Monday, March 13, 2017

সেই বাড়িটা

বাড়িটা একতলা হলেও বিশাল বড়। সবশুদ্ধ ঘর মোট ছ’টা। তার মধ্যে একটা প্রকান্ড হলঘর, একটা আমাদের শোবার ঘর, আরেকটা ভাঁড়ার ঘর। একটা ঘর সবসময়ে তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করা। এ ছাড়া বাড়িতে ঢুকতেই একটা ছোটোমত ঘর। ওটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। তার পাশেরটাও তাই।

গোটা বাড়িটাই কেমন স্যাঁতসেঁতে, বদ্ধ। আমার নতুন স্কুলে ভর্তি হতে এখনও দিন পনেরো বাকি, তাই বাবা অফিসে চলে গেলে একটা রাবারের বল হাতে নিয়ে এঘর ওঘর করি। একদিন খেলতে খেলতে বলটা জানলা টপকে ওপাশের জমিটায় চলে গেল। আমি এক ছুটে মায়ের কাছে।

“মা। বলটা ওপাশের জমিতে পড়ে গেছে।”

“ইস। ওপাশে না জঙ্গল। একটা বল গেছে যাক। কিন্তু ওদিকে কক্ষণও যাবি না।”

“গেলে কি হয় মা?”

“নতুন শহর তো? যদি হারিয়ে যাস?”


              আমি সারাদিন বাড়িটার এপাশ ওপাশ ঘুরে বেড়াই। ছবি এঁকে আর খেলনা বন্দুক নিয়ে ঘরাঘুরি করে হতাশ হয়ে পড়ি এক সময়ে।

“মা, দিদি কেন এল না আমাদের সাথে?”

“কি করবি বল? দিদি স্কুল ছেড়ে আসতে চাইল না তো। তাই ঠাকুমা দাদুর কাছে রেখে আসতে হল।”

“আমি দিদির কাছেই ফিরে যাব, মা।”

“এরকম বলে না। জানিস তো বাবার ট্রান্সফারের চাকরি।”

“ছোটোকাকা, বড়কাকা – ওরা তো ট্রান্সফার নেয়নি। বাবা কেন নিল মা?”

“তুই একটা বছর কষ্ট করে নে। তোর ক্লাস থ্রির পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই আবার আমরা ফিরে যাব এখান থেকে। দেখিস।”


গোটা বাড়িটা অসম্ভব ভেজা ভেজা। ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে। মাঝে মাঝেই দেখি দেওয়ালগুলো বেয়ে কেন্নো উঠছে। ওপাশের জমিটার একদিকে বেগুনের ক্ষেত আছে। গোটা বাড়িটাই যেন কি অন্ধকার। কি নিশ্চুপ!

          এর মাঝেই ঘরের মধ্যে খেলতে গিয়ে আমার আরও কয়েকটা বল ওপাশের জমিটায় চলে গিয়েছে। একা একা ওদিকে যাওয়ার সাহস হয়নি আমার। একটা ছোট্ট নর্দমা আর গলি ওপাশের জমিটার পাশ দিয়ে এসে আমাদের বাড়ির নালাটায় মিশেছে। যদি কোনও চোর ওই নর্দমা ধরে ধরে এসে আমাদের বাড়িটায় ঢুকে পড়ে?

মা শুনে হেসে বললেন, ‘ধুৎ!’
    

              এখানে এসে অবধি আমার কারোর সাথে বন্ধুত্ব হয়নি। এই পাড়ায় আমার বয়সী কোনও বাচ্চাকেও দেখিনি। আমি আর সাতদিন পরেই এখানে স্কুলে ভর্তি হয়ে যাব। ক্লাস থ্রি-তে। গত মাসেই আমার সাত নম্বর জন্মদিন গেছে। তখনও আমরা এ শহরে আসিনি।

              একটা ছোটো টিনের চেয়ারের ওপর একটা গোলমতন কেক রেখে, আর তার ওপর একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিদি বলেছিল, ‘এবার ফুঁ দে।’ আর মোমবাতি নিভে যাওয়ার পর একটা প্লেটে করে আমরা সেই কেক খেলাম। চকোলেট ক্রীমটা দারুন ছিল। দিদি ছাড়া আমার জন্মদিন পালনই হত না। মাঝে মাঝে দিদির জন্য দুঃখে কাঁদি। কেন ও এলনা আমাদের সাথে?


বাড়ির যে মালিক তিনি আমার দাদুর বয়সী। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই, পেছনের অংশটায় থাকেন, ওনার স্ত্রীর সাথে। আমরা একটা ছুটির দিনে বিকেলে গল্পগুজব করতে গেলাম। ভদ্রলোকের স্ত্রী, আমার দিদার বয়সী এক মহিলা আমাকে একটা লজেন্স দিলেন খেতে। সবাই কথা বলছে আর আমি চারিদিক দেখছি। ঘরে কত মুখোশ। রাক্ষসের, পেঁচার, হাতির, বাঘ-ভাল্লুক, জোকার... আরও কত কি!

দিদার বয়সী ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, “আমাদের দুজনেরই পায়ে অসুখ। হাঁটাচলা করতে পারিনা।”

              আমরা উঠে পড়লাম। খোলা দরজা দিয়ে আমরা বেরিয়ে চলে আসছি আর আমি বারবার পেছনে দেখছি কে উঠে দরজা বন্ধ করে। খোলা দরজার সোজাসুজি ভদ্রমহিলা বসে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। চোখের পলক পড়ছে না একবারও। আমরা অনেকটা এগিয়ে চলে আসার পরেও পেছনে ফিরে দেখলাম দরজাটা খোলাই রয়ে গেছে।

ভদ্রমহিলার চোখের দৃষ্টি ঠিক যেন মরা মাছের মত।


এই বাড়িটা আমার একদম ভালো লাগছে না। বাবা সকালবেলা অফিসে বেরিয়ে যান। সারা দিন একা বাড়িতে মা আর আমি। মায়ের কত কাজ। আমি শুধু এঘর আর ওঘর।

              তারপর স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেখানে একজন বন্ধুও হয়ে গেল। সন্দীপ। আমরা স্কুলের টিফিন টাইমে একসাথে স্কুলের সামনের মাঠটায় হেঁটে বেড়াই।

“তোদের বাড়িটা কোথায় বলতো?” সন্দীপ জিজ্ঞেস করে।

“পাড়াটার নাম জানিনা। তবে আমাদের বাড়িটা থেকে আরেকটু এগিয়ে গেলে ‘দারিয়া’ বলে একটা জায়গা আছে। বাবার কাছে শুনেছি।”

“ও। তার মানে শ্মশানের কাছেই।”


          পরের রবিবার আমরা একটা সিনেমা দেখতে গেলাম। সিনেমা দেখে ফিরে এসে দেখা গেল ঘরের সবকটা আলো খারাপ হয়ে গেছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রত্যেক ঘরে একটা করে রেখে দেওয়া হল। তাড়াতাড়ি রান্না-খাওয়া করে আমরা শুয়ে পড়লাম।

মাঝরাতের দিকে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। বাইরে রাস্তায় কাদের যেন পায়ের আওয়াজ। উচ্চকন্ঠে কারা ডেকে উঠছে, ‘বল হরি, হরি বোল...’

              আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকি। আন্ধকার রাত যেন আর শেষ হওয়ার নয়।
সকালের আলোতে রাতের কথাগুলোকে দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলেই গোটা বাড়িটায় যেন কালো একটা ছায়া নেমে আসে।


পরেরদিন রাতে পরপর চারবার সামনের রাস্তায় পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। আর তার সাথে চাপা গলায়, ‘বল হরি...’। আমি মাকে কোনওমতে জড়িয়ে শুয়ে আছি। মা আমাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য আমার কপালের ওপর ধীরে ধীরে চাপড়ে দেয়।

              শেষ রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি। সমস্ত গা ঘামে ভিজে গেছে। চমকে জেগে উঠে দেখি বাবা ঘুম থেকে উঠে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে।




সেদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে বললেন, “আমি ঠিক করে নিয়েছি। সামনের রবিবার আমরা বাসা বদলাবো। সুশান্ত সরণীর একটা তিনতলা ঘরে ভাড়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সৌম্যর স্কুলের কাছেও হবে। আর ওর বন্ধু সন্দীপের বাড়িও ওখান থেকে কাছেই। পাশেই একটা রামকৃষ্ণ মিশন আছে। কোনও অসুবিধে হবে না। তোমরা গোছগাছ শুরু করো ।।”