো এই সংকেতের
মানে বুঝে উঠবে। আজ না পারলেও, হয়তো কোনো একদিন বুঝবে।
কলমটা পুনরায় যখন
ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলাম, তখন আমার সামনের চারভাঁজ করা চিরকুটটায় আমারই হাতে
লেখা আমার মধ্যেকার অন্য আরেক সত্ত্বার জন্য চারটে শব্দের ছোট্ট একটা বার্তা
জ্বলজ্বল করে ফুটে রয়েছে ---
“কাঠচাঁপারা এখনও
উত্তর দেয় ।।”