“সে আজ থেকে অনেক অনেক দিন আগের কথা...।। ”
আসর জমিয়ে বসেছে গল্পবুড়ো। আর তার চারপাশে তাকে ঘিরে রয়েছে নাতি-নাতনীরা।
এরা অবশ্য তার নিজস্ব নাতি-নাতনী নয়। বুড়োর এই সংসারে কেউ নেই। তাই প্রতি রবিবার
কাঁধে ঝুলি ফেলে লাঠি ঠুক্ঠুক্ করতে করতে সে নিজের বাড়ি থেকে দু’ ক্রোশ রাস্তা
হেঁটে এই গ্রামের রায়বাড়ি চলে আসে। নবীন এবাড়িরই ছেলে, আট-দশ বছর বয়েস। তার দুই
বোনও বুড়োর খুব ন্যাওটা। আর ফি রবিবার বুড়ো দাদুর গল্প শোনার জন্য নবীনের বন্ধুরাও
সেখানে জড়ো হয়ে যায়। কানাই, সুভাষ, বিকু, মানিক ইত্যাদি। এরা সবাই গ্রামের মাঠে
একসাথে খেলা-টেলা করে।
প্রতি
রবিবার রায়বাড়ির সামনে ঠাকুরদালানে বসে গল্পের আসর। সনাতন রায় – নবীনের প্রপিতামহ একসময়ে
জমিদার ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারী প্রথা আস্তে আস্তে উঠে গেল। জমি-জমা,
পুকুর ইত্যাদিগুলো ইজারা দেওয়া হলো গ্রামেরই কিছু কিছু লোককে। দুই তরফেরই সুবিধে।
গল্পের আসর উঠেছে জমে। আজ বুড়োর নাতি-নাতনীদের
জোরাজুরিতে তাকে শোনাতে হচ্ছে ভূতের গল্প। এরকম প্রতি সপ্তাহতেই রাজা-রানী,
ভূত-পেত্নী, কিনারা-না-হওয়া খুনের গল্প শোনাতে হয় বুড়োকে। কচিকাঁচারা দাবী করে,
বুড়ো নাকি তার ওই ঝোলাতেই তার গল্পগুলো ভরে নিয়ে চলাফেরা করে। বুড়ো আসলে ঠিক গ্রামের
মধ্যে থাকেনা। সে থাকে ক্রোশ দুয়েক দূরে। গ্রামের খেলার মাঠটা পেরিয়েই একটা
বাঁশজঙ্গল আর তার পাশেই শ্মশান। এই শ্মশান ঘেঁসেই চলে গেছে নদী। নদীর ওপরের পুরোনো
পুল ধরে হেঁটে পেরোলেই বুড়োর বাড়ি।
বুড়োর
গল্পে ভর করে বিষণ্ণ, একলা দুপুর আস্তে আস্তে গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসে। পশ্চিমের
আকাশের কালো একটা মেঘও ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসে। গল্পে পুরোপুরি ডুবে থাকা বক্তা বা
শ্রোতাদের অলক্ষ্যেই বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলে।
ঝড়-বৃষ্টির
জন্য সন্ধ্যে অবধি ঠাকুরদালানে আটকে পড়ল বুড়ো। তারপর টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই লাঠি
হাতে ঠুক্ঠুক্ করতে করতে বেরিয়ে পড়ল।
তোমরা যারা গ্রামে থাক বা কখনও থেকেছ তারা জানো যে বৃষ্টির পরে গ্রামের মাটির
রাস্তাঘাট আর চলাচলের যোগ্য থাকে না। বিশেষ করে সন্ধ্যের পর। এখানে সেখানে জমা জল,
পিচ্ছিল মাটির রাস্তা। তার ওপর সাপ-খোপ তো রয়েছেই।
বুড়ো লাঠিতে ভর করে সাবধানে
হেঁটে চলেছে, বাড়ির পথে। তার কাঁধে ভারী ঝোলা।
মাঠের
পাশ দিয়ে আসতে আসতে সে বুঝল ঝড়-বৃষ্টির জন্যই হোক বা অন্য কোনও কারনে, আজ গ্রামের
সবকটা আলো গেছে নিভে। সময়ের খেয়াল করেনি সে আগে। রাত হয়ে গেল না তো?
বাঁশজঙ্গলটা এসে পড়তেই ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজে জায়গাটা
ভরে গেল। অনেক, অনেকদিন আগে জায়গাটা নাকি একটা কবরখানা ছিল। সেই পরিত্যক্ত কবরখানার
ওপরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠল বাঁশগাছের জঙ্গল।
মাঝে
মাঝে বুড়োর এই বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়, ওপর থেকে কেউ যেন তাকে দেখছে।
সেটা যে কে বা কী, তা বুড়ো জানেনা। জানতে চায়ও না। সাদা চাদরের মতো কি যেন একটা
বাঁশবনের ওপর দিকটায় বসে থাকে।
বুড়ো ভীতু নয়। কিন্তু সে চায় না জানতে। তবে সে জানে, একদিন না একদিন তাকে
জানতে হবে।
বাঁশবনের উল্টোদিকটায় রয়েছে একটা পুকুর। কালো,
অন্ধকার জল তাতে কানায় কানায় ভর্তি। ওপরটায় পানা আর গাছের পাতা পড়ে পড়ে সবুজ হয়ে
থাকে। দূর থেকে এক ঝলক দেখলে একফালি সবুজ জমি বলে মনে হতে পারে। সেবার একটা ছ’-সাত
বছরের বাচ্চা তলিয়ে গিয়েছিল। আর পাওয়া যায়নি তাকে।
এই পুকুরে নাকি পানিমুড়া আছে।
পানিমুড়া একধরনের ভূত। সে জলের তলায় থাকে। স্নান করতে
নামা লোকজনকে পা ধরে নীচের দিকে টান দেয় সে। যতক্ষণ না মানুষটার দমবন্ধ হয়ে শরীর
থেকে প্রাণটা বেরিয়ে যায়। তারপর দুই পানিমুড়ায় মিলে মজা করে একসাথে থাকে। অনেক সময়ে
দেখবে বিশাল বিশাল পুকুরের মাঝে ভুস করে কিছু যেন ডুব দিল। গ্রামের লোকেরা বলবে, ওসব অনেক বড় বড় মাছ।
ওগুলো
আসলে পানিমুড়া।
দূরে, শ্মশানের শেষ প্রান্ত থেকে একদল শেয়াল ডেকে
উঠল। টিপটিপ বৃষ্টিটা থেমে গেছে। ভেজা ঘাসে চটির মসমস আওয়াজ শুধু। চটিটা খুলে রেখে
বুড়ো পুকুরপাড়ে এসে খানিক বসল।
তার ভয় নেই। তাকে নেওয়ার মত কেউ নেই যে। না ওই বাঁশবনে,
না এই পুকুরে, না ওই শ্মশানে। বয়সের তার আর গাছপাথর নেই।
ঝুলিটাকে শক্ত করে আগলে ধরে রাখে সে। তার গল্পের ভাণ্ডার।
ঝুলিটাকে শক্ত করে আগলে ধরে রাখে সে। তার গল্পের ভাণ্ডার।
ওই
ঝুলি। এই লাঠি। এই তার সম্বল।
বুড়োর এই দুনিয়ায় কেউ নেই। সে একা। বড়ই একা সে ।
একটা হাওয়া দিল আচমকা। হাওয়াটা গ্রামের দিক থেকে উঠে
এসে বাঁশবনের মাঝখান দিয়ে সোঁ- সোঁ শব্দে ঘুরপাক খেয়ে আবার ফিরে গেল। ওপরের গাছগুলো
থেকে টুপটাপ অনেকগুলো পাতা খসে পড়ছে। কয়েকটা ওই কালো, আঁধার জলে আর কয়েকটা তার
আশেপাশে।
জঙ্গলের
মধ্যে কি যেন একটা মচমচ শব্দ করে খানিক এগিয়ে এসেও আবার উল্টোদিকে ঘুরে চলে গেল। শেয়াল-টেয়াল
নয়তো?
আবার
নিস্তব্ধতা। বুড়ো উঠে পড়ল।
ঠুকঠুক। ঠুকঠুক।
শ্মশানের পাশ দিয়ে যেতে তার যে একেবারে গা কাঁপে না
তা নয়। তবে এই শ্মশানটাও পরিত্যক্ত। নদীর এপাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে জায়গাটার অনেকটাই ডুবিয়ে
দিয়েছে। সেরকম ওপরটাও এগিয়ে এসেছে অনেকটা।
নদীর
ওপরের পুরোনো পুল ধরে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে সে। কী অন্ধকার আজ বাবা! চাঁদটাও
আজ আকাশে নেই কেন কে জানে? তারার আলোয় রাত্রে কতটুকুই বা দেখা যায়?
গ্রামের অনেকেই বলে, এই পুলের ওপর কেউ কেউ নাকি ভুলোর
খপ্পরে পড়েছে।
ভুলো
কুকুর বা মানুষ নয়। ভুলো হল মানুষের ভ্রম। ভুলো ভোলায়।
ধরো তুমে অন্ধকার রাতে একা পথ চলতে চলতে তোমার কোনও
বন্ধুর কথা ভাবছ। হঠাৎ দেখলে সে তোমার সামনে উপস্থিত। এই হচ্ছে ভুলো।তুমি বলে
উঠবে, “আরে তুই! তোর কথাই তো ভাবছিলাম।” সে বলবে, “হ্যাঁ রে, তাই তো এলাম। এবার
আয়।”
তারপর
তুমি দিকবিদিক জ্ঞানশুণ্য হয়ে সেই ভ্রমের পিছু পিছু হাঁটবে। আল,মাঠ-ঘাট, পথ বেয়ে দৌড়বে।
তারপর একসময়ে জ্ঞান ফিরে পেলে বুঝবে, হয়তো ঘন্টা দুই-তিন ধরে চার-পাঁচ ক্রোশ পথ পাড়ি
দিয়ে ফেলেছ।
জ্ঞান না ফিরে
পেলে অবশ্য অন্য ব্যাপার।
তবে বুড়ো এসব কোনওদিনই দেখেনি। সে শুধু শুনেছে। মাঝে
মাঝে একা রাতের বেলা হেঁটে এসে এই পুলের মাঝখানে বসে অপেক্ষা করেছে। কীসের জন্য
অপেক্ষা তা সে জানেনা। অন্ধকার, নিস্তব্ধতা, একাকীত্ব – এই তার জীবনের অংশ। সময়
তার চারপাশে যেন থমকে থমকে দাঁড়ায়। তার কোটরে ঢোকা চোখে, কপালের অজস্র ভাঁজে, সাদা
দাড়ি আর জীর্ণ চেহারাটায় প্রত্যাখ্যান কথাটা খোদাই করা। মৃত্যুও যেন তাকে ফিরিয়ে
দিয়ে গেছে।
ঘরে ঢুকে পাল্লাদুটো বন্ধ করে একটা আলো জ্বালালো সে। তারপর
ভারী ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে বিছানার ওপর রাখল।
ঝোলাটার
ভেতর থেকে এবার বেশ কয়েকটা পাথর বের করে আনে সে। সাত-আটটা, বেশ বড় বড়। সব কটার
ওপরেই সাদা চকখড়ি দিয়ে এক একটা নাম লেখা। কোনওটায় লেখা নবীন, কোনওটায় সুভাষ বা
কানাই।
এরাই
শ্রোতা তার। প্রতি রবিবার রায়বাড়ির ঠাকুরদালানে এদের ঘিরেই বুড়োর গল্প বলা।
আসলে গেল বছর মড়কের সময়ে যখন গ্রামের বেশীর ভাগ লোকই
পালাল, বুড়ো ভেবেছিল বছর ঘুরলে তারা আবার ফিরে আসবে। কিন্তু ফিরল না কেউই। কারন
আশে পাশের আট-দশটা গ্রামেরও তো সেই একই অবস্থা।
বুড়োর
নাতি-নাতনীদের নিয়ে তাদের মা-বাবারা সেই যে গেল, আর ফিরেই এল না। পেছনে ফেলে রেখে
গেল প্রায় জনশুণ্য পরিত্যক্ত একটা গ্রাম। আর রয়ে গেল সেই বুড়ো।
বুড়োর
চোখে অতীতের স্মৃতির জল টপটপ করে ঝরে পড়ে।
আর যেটা অতীত, সেটাও তো ভূতেরই গল্প ।।