পর্ব এক :
একফালি ঘর, একটু উঠান l
শহর থেকে দূরে, এই মোর সংস্থান ll
সাইকেল রিকশাটা যখন ঠুনঠুন শব্দ করে একটা অতি পুরোনো পুকুরের পাড় বরাবর পুরোটা ঘুরে নিয়ে এসে আমাকে একটা শতাব্দী প্রাচীন, ইঁট সুরকি বের হওয়া, হাড় জিরজিরে ঘরের সামনে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো, আমার হাতঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে চারটে বাজে l সময়টা অক্টোবরের শেষ, পৌনে পাঁচটায় সূর্যাস্ত l আর সূর্যাস্তের সময় থেকেই গ্রামের এই জায়গাগুলোয় একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে দেয় l আমি অবশ্য ট্রেন থেকে নামার সময়েই গায়ে একটা শাল ভালো করে জড়িয়ে নিয়েছিলাম l সেই থেকে ঠান্ডার কামড়টা আর অনুভব হচ্ছে না l
স্টেশন থেকে নেমে সাইকেল রিকশাতে এখানে পৌঁছতে সময় লাগলো ঠিক বারো মিনিট l স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা পাকা রাস্তা এসে মিশেছে একটা কাঁচা রাস্তায় l সেই রাস্তা উত্তর থেকে দক্ষিণে সোজা এসে গ্রামের শেষপ্রান্তে বসতবাড়িগুলোয় মিশেছে l রাস্তার পূর্বপ্রান্তটা জুড়ে একটা সরু নদীর চর l পশ্চিমপ্রান্তটা গ্রামের ঢুকে পড়েছে l সেখানে একে একে ধানের জমি, খেলার মাঠ, দুটো বড় পুকুর, এবং শ্মশান l শ্মশান আর চাষের জমিগুলোর মাঝখানে বড় একটা বহু পুরোনো দিনের ইঁটের দেওয়াল, জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে l গ্রামটা যেমন খুব একটা বড় নয়, তেমনি বসতিও খুব কম l বারো - তেরোটি ঘর লোকের বসবাস l
এরা সবাই খুব গরীব l নিজেদের জমি আছে বটে তবে ফসল ভালো হয় না l গ্রামের একপ্রান্তে এই ত্যাজ্য ঘরটিতে থাকবো এবং তার পরিবর্তে গ্রামের আট দশটি বাচ্চাকে পড়াবো শুনে তাই এরা রাজি হয়ে গিয়েছিলো l এমনিতে এ গ্রামে মোড়ল জাতীয় কেউ নেই l তবে এই ঘরটিতে এই গাঁয়েরই এক লোকের নিজের ভাই বসবাস করতো l লোকটির নাম হলো নিতাই মন্ডল l কয়েক বছর আগে সেই নিতাইয়ের ভাই ও ভাইয়ের বউ মারা যাওয়ায় সেযাবৎ ঘরটি ফাঁকাই পড়ে ছিল l গাঁয়ের বাচ্চাদের পড়াবো একথা শুনে আর মাসিক ভাড়ার কথা ওঠেনি l দুই পক্ষেরই লাভ l
এখানে অবশ্য আমার আসা শুধুমাত্র বাচ্চাদের পড়ানো বা ছুটি কাটাতে নয় l
রিকশাটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার ঠুনঠুন করতে করতে স্টেশনের দিকে চলে গেলো l এখানে এই স্টেশনের আশেপাশে আট দশটা গ্রাম l সারাদিন রিকশা চালিয়ে কিভাবে ওদের পেট চলে তা শুধুমাত্র ওরাই জানে l
সূর্যের আলো কমে এসেছে l মিনিট দশেকের মধ্যেই আলো ফুরিয়ে অন্ধকার নামবে l কাঁধের ব্যাগ আর বিছানাবালিশ গুলো নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া গেল l সাকুল্যে একটাই মাত্র ঘর, সংলগ্ন একটা রান্নাঘরের মতন ছোট্ট একফালি জায়গা আছে l অদ্ভুত ব্যাপার এই হলো যে, ঘরের মধ্যে কোনও প্রস্রাবাগার নেই l যা করার করতে হবে বাইরেই, মাটির তৈরি উঠোনের একপাশে, খোলা আকাশের নিচে l গাঁয়ের অশিক্ষা এবং গরীবিয়ানা এদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের দিকে প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে l
পুরো ঘরটা ঝাড়াঝাড়ি করে বিছানা পেতে যখন আরাম করে বসে নিতাইয়ের দিয়ে যাওয়া লন্ঠনটা জ্বেলে বসলাম তখন সন্ধ্যে সাতটা l এখানে সূর্য্য ডোবার পর সাড়াশব্দ খুব কমে যায় l একে গ্রামটা খুবই ছোটো, সেটা আগেই বলেছি l তার ওপর এখানে আসার পথে ট্রেনে কয়েকজন লোকের মুখে শুনলাম কাছাকাছি গ্রামে কোথাও দু'-একদিনের মধ্যেই দেখা দিয়েছে এক বাঘ l মানুষ এখনও সে নেয়নি কিন্তু নিতে আর কতক্ষন !
কি অদ্ভুত এদের জীবন l
আজকের রাতটা এভাবেই কাটবে l যে জীবন ছেড়ে আমি এসেছি সেকথা নয়, বরং যে জীবন আমি মাথা পেতে নিয়েছি তা ভাবতে ভাবতে l লন্ঠনের মৃদু আলো, নিতাইয়ের ভাইয়ের মৃত্যুর পর পরিত্যক্ত এই ঘর, সোঁদা পানাপুকুর আর বট-নারকেলের ছায়াঘেরা মাঠ - এই হোক আমার জীবন l নিঃশব্দ, একাকিত্ব আর অন্ধকার - এই নিয়েই হোক আমার জীবন l এই দশ - বারো ঘর অশিক্ষিত, গ্রাম্য, সরল, সাদাসিধে মানুষ হোক আমার সঙ্গী l
একটা বছর দেখতে দেখতেই কেটে যাবে ll
No comments:
Post a Comment