Friday, November 27, 2020

তোমাকে বলতে পারিনি ll

তোমাকে কতটা ঘৃণা করি, কোনোদিন বলতে পারিনি l আসলে এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেছি তো... হয়তো তাই l

তোমার বার বার ছেড়ে চলে যাওয়া, উদ্দাম হাসির সাথে সাথে প্রতিবার অজানাকে নিজের করে নেওয়া l

নিজেকে আমার থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নেওয়া কোনোদিন ভুলতে পারিনি l

মনের গভীর থেকে বলছি, কতটা ঘৃণা করি, কোনোদিন বলতে পারিনি l 


এখন যদিও আর এসবের কোনো মানে হয়না

তুমি বিবাহিতা, আর আমার একলা জীবন জেগে আছে 

সিগারেটের কটু গন্ধ, ময়দানে রবিবারের উড়ন্ত চিল 

আচ্ছা, পার্ক স্ট্রিটের ওই রেস্তোরাঁটায় কি এখনও পৌনে দু' ঘন্টা লাইন দিয়ে খেতে হয়? 

এখনও কি তোমার হাত ধরতে চেয়ে কেউ বকা খায়

ছুঁয়ে যায় তোমার কাঁধে কারো ভীরু ঠোঁট? 


অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে মাঝখানে তাই হয়তো... 

কিন্তু তাও জানিনা কেন, তোমার সাথে কাটানো এক একটা মুহূর্ত জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি 

আসলে, তোমাকে কতটা ভালোবাসি, কোনোদিন

মুখ ফুটে বলতে পারিনি ll

Monday, November 23, 2020

পাতা ঝরার পরে

ন্যাড়া গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, একা একা l নদীর কিনারায় পাথর বড় বড়, দু-তিনটে l একটা কাঠের পুরোনো বেড়া ভেঙে পড়েছে পাশেই l একটা জঙ্গুলে ঝোপ আছে, তাতে নাম-না-জানা ফুল ফুটেছে কয়েকটা l এই, ব্যাস l

            এদিকটায় কেউ সাধারণতঃ আসেনা l আমি এলাম l একলা নদীটা বয়ে চলেছে নিঃশব্দে l একটা নাতিদীর্ঘ গাছ দাঁড়িয়ে - রুক্ষ, শুকিয়ে যাওয়া ডালপালাগুলো ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় l ঝরে পড়া পাতাগুলো মাটির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্তুপ তৈরী করেছে l অদ্ভুত শান্তি, আশ্চর্য নীরবতা l

      নদীটার নাম কি, জানিনা l জায়গার নাম, তাও জানিনা l


              আসলে আমরা স্বপ্নের মধ্যে যা যা দেখি, সেগুলোর তো আর খোঁজ খবর নেওয়া সম্ভব হয় না l সেরকম জায়গা ভূভারতে আদৌ আছে কিনা, বা সেখানে আদৌ যাওয়া যায় কিনা, তাও জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না l

কয়েকদিন আগে যেমন হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম, বাংলা পরীক্ষা দিচ্ছি l কোন ক্লাসের বোঝা খুব মুশকিল, হয়তো টেন বা টুয়েলভ হবে, কারণ তারপর তো আর সাধারণতঃ বাংলা পড়তে হয়না l তো স্বপ্নে দেখলাম পরীক্ষা দিচ্ছি, মিনিট পাঁচেক বাকি হয়তো l হঠাৎই প্রশ্নপত্র উল্টে দেখলাম শেষের পাতার দুটো রচনা লেখা তখনও বাকি l চিন্তার চোটে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেলো l আর জানাও হল না, যে স্বপ্নে দেখা ওই বাংলা পরীক্ষার শেষটা কি হলো l

ঠিক যেমন এই স্বপ্নটা l শেষটা কি হয়, জানা যায়না l স্বপ্নটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখি l মূল স্বপ্নটা একই থাকে, কিন্তু এক এক সময়ে এক-আধটা জিনিস আলাদা দেখি l

                   যেমন, প্রথমবার যখন স্বপ্নটা দেখি তখন পুরো ব্যাপারটাই আবছা আবছা ছিল l একটা কালোকুলো মরা গাছ, আর একটা নদী l এর বেশী কিছু মনে ছিল না l আরো কয়েকবার দেখার পর বাকি জিনিসগুলো স্পষ্ট হলো l ঝরে পড়া পাতা, কাঠের বেড়াটা, জঙ্গুলে ঝোপের আগায় নাম-না-জানা ফুলগুলো, নদীর কিনারায় বড় বড় পাথরগুলো l

             একটা চিন্তা যেমন আমাদের মনে একবার ঢুকে গেলে আমাদের কল্পনার আশ্রয়ে সেটার ব্যাপ্তি সময়ের সাথে  ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, এটা অনেকটা সেরকমই l স্বপ্নটা দেখতে এমনিতে মন্দ লাগেনা, কিন্তু একটু একা একা, নিঃসঙ্গ লাগে l মানে ওই গাছটার কি না মরলেই চলতো না? নদীতে যদি দু একটা নৌকা চলতো তাহলে ভালো হতোনা কি?

তিনদিন আগে রাত্রে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নটা আবার এসেছিল l  আর এবার একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম l

              একটা গাড়ি l গাড়িটা চলতে চলতে যেন হঠাৎই থেমে গেলো l আর তারপরেই ঠিক সিনেমার কায়দায় সিন চেঞ্জ হয়ে চলে গেলো পরের দৃশ্যে l এবার একজোড়া পা ওই গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে পাশের রাস্তায় নেমে দাঁড়ালো l সেই পায়ে একজোড়া জুতো আর সেই জুতো আমার খুব চেনা l

কিছু কিছু বস্তু, গন্ধ, স্পর্শ - ইত্যাদির সাথে এক একটা স্মৃতি জড়িয়ে থাকে l যেমন, আমার স্কুলজীবনের একটা ঘটনা l তখন ক্লাস ফাইভ l আবাসিক স্কুলে থেকে পড়াশোনা করি l একদিন সন্ধ্যেবেলা জ্বর এলো l পরেরদিন স্কুলে যেতে পারলাম না l সেদিন পুরো স্কুলটাইমে আমি একা আমার ঘরে l আধা ঘুম আধা জাগার মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমাদের হস্টেল বিল্ডিং এর পেছন দিকে ঝরে পড়া পাতা একত্রিত করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে l সেই যে ধোঁয়ার গন্ধ জানলা দিয়ে সেই জ্বরের দুপুরে আমার স্মৃতির মধ্যে ঢুকে গেলো, তারপর সারাজীবন যেখানেই ওই ঝরে পড়া পাতা পোড়ানোর গন্ধ পেয়েছি, আমার মন এক নিমেষে ফিরে গিয়েছে সেই জ্বরে ভোগা দিনটায়, এক কিশোরের একা একা তার বিছানায় শুয়ে থাকা, তার নিজের বাড়ির থেকে সোয়া শো কিলোমিটার দূরে শুয়ে তার বাড়ির কথা চিন্তা করা l এর কোনও অন্যথা হয়নি, হবেও না l

            জুতোটা ছিল আমার কলেজজীবনের সঙ্গী l আর কলেজ বললেই প্রথম যে নামটা মনে আসে সেটা হলো, কামিনী l এখন অবশ্য ওই দুটোর কোনোটাই আমার জীবনে নেই l জুতোজোড়া অনেক দিন আগেই গিয়েছে হারিয়ে l আর, কামিনীও l

                        একটা ক্যুরিয়র এসেছিলো তিনদিন আগে l প্যাকেটটা রিসিভ করে ফেলে রেখে দিয়েছিলাম আউটহাউসে l আসলে দিনের বেশিরভাগ সময়টা আমার ওই আউটহাউসেই কাটে l তার কারণ অবশ্যই আমার বনসাই l বনসাই গাছ তৈরী করা আমার খুব ছোটবেলা থেকেই নেশা, এবং পরবর্তীকালে, পেশাও l বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা জোগাড় করে তাদের ধীরে ধীরে বড় করা এবং বনসাইয়ের রূপ দেওয়া, অথবা কোনও মৃতপ্রায় গাছকে নব্বই শতাংশ বাদ দিয়ে শুধুমাতেও একটিমাত্র ডালকে বাঁচিয়ে রেখে তাকে বনসাই তৈরী করা, এবং সেইসব গাছের তত্ত্বাবধান করা, এই সব কাজই আমি ওই আউটহাউসেই করি l আজকের দিনে, মানুষ যখন বিভিন্ন ধরণের গাছপালা বা বনসাই দিয়ে নিজেদের ড্রয়িংরুম বা বাগান সাজানো পছন্দ করেন, তখন একথা বলাই বাহুল্য যে বনসাইয়ের দাম ও কদর দুইই সময়ের সাথে উর্দ্ধমুখী l সারা বছরই আমি নিজের তৈরী বিভিন্ন বনসাইয়ের গাছ পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশে প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে যাই আর সেখান থেকে বিক্রিও ভালোই হয় l আর ভালো গাছপালা সংগ্রহের জন্য বছরের অনেকটা সময়েই আমি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াই l

আমার এই হেন অদ্ভুত শখের কারণ অবশ্যই আমার দাদু l ছোটবেলায় দাদুর সাথেই আমার গাছের পরিচর্যা এবং বাগান করার শখের হাতেখড়ি l দাদুর ছিল বিশাল বড় বাগান l আর সেই বাগানের প্রতিটি গাছের রক্ষণাবেক্ষণ, তত্ত্বাবধান উনি নিজের হাতেই করতেন l দুবেলা নিয়ম করে গাছে জল দেওয়া, সময়ে সময়ে মাটিতে বিভিন্ন সার দেওয়া, কাঁচি দিয়ে পুরোনো পাতা বা মৃতপ্রায় ডাল কেটে ফেলা - যাকে বলে প্রুনিং - এ সবই আমি দাদুর কাছ থেকে শিখেছি l

ছোটবেলার সেই শখটা রয়ে গিয়েছিলো l ইন ফ্যাক্ট, বনসাই গাছ তৈরির শুরুটাও তখনই হয়েছিল l পরে, অনেক পরে যখন বারুইপুরের বাগানবাড়িটা কেনা হলে তাতে একটা ডেডিকেটেড আউটহাউস তৈরী করেছিলাম বনসাইয়ের জন্য l দেশের বাড়িতে তৈরী করে রাখা সব পুরোনো গাছপালা আর বনসাইগুলোও পাকাপাকিভাবে স্থানান্তর করে ফেলেছিলাম l

দাদু মারা যান আমি তখন কলেজে পড়ি l কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে একটা শক দিয়ে যান l আমি দত্তক নেওয়া সন্তান l কথাটা আমাকে পুরোপুরি অবাক করে দিলেও পরবর্তী জীবনে যে খুব একটা তফাৎ করে দিয়েছিলো তা নয় l দাদুর মারা যাওয়ার পর বাবা ফিরলেন জার্মানি থেকে, মা আর ভাইকে ছাড়াই l আমিও জানতে দিলাম না দাদুর মৃত্যুর আগে আমাকে বলে যাওয়া আমার স্বরূপের কথা l তবে তাঁর সাথে ফিরে যেতেও সম্মত হলাম না l তাই দিন পনেরোর মধ্যেই দেশের বাড়ি পুরোনো বিক্রি করে কলকাতার অনতিদূরে, বারুইপুরে একটা পুরোনো বাগানবাড়ি কিনে দিলেন আমারই নামে l কয়েকদিনের মধ্যেই আমার আর দাদুর মিলে বানানো বহু চারাগাছ, বনসাই - সব নিয়ে চলে এসে পুরোপুরি সাজিয়ে নিয়েছিলাম নতুন বাড়িটাকে l বাবা ফিরে গেলেন ইউরোপ, দেশে আমার একাকী জীবন শুরু হলো l

সেই তখন থেকে শুরু করে আজ প্রায় বারো - তেরো বছর গাছের চারা সংগ্রহ, বনসাই অনুকূল গাছের খোঁজ ইত্যাদি আমি একাই করে এসেছি l দুজন লোক রেখেছি যারা গাছের পরিচর্যা করে l এর মধ্যেই আমার তৈরী বেশ কিছু গাছ বিদেশেও বিক্রি হয়েছে l সেরকম ভালো বনসাই তৈরী করা গেলে তার দাম কয়েক লাখের ওপর হয়ে যায় l তবে সেই জিনিস তৈরী করা যে খুব কঠিন তাই নয়, সময়সাপেক্ষও বটে l

              আজ প্রায় তিনদিন পর ক্যুরিয়রের প্যাকেটটা খুলে দেখার সময় হলো l চমকে যাওয়ার মতন খবর l বুধাদিত্যর বিয়ে l যে ছেলে সারা জীবন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই বুধা - আমার ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু l তাও করছে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং l মহীশূরের ললিত মহল প্যালেস হোটেলে l ইনভিটেশন কার্ডের সাথে ফ্লাইটের টিকিট পেলাম l আজ আঠারোই জুন বৃহস্পতিবার l আর আজ থেকে ঠিক দশদিন পর আঠাশে ওর বিয়ে l প্লেনের টিকিট বিয়ের একদিন আগের l

                      দিন তিনেকের মধ্যেই গোছগাছ করে ফেললাম l আমি মহীশূরে পৌঁছচ্ছি সাতাশের সকালে l এবং যেহেতু আঠাশের আগে হাতে সেরকম কোনও কাজ নেই, আমি ঠিক করেছি সাতাশ তারিখেই মহীশূর থেকে উটি ঘুরে আসবো l সাতাশের রাতে উটিতে থেকে আবার আঠাশের দুপুরের মধ্যে মহীশূর ফেরত l আঠাশের সন্ধ্যেবেলা বুধাদিত্যের বিয়ে l এবং বিয়ের পরের দিনই আমার রিটার্ন ফ্লাইট l

উটিতে যাওয়ার কারণ আর কিছুই নয়, মহীশূর থেকে উটি যাওয়ার পথে পড়ছে দু দুটো জঙ্গল, একটা বান্দীপুর ন্যাশনাল ফরেস্ট, যেটা কর্ণাটকের মধ্যে, আর তার পরেই - মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভ, যেটা তামিলনাড়ুর মধ্যে l এই দুই জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে আমার কাজ, এবং সেটা আমার নেশা ও পেশা সংক্রান্তই l

                 এখানে বলে রাখা ভালো, আমার সাথে আমারই বাগানের তত্ত্বাবধানে থাকা একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাবো ঠিক করেছি l ছেলেটির নাম ব্যোমকেশ l গাছপালা খুব ভালো চেনে, এবং আমার সাথে অনেকবার বিভিন্ন জায়গায় গাছপালা সংগ্রহের ব্যাপারে ঘুরে বেরিয়েছে l ও সঙ্গে থাকলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত l

ছাব্বিশে জুন, অর্থাৎ আমার যাত্রার ঠিক আগের দিন রাত্রে স্বপ্নটা আবার দেখলাম, এবং এবার সেই স্বপ্ন আরো বিস্তারিত l

           একটা আচমকা শিস দেওয়ার শব্দ, আর তাঁর সাথেই একটা ঝাঁকুনি l একটা গাড়ি যেন চলতে চলতে হঠাৎই থেমে গেলো l এবং তার থেকে দুটো পা বেরিয়ে এসে মাটিতে নেমে দাঁড়াল l সেই পায়ের জুতো আমার পূর্বপরিচিত l আমার কলেজ জীবনের বহুল ব্যবহৃত লাল সাদা জুতো l এর পর দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গিয়েই চলে আসে একটা নদীর কিনারা l বড় বড় পাথর l অবশ্য ভালো ভাবে দেখলে এটাকে নদী না বলে জলধারাও বলা চলে l বর্ষাকালে অনেক সময়ে পাহাড় পর্বতের দিকে এরকম জলধারা বয়ে চলে l

                  স্বপ্নটা অদ্ভুতরকমের দীর্ঘ l শেষ হয়েও শেষ হতে চায়না যেন l নদীটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি l আমার বাঁয়ে মরা একটা গাছ l পাতাগুলো সব ঝরে গিয়ে স্তুপ হয়ে আছে l আশ্চর্য্য একটা নীরবতা l

আর তারপরেই শুনলাম পেছনে পায়ের শব্দ l কেউ যেন দূর থেকে হেঁটে হেঁটে এসে আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে বললো, "কামিনীকে খুঁজে পাওয়া গেছে l"

আমার ঘুমটাও ঠিক তখনই ভেঙে গেলো l


ভোরের ফ্লাইটে বসে, কাঁধের ব্যাগটাকে ওভারহেড লকারে তুলে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে আয়েশ করে বসলাম l গোঁ গোঁ শব্দ এবং শুরুর ঝাঁকুনি বন্ধ হয়ে প্লেন যখন মাঝ আকাশে খানিকটা স্থিতিশীল হলো, একটু চিন্তা করার সুযোগ পেলাম l

                    কামিনী ছিল আমার কলেজেরই সহপাঠিনী l তবে প্রথমদিকে আলাপ হয়নি, তাই কথাবার্তাও সেরকম হতো না l কিন্তু কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে টেবিল টেনিস মিক্সড ডাবলস প্রতিযোগিতার জন্য যখন নাম নেওয়া হচ্ছিলো, ওই নিজে থেকে আমাকে এসে বলে ওর খেলার পার্টনার হওয়ার জন্য l আমি নিজে খুব একটা খারাপ খেলতাম না l কিন্তু সেবার টুর্নামেন্টে আমাদের জুটি কোয়ার্টার ফাইনালের বেশী এগোতে পারেনি l তবে টেবিল টেনিসের বাইরে আমাদের বন্ধুত্বটা টিকে গিয়েছিলো l বাকি তিন বছর কাটানোর পর কলেজের শেষ দিন আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিল ও l যে জিনিস ছিল আমার কল্পনারও বাইরে l

স্বভাবতঃই আমি 'না' বলেছিলাম l এবং তার কারণও ছিল l কামিনীকে আমি কোনোদিনও সেইভাবে দেখিনি l বন্ধুত্বের চেয়ে বেশী কিছু ওর কাছে আশাও করিনি l সেকথা সরাসরি বলেওছিলাম ওকে l কিন্তু তারপর আর ও যোগাযোগ রাখেনি আমার সাথে l পরে, অনেক পরে পস্তেছিলাম l এই ভেবে যে, হয়তো চিন্তা করে দেখলে ওকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেই আমার সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হতো l কিন্তু ওই, যে সময়টা চলে গেছে সেটা হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না l

ব্যাঙ্গালোরে একটা ফ্লাইট চেঞ্জ করে যখন মহীশূর পৌঁছলাম তখন সকাল সাড়ে ন'টা l ললিত মহলে পৌঁছে দেখলাম বুধাদিত্য আর ওর পরিবারের সবাই প্রায় চলে এসেছে l প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময় ইত্যাদির পর নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে তুললাম l প্রত্যেকটি ঘরে দু' জনের থাকার ব্যবস্থা l আমাদের ঘরে থাকছি আমি আর ব্যোমকেশ l পাশের ঘরে আমার স্কুলেরই আরো দুই বন্ধু থাকছে, কৌশিক আর অভিজিৎ l কিন্তু তারা এখনও এসে পড়েনি l

        আধ ঘন্টার মধ্যে স্নান সেরে বেরিয়ে দেখি দুই বন্ধু হাজির l এতদিন পরে দেখা, সবাই মিলে ঘরে তালা লাগিয়ে বাইরে লনে বসে গল্পগুজব শুরু করলাম l বুধাদিত্যও তাতে যোগ দিলো l বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে পরের দিন বিকেল থেকে l তাই আজকের দিনটা যে আমাদের জন্য ফাঁকা এবং আমরা চাইলে মহীশূর শহরটা ঘুরে দেখে নিতে পারি সেকথা বুধা আমাদেরকে মনে করিয়ে দিলো l এই ফাঁকেই আমি আমার নিজস্ব প্ল্যানটা বাকিদের জানালাম l কৌশিক তৎক্ষণাৎ আমাদের সাথে উটি যেতে রাজি l ওকে জানালাম যে যাওয়ার পথ দীর্ঘায়িত হতে পারে, পথে আমার কিছু নিজস্ব কাজের জন্য l ও বললো কুছ পরোয়া নেই, উটি নাকি ও কোনোদিন যায়নি এবং এই সুযোগ ও হাতছাড়া করতে চায়না l

                অভিজিৎ নিজের ক্যামেরা ও নানারকম সরঞ্জাম এনেছে মহীশূর প্যালেসের ওপর স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র করবে বলে l সে তখনই আমাদের 'অল দ্য বেস্ট' জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো l অন্যদিকে বুধাদিত্যও আমাদের গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়ে উঠে পড়লো l মিনিট পনেরোর মধ্যেই একটা ছাইরঙের টয়োটা ফরচুনার এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে, এবং তাতে চড়ে বসলাম আমি, কৌশিক আর ব্যোমকেশ l ব্যোমকেশ গাড়িতে তুলে নিয়েছে কলকাতা থেকে নিয়ে আসা ছোটো কয়েকটি যন্ত্র যা দিয়ে মাটি খোঁড়া বা গাছের বড়, চওড়া শেকড় কেটে ফেলা যায় l ঠিক দশটা বেজে চল্লিশ মিনিটে আমাদের যাত্রা শুরু হলো l

শহর ছাড়িয়েছি যখন প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ, মুষলধারে বৃষ্টি এলো l শহরের রোদ্দুরকে পেছনে ফেলে আকাশ এখন কালো মেঘে ঢেকে গেছে l এমন আবহাওয়ায় ভ্রমণ রোমাঞ্চকর তো বটেই, তবে আমার উত্তেজনার অন্য কারণও রয়েছে l

                           আরো প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর রাস্তার বামদিকে বড় বড় করে লেখা হোর্ডিং দেখা গেলো, "বান্দীপুর ফরেস্ট রিজাৰ্ভে আপনাকে স্বাগত l" ড্রাইভার চাপা গলায় বলে উঠলো, "যাঁহা সে জঙ্গল শুরু হোতা হ্যায় l" এবং এর আরো কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর পাওয়া গেলো একটা ফরেস্ট চেকপোস্ট l আর সেটা পেরোতেই আমার ব্যাগ থেকে বেরোলো ম্যাপ l

আশেপাশের জঙ্গল এবার ঘন হতে শুরু করেছে l আমরা জঙ্গলের 'কোর এরিয়া' - এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি l মহীশূর থেকে উটি যাওয়ার এই রাস্তায় পর পর দুটো জঙ্গল পড়ে l বান্দীপুর আর মুদুমালাই l এই রাস্তায় প্লাস্টিকের বোতলে জল নিয়ে যাওয়া বারণ l প্রকৃতিকে নিজের মতন করে সাজিয়ে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা l আমাদের প্রত্যেকের কাছেই কাচের বোতলে জল আছে l রাস্তায় তাই কাজে আসবে l

বামদিকে একটা ছোটো নালা পেরোনোর পর ড্রাইভারকে বললাম ডানদিকে চোখ রাখতে l ম্যাপ বলছে মূল রাস্তা থেকে এখানে ডানদিকে একটা সরু রাস্তা ঢুকে গেছে l এটা যাতায়াতের জন্য না হলেও গাড়ি চলাচলের জন্য একেবারে অব্যবহৃত নয় l  চেকপোস্ট গুলো থেকে মাঝে মাঝে দু' - একটা গাড়ি এদিকে টহল দিতে আসে একথা জানি l তবে আমার যা কাজ, তাতে মূল রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করানোয় সমস্যা l

                               রাস্তাটা খুঁজে পেতে খুব একটা সময় লাগলো না, এবং গাড়ি যখন সেই সংকীর্ণ রাস্তায় পাড়ি দেওয়া শুরু করলো, কৌশিকই প্রথম মুখ খুললো -

"তোর মতলবটা কি বলতো?"

"আর কিছুই না," আমি গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললাম, "যাওয়ার পথে ঘন্টাখানেক দেরি হলে আশা করি সমস্যা হবে না, তার মধ্যে আমার একটা কাজও হয়ে যাবে l"

"এই কাজটা ঠিক কি?" কৌশিকের গলায় সন্দেহ l

                         "তোর মনে আছে কিনা জানিনা, আগের বছরের গোড়ার দিকে এই জঙ্গলে একটা আগুন লাগার ঘটনা ঘটে l দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ঘটনাটা ঘটানো হয়েছিল l একদল চোরাশিকারী হঠাৎই বান্দিপুরের কোর এরিয়াতে ফরেস্ট রেঞ্জারদের হাতে ধরা পড়ে l সকলকে শুধুমাত্র সাবধান করে দিয়ে জঙ্গল থেকে বের করে দেওয়া হলেও তারা রাগের বশে পরে ফিরে এসে জঙ্গলের একটা অংশে আগুন লাগিয়ে দেয় l"

"ইয়েস, এটা তো খবরেও এসেছিলো l"

"হ্যাঁ l অনেক গাছপালা পুড়ে যায়, প্রচুর জীবজন্তুও মারা পড়ে l মর্মান্তিক ব্যাপার l "

"কিন্তু এর সাথে তোর কাজের কি সম্পর্ক?"

"বলছি l গাছপালা নিয়ে খুব ছোটো থেকেই কাজ করার সুবাদে এটা আমি জানি যে এই ধরণের আগুনে ঝলসে যাওয়া মৃতপ্রায় গাছপালাকে যদি ঠিকমতো কেটে ছেঁটে, স্থানান্তরিত করে উপযুক্ত যত্নআত্তি করা যায় তবে সেই গাছপালার আবার আগের মতন বৃদ্ধি শুরু হতে পারে l পুরোনো জায়গায় রয়ে গেলে যেটা কখনোই হয়তো সম্ভব নয় l এখানেই আসছে আমার ভূমিকা l আমি চাই জঙ্গলের এই অংশে যেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ফলে প্রচুর গাছের ক্ষতি হয়ে গিয়েছিলো, সেখান থেকে খুঁজে কয়েকটা অগ্নিদগ্ধ মৃতপ্রায় গাছ জোগাড় করে নিয়ে যাবো, যাতে আমার কাছে কলকাতার বাড়িতে সেগুলো যত্নআত্তি পেয়ে আবার আগের মতন বেড়ে উঠতে পারে l"

"তারপর?"

"তারপর আর কি? সময় এলে সেগুলোর বনসাই বানিয়ে বিক্রি করে দেবো l গাছটাও বাঁচলো, আমারও দু-পয়সা রোজগার হলো l কিন্তু এটা নিশ্চিত জেনে রাখ যে এই আগুনে পোড়া জঙ্গলের অংশে রয়ে গেলে সেই সব গাছে আর কোনোদিনই হয়তো সবুজের আভা আসবে না l"

                     পুরো ব্যাপারটা শোনার পর, জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গাছপালা খোঁজাখুঁজির ব্যাপারটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেই নিয়ে কৌশিক খানিকটা গাঁইগুঁই করলো l তবে আমার বিশ্বাস, দিনের বেলা কোনও হিংস্র জন্তু জানোয়ারের সম্মুখীন না হওয়াটাই স্বাভাবিক l জঙ্গলের জানোয়াররা সাধারণতঃ মানুষকে ভয় করে এবং একলা থাকতে পছন্দ করে l মানুষ আর জঙ্গলের জানোয়ারের চরিত্র আলাদা, তাই তাদের চারণভূমিও আলাদা l

গাড়ি ধীরে ধীরে চলেছে l এদিকের রাস্তা সংকীর্ণ, দুপাশের বৃক্ষরাজি যেন মাথার ওপরে গাঢ় সবুজের চাঁদোয়া বিছিয়ে রেখেছে l একদল হরিণকে দেখলাম রাস্তার পাশেই জঙ্গলে চড়ে বেড়াচ্ছে l একটা বেঁটে খাটো শিশু গাছের মরা কাণ্ডের ওপর বসে রয়েছে একটা ময়ূর l কয়েকটা বাইসনও দেখা গেলো l ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিরুদ্বেগে ঘাস খাচ্ছে l

গাড়ির মধ্যে সকলেই এখন নিশ্চুপ হয়ে বাইরের প্রকৃতির শোভা দর্শন করছে l সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছি আমি, পেছনের টানা লম্বা সিটে বাঁদিকে কৌশিক আর ডানদিকে ব্যোমকেশ l ব্যোমকেশকে আগেই বলা আছে, আমাদের পছন্দসই গাছ দেখতে পেলেই গাড়ি দাঁড় করাতে বলবে l ও গাড়ির ডানদিকটা লক্ষ্য রাখছে l জঙ্গলের সামনের দিকটা আর বামপাশটা থাকছে আমার নজরে l

                          প্রায় মিনিট দশেক চলার পর দূরে একটা গাড়ি নজরে এলো l সাদা, প্রাইভেট গাড়ি l এটা ফরেস্ট অফিসারদের নয় l গাড়িটা থেমে আছে এবং কাছে আসতে বোঝা গেলো বনেট খোলা এবং তার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে খুটখাট করছে একজন l

আমাদের গাড়ির গতি কমে এসে থেমে থাকা গাড়ির একদম পাশাপাশি চলে এলো l এবার পাশের গাড়ির পেছনের সিটের ডানদিকের জানলা দিয়ে যে মুখটি বেরিয়ে এলো তাকে অনায়াসে একজন ক্লাউনের ভূমিকায় কল্পনা করা যায় l টাকমাথা, পাতলা করে ছাঁটা গোঁফ, মিনমিনে চোখ আর দেঁতো হাসিতে প্রথম সম্বোধনটা উড়ে এলো আমার দিকেই -

"এই, এই... ইয়ে মানে, হেল্প প্লিজ!"

         ইনি বাঙালি l অগত্যা গাড়ি থেকে নামতে হলো l এবার আমাদের নামতে দেখে উনিও গাড়ির দরজা খুলে নেমে এগিয়ে এলেন l 

                   এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখ চলে গেলো ওনার পায়ের দিকে l

ওই জুতো!

এ জিনিস আমার চেনা l কলেজ জীবনের বহুলব্যবহৃত লাল আর সাদা ডোরাকাটা এই জুতো গত বেশ কিছুদিন যাবৎ বার বার ফিরে এসেছে আমার স্বপ্নে l মাথাটা কেমন যেন টাল খেয়ে গেলো l

           এর মানে কি এই ভদ্রলোকের সাথে কামিনীর কোনও সম্পর্ক আছে?

                        কৌশিক, ব্যোমকেশ আর আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ততক্ষনে নেমে এসে কথাবার্তা শুরু করেছে l যা বোঝা গেলো, ভদ্রলোক পক্ষীবিদ, নাম পান্নালাল চট্টরাজ, নিবাস কলকাতা এবং এখানে আসার উদ্দেশ্য হলো নীলগিরিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পাখির ছবি তোলা ও তাদের পর্যবেক্ষণ করা l বর্তমানে তাঁর গন্তব্যস্থল ছিল উটি কিন্তু গাড়ি মাঝপথে খারাপ হয়ে পড়ায় সেই কাজে পড়েছে বাধা l

          ভদ্রলোককে অফারটা কৌশিকই প্রথম করলো l আমাদের গাড়িটা যথেষ্ট বড় l তাই উনি স্বচ্ছন্দে আমাদের সাথে উটি অবধি আসতে পারেন l ভদ্রলোক দেখলাম বেশ খুশী হয়েই নিজের গাড়ি থেকে ব্যাগ বের করে নিয়ে এসে আমাদের গাড়িটায় উঠে পড়লেন l

                   গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে l এবার সামনে চালকের পাশে ব্যোমকেশ l পেছনের টানা লম্বা সিটে বামদিকে কৌশিক, মাঝখানে মিঃ চট্টরাজ আর ডানপাশে আমি l আমার চোখ বারবারই চলে যাচ্ছে ভদ্রলোকের পায়ের দিকে l ঠিক এই জিনিসই আমি কিছুদিন ধরে দেখছি স্বপ্নে l তাহলে কি স্বপ্নটার সাথে ওনার কোনও যোগাযোগ আছে? কামিনী কি ওনার চেনা কেউ...?

কামিনীর কথা বারবার মনে পড়ছে l এই একটা মানুষের কথা জীবনের এতগুলো বছর ভুলে থেকেও আজ বুঝতে পারছি, সেটা ঠিক করে ভোলা হয়ে ওঠেনি l একটা মানুষ নিজে থেকে এসে দাঁড়াতে চেয়েছিল আমার পাশে l এবং অচেনা অজানা কেউ নয়, সে ছিল আমার বন্ধুই l কিন্তু যে আসনে সে আমাকে বসিয়েছিলো সেই কদর আর সম্মান তাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি l আজ বুঝতে পারি, কোনও মানুষের ভালোবাসাকে চিনে, বুঝে, জেনে তাকে সেই অধিকারবোধের সম্মান করার জন্য অনেক বড় একটা হৃদয়ের দরকার হয় l হয়তো সেই জিনিসটাই আমার ছিল না, তাই 'না' বলেছিলাম l ওর আয়ত টানা টানা চোখে আমার চোখের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিল কামিনী l শুধু বলেছিলো, "যদি কখনও জীবনে এই মত পরিবর্তন করো তবে জানিয়ো, আমি এখানেই আছি l"

                     আর তারপর ও চলে গিয়েছিলো l সত্যি কথা বলতে তারপর কোনোদিনই আর ওর কাছে আমি ফিরে যাইনি l হয়তো বাঁধা পড়ার ভয়ে l হয়তো নিজের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে, যে আমার মনে হয়তো ওর জন্য কিছুটা হলেও ভালোবাসা ছিল l কিন্তু করলাম কি, যেটা পুরুষ মানুষের করা উচিত, মনটাকে একদম কাঠের মতন শক্ত করে রইলাম l

                 আজ এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি যৌবনের সেই রঙীন দিনের পাতাগুলো ঝরে পড়ে গেছে জীবন থেকে l ভেতরে ভেতরে পুরোনো হয়ে পড়েছি আমি l হয়তো বা একটু আলতো টোকা মারলে ভেঙেও পড়তে পারি l


         আড়চোখে একবার মিঃ চট্টরাজের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম l ঈষৎ হাসিমুখ, বাইরের জঙ্গলের দিকে চেয়ে প্রকৃতির শোভা দেখছেন l গায়ে ফুল আঁকা হাফ শার্ট l ভদ্রলোককে দেখলে অনেকটা যাত্রাপালার কোনও মজার চরিত্রের সাথে মিল পাওয়া যায় l

এদিকের জঙ্গলটা বেশ ঘন l আবারো একদল হরিণ দেখলাম l নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে l জঙ্গল যেন এই সব জন্তু জানোয়ারদের তুলির রঙে সযত্নে তার বুকে এঁকে দিয়েছে l ইতিমধ্যে আর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো l আমরা নীলগিরির খুব কাছে এসে পড়েছি তাই এখানে বৃষ্টি হওয়া মানেই তাপমাত্রাটা এক ঝটকায় অনেকটাই নেমে যায় l যদিও ঘড়ির কাঁটা বলছে দুপুর একটা বেজে পনেরো মিনিট, তাও বৃষ্টির দরুণ ঠান্ডাটা গায়ে লাগতে আরম্ভ করলো l

সরু রাস্তাটা জঙ্গলের মধ্যে গোল হয়ে ঘুরে যেখানে মূল রাস্তাটার সাথে মেশে, তার কয়েক কিলোমিটার আগেই আমরা গাড়ি থামালাম l এই জায়গাটা দৃশ্যতই দাবানলের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত l বুনো ঝোপজঙ্গল কম, জায়গায় জায়গায় জঙ্গল পুড়ে যাওয়ার ছাপ স্পষ্ট l মোদ্দা কথায়, আমার বনসাইয়ের জন্য গাছ খোঁজার জন্য আদর্শ l

ড্রাইভার ছাড়া আমরা সকলেই নেমে পড়েছি গাড়ি থেকে l ব্যোমকেশ আর আমি গাড়ি থেকে নেমেই বামদিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম l এদিকটার জঙ্গল বেশ খোলামেলা, একটু ছড়ানো ফাঁকা জায়গা রয়েছে l মধ্যে মধ্যে দুটো তিনটে করে গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে l কৌশিকও দেখলাম আমাদের পেছনে আট - দশ হাত তফাতে রাস্তা থেকে নেমে আমাদের অনুসরণ করলো l একটা শিশু গাছ চোখে পড়লো এবার l তাঁর পাশেই একটা গোল্ডেন শাওয়ার ট্রি, কয়েকটা আমলকি গাছ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে l

"কিছু পেলেন?" মিঃ চট্টরাজ দেখলাম নেমে আসছেন রাস্তা থেকে আমাদের দিকে l

"দেখছি l এদিকে কিছু না হলে রাস্তার ওপাশটায় একবার দেখবো" আমি গলা চড়িয়ে উত্তর দিলাম l ভদ্রলোকের জুতোটা বারবার আমার মনে সন্দেহের দোলাচল তৈরী করছে l স্বপ্নে যদি এনারই পা জোড়া দেখে থাকি, আর এনার সাথে কামিনীর যদি সত্যিই কোনও সম্পর্ক থেকে থাকে...

    "এদিকে!" ব্যোমকেশের গলার আওয়াজ পেলাম এবার l দেখলাম ওর চোখ ছোটোখাটো একটা খয়ের গাছকে চিহ্নিত করে ফেলেছে l এটার ওপরের অনেকখানি অংশই দাবানলের আগুনে জ্বলে গিয়েছে l মাটি থেকে দেড় হাত ওপরে একটা অদ্ভুতভাবে বাঁক খেয়ে উঠেছে, তাতে বনসাই বানানোর কাজটা খুব সহজ হবে আর জিনিসটা তৈরিও হবে খুব সুন্দর l ব্যোমকেশকে সঙ্গে সঙ্গে বললাম যন্ত্রপাতি গুলো বের করে ফেলতে l আর ঠিক সেই সময়েই ঘটনাটা ঘটলো l

            খয়ের গাছটা থেকে পঁচিশ তিরিশ ফুট দূরে আগেই উল্লেখ করা শিশু গাছটা, যেখানে মিনিট দুয়েক আগেও আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম l সেই গাছের ঠিক নিচেই এখন দাঁড়িয়ে কৌশিক আর মিঃ চট্টরাজ l আর সেই দিকে তাকাতেই আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে বুকের বাইরে বেরিয়ে এলো l

      শিশু গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করছে ওরা দুজন l আর ওদের ঠিক মাথার দশ বারো ফুট ওপরে গাছের একটা নিচু ডালে গুঁড়ি মেরে বসে লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে প্রায় নয়-দশ ফুট লম্বা একটা কুচকুচে কালো জন্তু l

লেপার্ড!


মুখ দিয়ে অস্ফুটে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে পড়লো l আর সঙ্গে সঙ্গেই সেটা শুনে কৌশিকের চোখ আমার চোখ অনুসরণ করে ওপরের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো l আর সঙ্গে সঙ্গেই জন্তু একটা চাপা গর্জন করে লাফ দিয়ে পড়লো চট্টরাজের গায়ে l

              খুব সম্ভবতঃ জন্তুটার উদ্দেশ্য আক্রমণ করা ছিল না, হয়তো নিজের কৌতূহল নিবৃত্তির কারণে বা নিজের এলাকার সুরক্ষার জন্যই সে ঝাঁপ দিয়েছিলো l কিন্তু ভদ্রলোক দেখলাম জন্তুর লাফের সাথে সাথেই একটা ভল্ট খেয়ে উল্টে পড়লেন মাটিতে, আর তাঁর গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে বুঝলাম তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন l  

                 লেপার্ডের দেহ এখন আড়াআড়ি ভাবে আমাদের সমান্তরালে l কৌশিক এবং মিঃ চট্টরাজ মাটিতে শুয়ে আছে লেপার্ডের অন্যপাশে তার থেকে হাত দশেক তফাতে l জন্তুটার মুখ আমাদের দিকেই ফেরানো l আমার দুটো হাতই খালি, মুঠো খোলা অবস্থায় জন্তুর দিকে ফিরে l আমার ঠিক পেছনেই ব্যোমকেশ এক হাঁটু ভাঁজ করে বসে l লেপার্ডের লম্বা বাঁকানো লেজের ডগাটা মাঝে মাঝে চাবুকের মতো মাটিতে ঝাপ্টা মারছে l আর তার মুখের ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে সে ক্ষুধার্ত ও রাগান্বিত l

                            আচমকা কি যেন মনে পড়তেই নিজের পা থেকে একপাটি জুতো খুলে এনে আমি ছুঁড়ে মারলাম জন্তুটার দিকে l জুতোটা লেপার্ডের নাকের দিকে নিক্ষিপ্ত হলেও নিপুণ দক্ষতায় নিজের দেহটাকে এক লাফে বামদিকে অনেকখানি সরিয়ে নিয়ে গেলো সে l পরক্ষনেই অপর পায়ের জুতোটাও খুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারলাম আগের মতোই l জন্তুটা এবারও একই ভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল l কিন্তু এটা বুঝলাম যে, এবারের লাফে সে সকৌশলে নিজেকে আমাদের থেকে বেশ কয়েকহাত পিছিয়ে নিয়েছে l

লেপার্ড ভয় পেয়েছে!

এর পর যে ঘটনাটা ঘটলো সেটা হলো আমি কৌশিক আর ব্যোমকেশ তিনজনেই লেপার্ডের চোখে চোখ রেখে চিৎকার করতে থাকলাম l তাঁর সাথে সাথেই আমি আর ব্যোমকেশ লেপার্ডকে সামনে রেখে অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে এসে মিঃ চট্টরাজ যেখানে শুয়ে ছিলেন সেখানে এসে পৌঁছলাম এবং অজ্ঞান ভদ্রলোককে তিনজনে মিলে টেনে হিঁচড়ে প্রথমে পেছনে রাস্তার ওপর এবং তারপর ড্রাইভারের সাহায্যে গাড়ির মধ্যে গিয়ে তুললাম l পুরো ব্যাপারটা ঘটতে যদিও এক মিনিটের বেশী লাগেনি তাও প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের মনে হচ্ছিলো এক একটা যুগের মতো l

গাড়ি চলতে শুরু করলে ব্যোমকেশ পেছন ফিরে বললো, "ওনার পাল্সটা একবার দেখুন তো l" 

ভদ্রলোক অজ্ঞান l শুধু জন্তুর থাবার একটা আঁচড়ে জামার সামনেটা ছিঁড়ে খুলে এসেছে l এছাড়া অন্য কোনও চোট দেখা গেলো না l খুব সম্ভবতঃ ঘটনার আকস্মিকতা ওনাকে কাবু করে ফেলেছে l

আমরা সকলেই একটু হলেও ভয় পেয়েছি l বন্য জন্তুর মুখোমুখি এরকম হঠাৎ করে পড়ে যাওয়া খুবই বিরল l লেপার্ড সাধারণভাবে একলা প্রকৃতির জীব l নিজের খাদ্য ছাড়া সচরাচর অন্য প্রাণীকে এড়িয়ে চলে l এই হেন জন্তুর আচমকা সামনাসামনি হওয়া এবং রক্ষা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার l

"ভাই আমার হাত এখনও কাঁপছে l" কৌশিক বলে উঠলো l


আমি জানি কিছুটা এগিয়েই মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভের এন্ট্রি পয়েন্টের কাছে আমরা একটা ফরেস্ট অফিসের চেকপোস্ট পাবো l ওখানে নেমে চা খাওয়া যেতে পারে l

গাড়ি এবার নিজের গতিতে চলছে l আমরা যেখানে লেপার্ডের মুখোমুখি হয়েছিলাম সেটা পেরিয়ে এসেছি প্রায় মিনিট কুড়ি হলো l খয়ের গাছটার জন্য মন খারাপ হয়ে গেলো l আকৃতি ও পরিমাপে একটা ভালো বনসাই তৈরী করা যেত ওটাকে l হরিদ্বার থেকে দেরাদুন যাওয়ার পথে একবার এরকমই একটা ইউক্যালিপটাস পেয়েছিলাম যেটা...


একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ হলো l আর তার সাথেই আমাদের গাড়িটা একটা হ্যাঁচকা ব্রেক কষে থেমে গেলো l জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম একটা ময়ূর, দৌড়ে ডানদিকের জঙ্গলটায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে l

আমাদের গাড়ি গিয়েছে থেমে, এবং এটা বুঝলাম সেটাকে পুনরায় চালানোর চেষ্টা করে ড্রাইভার বিফল হলো l

"ইঞ্জিনে সমস্যা হলো নাকি?" ব্যোমকেশ ড্রাইভারকে হিন্দীতে জিজ্ঞেস করলো l

"ম্যায় দেখতা হুঁ " এই বলে ড্রাইভার নেমে গিয়ে গাড়ির বনেট খুলে ইঞ্জিন দেখা শুরু করলো l


    কৌশিক আর ব্যোমকেশ গাড়ি থেকে নেমে আড়ামোড়া ভাঙছে দেখলাম l আমার পায়ে জুতো নেই কারণ সেটা লেপার্ডের সাথে সাক্ষাতের সময়েই ফেলে এসেছি l তাই গাড়ি থেকে নামার জো নেই l কৌশিক বাইরে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে মনে হয় আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলো, হেসে মিঃ চট্টরাজের দিকে দেখিয়ে বললো, "ওনারটা পায়ে গলিয়ে নেমে পড় l"

তাই করলাম l গাড়ির পেছনের সিটের ডানদিকের দরজা খুলে যখন রাস্তায় পা দিলাম, আমার পায়ে শোভা পাচ্ছে সেই লাল সাদা জুতো l

আর এই জিনিস আমি আগেই আমার স্বপ্নে দেখে ফেলেছি l


ড্রাইভার জানালো গাড়ি ঠিক করতে একটু সময় লাগতে পারে l আমরা তিনজনেই এখন জঙ্গলের শোভা দেখছি l একটা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে মাঝে মাঝে l কৌশিক একটা সিগারেট ধরালো l তামাকের কটূ গন্ধে জায়গাটা ভরে যাচ্ছে l রাস্তাটা পেরিয়ে এসে ডানদিকে দেখলাম একটা ঢাল নিচের দিকে সোজা নেমে গেছে l এই ঢাল বরাবর অগ্রসর হতেই পেছন থেকে ড্রাইভারের সাবধানবাণী শোনা গেলো,

"জাদা দূর মত যাইয়ে সাব, শের হো সকতা হ্যায় l"

ডানদিকের রাস্তার ঢালটা নিচের দিকে দেখলাম বেশ খানিকটা নেমে গিয়ে একটা ঘন ঝোপঝাড়ে মিশেছে l এক পা দু' পা করে এগোলাম l চারিদিকটা অদ্ভুত চুপচাপ l

          এখানের মাটিটা শুকনো, তার মানে এদিকটায় বৃষ্টি হয়নি l আকাশ এখন নীল, রোদ ঝলমল করছে l ঘড়ির কাঁটা সময় বলছে বিকেল সাড়ে তিনটে l একবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার ওপর থেমে থাকা গাড়ির বনেটের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে ড্রাইভার তখনও কাজ করে চলেছে l অন্য দুজন অদৃশ্য l

একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে ঝাপ্টা মেরে গেলো আবার l ঝোপঝাড়গুলো পেরিয়ে এগোতে এগোতে বুঝলাম সামনেটা আস্তে আস্তে খালি হয়ে আসছে l এ ঠিক যেন ঝোপঝাড় গুলোর অচেনা একটা পৃথিবীকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা l

এবার সামনেটা একদম ফাঁকা l হাঁটার পথ এখানেই শেষ হয়েছে l এবং শুধু পথ নয়, স্থলভাগও l কয়েক পা এগিয়ে এসে সামনের দিকে দাঁড়ালাম অবাক হয়ে l 


একটা ন্যাড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে, একা একা l সামনে নদীর মতো জলাধার একটা l নদীর কিনারায় পাথর বড় বড়, দু তিনটে l একটা কাঠের পুরোনো বেড়া ভেঙে পড়েছে পাশেই l ঠিক যেন অনেক বছর আগে একটা ছোট্ট জীবন্ত গাছকে কেউ দুহাত দিয়ে আগলে আড়াল করতো চেয়েছিলো l জঙ্গুলে ঝোপটার শেষ চিহ্ন জেগে আছে গাছটার আশেপাশে l তাতে নাম-না-জানা ফুল ফুটেছে কয়েকটা l

                 একলা নদীটা বয়ে চলেছে নিঃশব্দে l রুক্ষ, শুকিয়ে যাওয়া গাছটার ডালপালাগুলো যেন ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে l ঝরে পড়া পাতাগুলো মাটির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্তুপ তৈরী করেছে l

এর পর কি হতে চলেছে তা আমি জানি l এবার শুধুই অপেক্ষা l 

গাছটায় হেলান দিয়ে নদীটার দিকে তাকিয়ে বসে পড়লাম l আশ্চর্য একটা শান্তি বিরাজ করছে জায়গাটায় l সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু জল, ঠান্ডা বাতাস খেলে বেড়াচ্ছে l ওপরে নীল আকাশ আর সম্ভবতঃ পৃথিবীর শেষ জীবিত প্রাণী এখানে একা আমি l উত্তেজনায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে l আমি জানি এখানে আমি কামিনীকে খুঁজে পাবই, আর কেউ একজন এসে আমাকে এই খবরটা দেবে l কিন্তু কে হতে পারে সেটা? আমার সঙ্গী ব্যোমকেশ বা কৌশিক কেউই জানেনা কামিনীর কথা l তবে কি মিঃ চট্টরাজ?

                      সময় কেটে যাচ্ছে l একদল সাদা বক দেখলাম উড়ে গেলো পুরো নদীটাকে পেরিয়ে l নদীর ঠিক ধারটায় যেখানে সে স্থলের সাথে মিশেছে, সেখানে অল্প জল ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে l মাঝে মাঝে হাওয়ায় কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে গিয়ে জলে পড়ে ভাসতে ভাসতে অনেকদূর অব্দি চলে যাচ্ছে l

            একটা পুরো জীবন এখানে কাটিয়ে দেওয়া যায় l


পেছনে এবার পায়ের শব্দ পেলাম l ঝোপে ভরা রাস্তাটা দিয়ে কেউ একজন এগিয়ে আসছে l আমি পেছনে ফিরে তাকাতে পারলাম না l কে আসছে সেটা সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও আমি জানি সে কি বলবে l

পায়ের শব্দটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ঠিক আমার পেছনে এসে থামলো l আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছি l আমার চারপাশের পৃথিবী যেন এক নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেছে l

"চলিয়ে সাব, গাড়ি ঠিক হো গ্যায়া l"

মানে? এটা কি হলো?

ঘুরে দেখলাম আমাদের গাড়ির ড্রাইভার l

"চলিয়ে সাব l" সে আবার বলে উঠলো l

আমার মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে l সবকিছুই তো ঠিক ছিল, সব কিছু মিলে যাচ্ছিলো l এই জুতো, এই জায়গা, এই মরা গাছ, ওই নদী, শিসের শব্দ, আমাদের গাড়ির ঠিক এখানেই থেমে যাওয়া.... তবে? "

"কামিনী?" আমি অস্ফুটে বলে উঠলাম l

ড্রাইভার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে l ভাবছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম l ঘাড় নেড়ে সে বললো, "কৌন সাব?"

হতবুদ্ধি ও বিহবল অবস্থায় ড্রাইভারের পেছন পেছন গাড়িতে ফিরে এলাম l দেখলাম ইতিমধ্যে মিঃ চট্টরাজেরও জ্ঞান ফিরেছে l একে একে সবাই গাড়িতে উঠলো l আমি দাঁড়িয়ে আছি বাইরে l আমার মন বারবার বলছে কোথাও একটা ভুল হলো l কি যেন একটা ধরতে পারলাম না l কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেলো l এতদিন ধরে যা যা স্বপ্নে দেখেছিলাম সবই তো পরপর মিলে গেলো এই কয়েক ঘন্টার সফরে l তাহলে শেষটা কেন নয়? কামিনীকে কেন খুঁজে পেলাম না এখানে?

শেষ পর্যন্ত গাড়িতে উঠতে হলো l সামনে এবার শুধু উটির রাস্তা l মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভের মধ্যে দিয়ে বিকেলের বাকিটুকু পেরিয়ে যখন নীলগিরির চড়াইয়ে এসে পড়েছি তখন সন্ধ্যে হয় হয় l


ব্যোমকেশ এতক্ষনে কথা বললো l পেছনের দিকে ফিরে আমাকে বললো, "একটাও গাছ পাওয়া গেলো না স্যার l"

হয়তো আমার মুষড়ে পড়ার কারণ হিসেবে ও ওই গাছটা না পাওয়াকেই চিহ্নিত করেছে l যদিও এতে ওর দোষ নেই l নিজে থেকে বলে না দিলে মানুষের দুঃখ, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, আনন্দ এগুলোর কোনোটারই কারণ জানাটা অন্য কারোর পক্ষে অসম্ভব l

কৌশিক একটু হেসে আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললো, "একটা গাছ পেলিনা তো কি হয়েছে? পুরো জঙ্গলটা তো আজকের জন্য পেলি l সেটাই কি কম?"

কথাটা ঠিক l আর এটাও ঠিক যে স্বপ্নে দেখা শেষ কথাটা মিলে না গেলেও শেষ কিছুদিনে কামিনীর কথা চিন্তা করে ওকে বা ওর সেই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে যতটা যতটা বোঝার চেষ্টা করেছি, সেটাও কম নয় l


স্বপ্নটা কি সত্যিই মিলে যায়নি?

           হয়তো কামিনীকে খুঁজে পেয়েছি আমি l মাঝে মাঝে, কোনও মানুষকে বাইরের পৃথিবীতে খোঁজার চেয়ে বেশী কঠিন হয়ে পড়ে আমাদের নিজের মনের মধ্যে তাকে খুঁজে পাওয়া l মানুষের মন এতই জটিল, এতই অন্ধকার যে, বাইরের পৃথিবীতে কারোর অস্তিত্ত্ব খুঁজে পাওয়ার থেকেও বেশী কঠিন নিজের মনের গভীরে ঢুকে তার জন্য অনুভূতি খুঁজে পাওয়াটা l


নিজের মনের অজান্তেই আমার ঠোঁটের কোণায় এবার একচিলতে হাসির আভাস জেগে উঠলো l

কামিনী যাওয়ার সময় বলেছিলো, "জীবনে কখনও যদি মত পরিবর্তন করো..."


                                  বাইরে চলমান গাড়ির দুপাশে সন্ধ্যের নীলগিরি জেগে ছিল অতন্দ্র প্রহরীর মতন l সে সাক্ষী ছিল রোজকার নক্ষত্রের একটা একটা করে জ্বলে ওঠার, কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দেওয়ার আর কয়েকটা জীবনের অদ্ভুত গল্পের, পাওয়া না-পাওয়ার, দুঃখ - ভালোবাসার, হারানো - আর খুঁজে পাওয়ার এক বিচিত্র রোজনামচার ll