গ্রামের সকলে জানত, গ্রামের শেষপ্রান্তে যে বটগাছটা আছে, ওটার মগডালে একটা ব্রহ্মদৈত্য থাকে l
গ্রামের এক নাপিতের কাছে সকলের যাতায়াত l প্রতি রবিবার নাপিতের দোকানের বাইরে জটলা বসে l চারদিন আগে গ্রামের দুই লোক সন্ধ্যেবেলা ফেরার পথে ব্রহ্মদৈত্য দেখে অজ্ঞান হয়েছিলেন l হাজার পাঁচেক টাকাও হারিয়েছেন l দুই বুড়ো পরিষ্কার দেখেছে, মাটি থেকে বিশ হাত ওপরে গাছের ডালে সেই চেহারা l সাদা ধুতি, আদুল গায়ে পৈতে, সাদা মুখ ধবধব করছে l
নাপিতের হাতে কাঁচি চলে চটপট l ক্ষুর চলেছে যেন মাখনের মতন l তার মনে পড়ে আছে পাশের গ্রামে, সেঁজুতির কাছে l জাত আর বয়সের ফারাক সেঁজুতির বাপ মেনে নেবে না l সে শুধু টাকা চিনেছে l
পাশের গ্রাম থেকে বাঘ বেরোনোর কথা শোনা যায় l ইতিমধ্যে একদিন মোড়ল পাশের গ্রাম থেকে ফেরার পথে বটগাছের ওপর ব্রহ্মদৈত্য দেখে l তার হাতের হুঁকো খানা খুব চেনা চেনা l এ তো গত মাসে তারই বাড়ি থেকে চুরি গিয়েছিল না?
নাপিত আবারও সেঁজুতির সাথে দেখা করে l টাকায় বাপ মেয়ের মাথা খেয়েছে l সে সরাসরি না করে না l কিন্তু আশাহতও করে না l সে জিজ্ঞেস করে, "কতো টাকায় আমাকে কিনতে পারবে?"
ইতিমধ্যে গ্রামের এক মুরুব্বি মানুষ - এর মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার সময় ভিরমি খায় l বটগাছের ব্রহ্মদৈত্য নাকি গাছ থেকে নেমে এসে তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছে, "এতো গয়না তোমার কি কাজে লাগবে, দিদিভাই?"
মোড়ল আর সব মুরুব্বিরা শলাপরামর্শ করে গাছটাকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় l কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে গাছ কাটিয়েরা সেই গাছে হাত লাগাতে চায় না l এদিকে পরের মাসে মোড়লের ছেলের বিয়ে l
নাপিত সেঁজুতির বাপের কাছে গিয়ে তাকে বেশ কিছু টাকা দেয় l সে লোক জানায় যে তারা জাতে ব্রাহ্মণ, তাই বিয়েতে রাজি হলেও নাপিতকে তার মেয়েকে নিয়ে পালাতে হবে অন্যত্র l এবং টাকা লাগবে আরো দুগুন l নাপিত আরো একমাস সময় চায় l
মোড়লের ছেলের বিয়ের আগের দিন মোড়লের দুই পালোয়ান সাকরেদ নাপিতের কাছে চুল কাটাতে আসে l মোড়ল নাকি ব্রহ্মদৈত্য কে নিজে হাতে মারবে একথা তাদের কাছে শোনা যায় l মোড়ল তাই তাদের দুজনকে বিয়েতে ছুটি দিয়ে দিয়েছে l
নাপিত পরদিন চুপি চুপি গ্রাম ছাড়ে l রেলস্টেশন গিয়ে শহরের টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে বসে সে l পরের স্টেশনে নেমে সন্ধ্যে অবধি অপেক্ষা করে l তারপর পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরে এসে বটগাছের ওপর চড়ে বসে l মুখে ভালো করে ছাই ঘষে, নতুন পাটভাঙ্গা ধুতি পরে, পৈতেটা গায়ে জড়িয়ে নেয় l
মাঝরাতের পর মোড়লের ছেলে বিয়ে করে ফেরে, সঙ্গে পালকিতে তার বিয়ে করা বউ l
গাছ থেকে যথারীতি ব্রহ্মদৈত্য নেমে আসে l মোড়লের ছেলে ঘোড়া ছুটিয়ে উধাও l পালকির ভেতর উঁকি মারতে দেখা যায় নতুন বউ নয়, স্বয়ং দুই পালোয়ান সাকরেদ মজুত l তারা ব্রহ্মদৈত্য রূপী নাপিতের প্রাণ নেয় l
অষ্টমঙ্গলায় মোড়লের ছেলের বউ সেঁজুতি তার বাপের বাড়ি যায় l পরে বাপের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যে নামে l বটগাছের তলা দিয়ে আসার সময় ওপরে ধোঁয়া দেখে সেঁজুতির মনে হয় ঘন পাতার আড়ালে কেউ যেন বসে হুঁকো টানছে l মোড়লের ছেলে মস্করা করে বলে, "মানুষ মরলে তো ভূত হয়, ব্রহ্মদৈত্য মরলে কি হয় তবে?"
সেঁজুতি কিছু বলতে পারেনা l বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে সে শুধু বটগাছের দিকে তাকিয়ে থাকে ll