বেগুনী রঙের ব্যাগটা
কাঁধে ঝুলিয়ে গোলপার্ক লাইব্রেরী থেকে মেয়েটা যখন বেরিয়ে এল, তখন সন্ধ্যের
অন্ধকারকে ছাপিয়ে শহরের সমস্ত বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। এই সময়ে সাদার্ন এভিনিউর দিকে
যাওয়ার অটোগুলো যে কোথায় হারিয়ে যায়! একটু দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা যায় অবশ্য। বাস
পেয়ে গেলে রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের কাছে নেমে গিয়ে মেনকা অবধি হেঁটে চলে যাওয়া।
ব্যাগের মধ্যে টুং টাং দুটো শব্দ
বেজেই বন্ধ হয়ে গেল। মোবাইলে মেসেজ। ইন্সটির নিউরোসাইন্সের ছেলেটা আবার ডিস্টার্ব
করা শুরু করেছে। আজকের দিনটার কথা মনে পড়ে গেল ওর।
ওর পেছনে ঢাকুরিয়া লেক থেকে দলে দলে
যুবক যুবতীরা বেরিয়ে এসে লাইব্রেরীর সামনে দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকে চলে
যাচ্ছে। হাতে হাত, হাসির উত্তরে মুচকি হাসি, কারোর বা একটা হাত অন্যজনের কাঁধের
ওপর আলগোছে ফেলা।
এই পৃথিবীতে
ভালোবাসা বলে সত্যিই কি কিছু আছে?
“কিছু ভিক্ষা,
মা। বড়ই ক্ষুধা লাগসে...।”
এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে। বামহাতে
একটা লাঠি। ডান বগলে ছোটো একটা থলি। ডান হাতটা প্রসারিত, থিরথির করে কাঁপছে। অশীতিপর,
পরণের কাপড়খানি ময়লা। কোটরাগত দুই চোখের মধ্যে শ্রান্ত এক দৃষ্টি।
মেয়েটা শুনেছে,
কলকাতার বুকে বেশ কিছু চক্র কাজ করে – বৃদ্ধ, বাচ্চাদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির কাজ
করিয়ে মোটা টাকা রোজকারের ব্যাবসা। ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’ সিনেমাটায় এরকম একটা গল্প
ছিল। ইন ফ্যাক্ট, স্বয়ং সত্যজিৎ রায় ওনার একটা গল্পে লিখেছেন, ‘কলকাতার মানুষ
ধাপ্পা দিয়ে টাকা রোজগারের হাজার ফিকির জানে।’
মাঝে মাঝে কেন যেন ওর মনে হয়,
ছোটোবেলার বারাণসীর দিনগুলোই ভালো ছিল। গঙ্গার ঘাটের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ছোট্ট ঢেউগুলোর
সিঁড়িগুলোতে আছড়ে পড়ার আওয়াজটা মনে পড়ে গেল।
প্রসারিত হাতটা
নেমে গেছে সামনে থেকে। ভিক্ষুণীর আত্মসম্মান নতমস্তকে তাকে টলোমলো পায়ে টেনে নিয়ে
চলেছে সন্ধ্যের অন্ধকারের দিকে।
“ঠাকুমা, এক
মিনিট।” একটা চাপা অথচ ভরাট কন্ঠের আওয়াজ ভেসে এল পেছন থেকে।
বৃদ্ধার পদচারণা বন্ধ হয়েছে। মেয়েটাও
ঘুরে দাঁড়াল পেছন দিকে।
লাইব্রেরীর
সংলগ্ন ফুটপাথে সার দিয়ে বসে থাকা তিন চারজন ভিক্ষুকের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসা
এক ভদ্রলোক। হাতের একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে একটা করে কোয়ার্টার পাউন্ড পাউরুটি
বের করে বিতরণ করছে এক একজনকে। মুখটা ওর দিক থেকে উল্টোদিকে ফেরানো। বৃদ্ধা লাঠির
ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে ব্যাগ থেকে শেষ পাউরুটির টুকরোটা বের করে তার হাতে ধরিয়ে ভরাট
কন্ঠের মালিক বলল, “এই নিন, ঠাকুমা। আর এই রাখুন পাঁচটা টাকা। রুটিটা চায়ের সাথে
খাবেন।”
বৃদ্ধা জড়ানো
গলায় একগুচ্ছ আশীর্বাদ করতে করতে সরে গেল ওদের মাঝখান থেকে। আর তখনই ত্রিফলা নিয়ন
আলোটার ছটা এসে পড়ল ভদ্রলোকের মুখের ওপর।
আরে! ইনি...মানে,
এটা সেই ছেলেটা না?
আলোটা দুজনের মুখের ওপরই এসে পড়েছে। সাত-আট ফুটের ব্যাবধানে
দাঁড়িয়ে থেকে দুজনেরই চোখের দৃষ্টি পড়েছে একে অপরের ওপর।
“হাই!” মেয়েটা চাপা
গলায় বলে উঠল।
ওদের দুজনের
মাঝখানে ফুটপাথটার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে একদল তরুণ-তরুণী। একটা হাসির রোল উঠল। এত
আনন্দ, এত সুখ!
মানুষ কি সত্যিই
এত ভালো আছে?
ভীড়টা চলে যেতে
ছেলেটা এগিয়ে এল, দ্রুতপায়ে। শেষ দুটো পা একরকম দৌড়েই বলা যায়।
“হ্যালো!”
ছেলেটার গরম নিঃশ্বাস ওর কপালে পড়ল। অনেক লম্বা হয়ে গেছে ও। মাঝখানে কতদিন হবে!
এগারো-বারো বছর?
“কেমন আছিস?” মৃদু
হাসার চেষ্টা করে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল।
চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল মেয়েটা। ছেলেটা
হাসার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু চোখগুলো যেন কি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। একটা অবহেলা,
বঞ্চনার ছাপ স্পষ্ট। মেয়েটার খারাপ লাগল। এতদিন কথা না বলে থাকাটা বোধহয় উচিত
হয়নি।
“ঠিকঠাক...”
মেয়েটা হেসে বলল। “রিসার্চ করছি। নিউরোসাইন্সে পি.এইচ.ডি.”
ছেলেটা
একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে।
“এসব কি?” মেয়েটা
চোখ দিয়ে ফুটপাথে বসে থাকা লোকগুলোকে ইশারা করে দেখিয়ে অবাক হওয়ার ভান করল।
ছেলেটা ইতস্ততঃ
করছে। জীবনের এই দিকটার ব্যাপারে ও কথা বলতে চায়না নিশ্চয়ই। মেয়েটা লক্ষ্য করেছে,
কিছু কিছু মানুষের স্বভাবের কোনও গোপন দিক এক্সপোজ হয়ে গেলে, তারা ইতস্ততঃ করে,
উত্তর খুঁজে পায়না। তা সেটা যত ভালো স্বভাবই হোক না কেন।
“সাহায্য।” ছেলেটা
কয়েক সেকেন্ড পর বলে উঠল।
মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে,
একদৃষ্টে। ছেলেটার চোখ মাটিতে। হাতের আঙ্গুলগুলো জিনসের সামনের পকেটের মধ্যে
ঢোকানো। ছেলেটা বরাবরই দুখী দুখী, একা টাইপের। এই বারো বছরে এক বারও যে ওদের দেখা
হয়নি, তা নয়। একবার পুজোয়, পঞ্চমীর দিন। মেয়েটার সঙ্গে একজন ছিল। ছেলেটা কিন্তু
সেদিনও একাই ছিল। দেখা হতে মেয়েটা জিজ্ঞেস করেছিল, “আরে, তুই এখানে! একা কেন?”
ছেলেটা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে
ছিল খানিকক্ষণ। তারপর একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলেছিল, “হ্যাঁ। আমি... একাই।”
কি চুপচাপ রে
বাবা! মেয়েটা তারপর থেকে আর পাত্তা দেয়নি। এক শ্রেণীর লোক আছে যারা নিজেরাই নিজেদের
অহংকারে থাকে, কারোর সাথে সেভাবে মেলামেশা করতে চায়না। বা হয়তো নিজের ছেলে
বন্ধুদের সাথে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করবে, মেয়ে বন্ধুরা কথা বললেই চুপ করে যাবে। ডাবল
স্ট্যান্ডার্ড!
“তা... কি করছিস
এখন?” মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
“এই টুকটাক।
লেখালেখি। আই অলসো ট্রাভেল আ লট, সো...।”
লেখালেখি। বাহ! পুরোনো হবিটা ছাড়েনি
তাহলে। সেই শুরুর দিনগুলোর কথা হবে। ও লেখালেখি করে শুনে ওর লেখা পড়তে চেয়েছিল
মেয়েটা। ছেলেটা দেয়নি। কারণটা জানতে পারেনি অবশ্য ও। শুধু মনে হয়েছিল, আশ্চর্য্য
অহংকারী তো!
“শুধু লেখাই?
মানে...”
“আই ডু হ্যাভ আ
জব, ইফ দ্যাটস হোয়াট ইউ আর ওয়ান্ডারিং এবাউট। বাট দ্যাট ডাজন’ট হ্যাভ মাচ
ইম্পর্ট্যান্স টু মি। মানি ইন দিস ওয়ার্ল্ড ইজ অফ লিটল ভ্যাল্যু উইদাউট হ্যাপিনেস।”
ছেলেটা এক নিশ্বাসে বলে থামল।
পুরো দার্শনিকের মত কথা। ছেলেটা
এতকিছু ভাবে, নাকি?
“আমি তোর সাথে...
আই ট্রায়েড টু কন্ট্যাক্ট ইউ। বাট ইট ওয়াজ নট পসিবল।”
মেয়েটা জানে। ছেলেটা
চেষ্টা করেছিল যোগাযোগ করার। একবার নয়, বারবার। ও ইচ্ছে করেই একসেপ্ট করেনি
ছেলেটার রিকোয়েস্ট, ফেসবুকে। পরিবর্তে একটা মেসেজ পোস্ট করেছিল শুধু, ‘দোজ, হু
ডোন্ট নো মি, ডোন্ট ওয়েস্ট ইয়োর টাইম এজ ওয়েল এজ মাইন সেন্ডিং ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টস
টু মি।’ হ্যাঁ, তবে তার মানে এই নয়, যে ফেসবুকে যতজন ওর বন্ধু আছে তারা সবাই ওকে
ভালোভাবে চেনে, জানে। তবে ছেলেটার ক্ষেত্রে, ও চায়নি এমন একজনকে একসেপ্ট করতে, যে
ওর অতীত সম্পর্কে জানেনা। একেই কি বলে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড? হবে হয়ত। ও জানত যে
ছেলেটার ওকে ভালো লাগে। কিন্তু একজনকে ঠিকমতো না জেনে, চিনে, তাকে ভালো লাগার কোনও
অর্থ হয়না। ওর বারাণসীর কানেকশনটা...
“আই ভিজিটেড দ্য
প্লেস, ইউ নো। টোয়াইস।”
মেয়েটা চমকে ওর চোখের দিকে তাকাল। ছেলেটার
মুখে একটা প্রশান্ত হাসি। এত কোমলতা।
“বারাণসী। এত
অসাধারণ একটা জায়গা!”
ছেলেটা কি ওর মনের কথাগুলো পড়ে ফেলল
নাকি?
আজব। অদ্ভুত
ব্যাপার। ছেলেটা ওর ব্যাপারে এত কিছু জানল কি করে? হাউ ক্যুড হি নো এবাউট দ্যাট
প্লেস? তার মানে বারো বছর ধরে কি ও শুধু ওকেই...?
“এনিওয়ে। ইউ
মাস্ট বি গেটিং লেট। আজ চলি।” ছেলেটা ধীর পায়ে অগ্রসর হল।
“এক মিনিট!”
মেয়েটা দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে এসে ছেলেটার সামনে এসে দাঁড়াল।
“মাঝে মাঝে, কিছু
মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ালেও লাভ হয়না। তারা নিজেরাই এসে আমাদের কাছে ধরা দেয়।”
মেয়েটার কপট বকুনির ফাঁকে ছেলেটার স্থির দৃষ্টি ওর দিকে নিবদ্ধ।
“লেটস ওয়াক ব্যাক
হোম। উই হ্যাভ লোডস টু টক এবাউট।” মেয়েটা বলল।
“এন্ড বাই দ্য
ওয়ে, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে!”
বারো বছর ধরে
ছেলেটা ওকে নিঃশর্ত ভালোবেসে এসেছে।
আর
আজ থেকে মেয়েটাও।।