ভূতের গল্প ।।
কুনি ও বুনির কথা তোমরা জাননা। কুনি আর বুনি হল
পেত্নী। দুজনে একে অপরের বোন হলেও কুনি থাকে ঘরের কোণে, আর বুনি থাকে বনে, মানে
জঙ্গলে।
তা সে অনেকদিন আগের কথা। গ্রামের এক প্রান্তে
এক জঙ্গলের ধারে ঘর বেঁধে থাকত এক কাঠুরিয়া আর তার বৌ। কাঠুরিয়া জঙ্গল থেকে কাঠ
কেটে আনত আর সপ্তাহের শেষে শহরে আসত কাঠ বিক্রী করতে। এইভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল।
একদিন কাঠুরিয়া গেছে জঙ্গলে। কাজ শেষ করে ফিরতে
দেরী হয়ে গেছে, সূর্য গেছে অস্তাচলে। এমন সময়ে বনের অন্ধকার কোণ থেকে সে শুনতে পেল
কার যেন গলার আওয়াজ। বোঝা গেল আওয়াজ এক মেয়েমানুষের এবং সে আওয়াজ ক্রমশঃ তার দিকেই
এগিয়ে আসছে। মুহুর্তের মধ্যে সে দেখল জঙ্গলের অন্ধকার ভেদ করে এলোচুলে এক নারী
অবয়ব এক গাল হাসি হেসে তার দিকে উর্দ্ধশ্বাসে ধেয়ে আসছে আর নাকী গলায় বলছে, “কুঁনিকে
বোলো বুঁনির মেয়ে হয়েছে... কুঁনিকে বোলো বুঁনির মেয়ে হয়েছে।”
কাঠুরিয়া প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে পালায়।
ঘরে ফিরে তার যেন ধড়ে প্রাণ আসে। কাঠুরিয়ার বৌ তো মহা অবাক। “কি হলো, কি হলো?”
এক মগ জল কোনও রকমে গলাধঃকরণ করে পুরো ঘটনার
বিবরণ দেয় কাঠুরিয়া। উত্তেজনায় তার সর্বাঙ্গের রোম খাড়া হয়ে উঠেছে।
ঠিক এই সময়ে ঘরের কোণের অন্ধকার থেকে এক ঝাঁকড়া
চুলওয়ালা ধিঙ্গী মেয়ে বেরিয়ে এসে নাচতে নাচতে জঙ্গলের দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়... পেছন
থেকে শোনা যায় নাকী সুরে তার হাসি হাসি গলার আওয়াজ, “কয় দিবসে? কয় দিবসে?”
এই গল্প অবশ্য আমার নয়। আজ থেকে প্রায়
বিশ-পঁচিশ বছর আগে কোনও এক গল্পের বইতে পড়া। আসলে ভূত মানেই তো অতীত। মানে ঘটে
যাওয়া সময়ের কথা। তাই আমাদের জীবনের পুরোনো কোনও কথার স্মৃতিচারণ হল আসলে ভূতেরই
গল্প।
ধরে নাও খুব পুরোনো এক শহরে একটা মাঠ ছিল। আসলে
মাঠ তো আর শুরু থেকে ছিল না। সেও অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন জায়গাটা
একটা গ্রাম। আর মাঠের জায়গাটায় তখন ছিল জঙ্গল। নিম, সুপুরি, আশুত, কাঁঠাল, বটের ঘন
জঙ্গল। সেই জায়গা দিয়ে দিনের বেলাতেই লোকে যাতায়াত করার সাহস পেত না। তারপর
ইংরেজদের সময়ে গ্রামটার কিছু কিছু বসতি বাড়ল। রাস্তাঘাট তৈরী হল। স্কুল, হাসপাতাল
গড়ে উঠল। জঙ্গলটার একধারে মাটির রাস্তা বানালো ইংরেজরা। আর তার পাশেই একটা স্কুল।
তারপর দু’শ – আড়াইশ’ বছর পেরিয়ে গেল। ভারতীয়রা
বিদ্রোহ শুরু করেছে বিদেশী শাসকের বিরূদ্ধে। ইংরেজরা যখন যাকে পারছে ধরে জেলে পুরে
দিচ্ছে। এই জঙ্গলটারই একপাশে তারা তৈরী করল একটা জেলখানা।
তারও অনেক দিন পর দেশ স্বাধীন হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে গ্রামটা শহরে পরিণত হয়েছে। সেই
স্কুলেরও সংলগ্ন গড়ে উঠেছে কলেজ। রাস্তাঘাট উন্নত হচ্ছে ধীরে ধীরে। তা শহরের
মাঝখানে এমন জঙ্গল তো আর বেশীদিন রাখা যায় না। স্থানীয় জেলা পর্ষদের উদ্যোগে তাই জঙ্গলের
সব গাছ কেটে ফেলা হল। এমন সুন্দর একটা ছায়াঘন জঙ্গল, গাছপালা দুদিনে বেবাক ফাঁকা
হয়ে গেল। জায়গাটাকে করে দেওয়া হল পাশেরই নতুন গড়ে ওঠা কলেজের খেলার মাঠ।
এখন সারা শহরের ছেলেরা সকাল-বিকেল সেই মাঠেই
খেলাধূলা করে। বয়স্করা বিকেলে হাঁটাহাঁটি করেন। সন্ধ্যের পর ছেলেমেয়েরা
বন্ধুবান্ধবের সাথে মাঠেই বসে আড্ডা মারে। সেই পুরোনো জেলখানাটাও রয়ে গেছে।
ভাঙ্গাচোরা, পোড়ো। অনেকে বলে আজও নাকি সেখান থেকে নানান ধরণের অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়।
এটাও তো একটা ভূতেরই গল্প, কি বলো? এতো পুরোনো
একটা জঙ্গল তো আজকের সেই কলেজের মাঠের ভূত হয়েই রয়ে গেল।
চুপি চুপি বলে রাখি, এই মাঠ কিন্তু আমার
স্বচক্ষে দেখা।
আসলে যখল ছোটো ছিলাম, তখন আজকের দিনের মতন
মোবাইল, টিভির যুগ ছিল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বাস্তবিকপক্ষেই আকাশপাতাল চিন্তা
করার সময় ছিল। আকাশে ভেসে ভেসে চলে যেত মেঘ, আর দূরে কোনো একটা ঘুড়ি বা উড়ন্ত কোনও
চিলের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় মন ওই মেঘগুলোর মতোই ভেসে অন্য কোনও দুনিয়ায় চলে যেত। কল্পনাপ্রবণ
হওয়ার জন্য চিন্তাভাবনাগুলোকে ঘুড়ির মতন ছেড়ে দিতে হয়। লাটাই থেকে বেরোনো সুতোর
হালকা টানে ভর করে যাতে তারা ভেসে যেতে পারে অলীক কোনও রাজ্যে। যখন ছোটো ছিলাম,
সময়ের কোনও অভাব ছিল না। ছিল আকাশ দেখা, দুপুরবেলা বাগানে ঘোরাঘুরি, ঘুড়ির খেলা
দেখা, পড়ন্ত দুপুরের শেষে পাড়ার এক কোণা থেকে আইসক্রীমওয়ালার ডাক।
তারপর এল প্রযুক্তির যুগ। বাচ্চা থেকে বুড়ো,
সবার হাতে এলো প্রযুক্তি। সময়ের বড্ড অভাব। মাঝখান থেকে মারা পড়ল কল্পনার দেশে
ভেসে চলে যেতে চাওয়া কয়েকটা সুপ্ত ইচ্ছে। অতীত হয়ে গেল।
আর সেটাও তো একটা ভূতেরই গল্প।।