Sunday, June 12, 2022

দে দোল দোল দোল

 তুমি জলে থাকো জলে থাকো, দ্বীপ যেন জলেতে তুমি

কেন জানো না কি

স্বপ্নের সুন্দর তুমি যে আমার ভূমি


কেন পিছু ডাকো পিছু ডাকো, বারে বারে আমারে তুমি

কান্দো কন্যা তুমি

চক্ষের জলে কি ভাসাবে, সাধের ও জমি


হায় যাবো না যাবোনা ফিরে আর ঘরে

পোড়া মন মানে না, সংসার করিবার তরে

দেহ কাটিয়া মুই বানাবো নৌকা তোমারি

দুটি কাটিয়া হাত বানাবো নৌকারই দাঁড়ি

আর বসন কাটিয়া দেবো আর তুফানে আমি উড়াবো

হবো ময়ূরপঙ্খী তোমারি


তরে বুকে নিয়া সুদূরে যাবো গো ভাইস্যা

ওরে বুকে নিয়া সুদূরে যাবো গো ভাইস্যা..


দে দোল দোল দোল তোল পাল তোল

চল ভাসি সবকিছু তাইগ্যা


হেঁইয়ো রে মার্ জোর হে আল্লা, হে রামা

হেঁইয়ো রে মার্ জোর হে আল্লা, হে রামা ।।

Sunday, March 6, 2022

It's a boring Sunday evening at Rohini

Weekends are practically boring. Pretty much standstill. I wash clothes, get bored, watch youtube, play chess, again get bored, cook vegetables, daal-chawl etc, eat them diligently, get bored, think about my life back at Calcutta and play with memories.

My grandmother passed away on the 24th last month. I couldn't go home. Neither when she was hospitalised and Doctors said nothing can be done, nor today when the Shradhh was happening.

In the past few years (though this thought was always there in some corner of my head), I have realised and I have been reminded time and again by repetitive negative experiences from life that, I need a friend. Someone who'll sit with me and talk. 

This evening in Rohini is so silent. And lonely.


If all the silence and loneliness of the world could give birth to a love story, I would've written a masterpiece tonight...

Saturday, December 25, 2021

Afterall, Delhi was not far

Current location: Delhi


Because, Delhi was not far. And for a lonely person to turn into even lonelier, what else can you think of?


Must be the gloomiest 25th December.


Silence. Loneliness. Darkness. Thou be my friend tonight. 🙂🙃

P. S.: I followed my star here. Rohini is the place I'm staying in. 😛

Friday, July 2, 2021

পরিযান

পরিযান ব্যাপারটা মানুষের জীবনের  অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে l আমাদের জীবনে পরিযায়ী মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে ll

শেষ দশ বছরে নিজের জীবনে কতগুলি মানুষকে আসতে যেতে দেখেছেন?

Tuesday, June 1, 2021

বার্ড বলে কেউ নেই ll

 একটা খেলা আমি মাঝে মধ্যেই খেলে থাকি, যেটা হলো এরকম... ধরুন একটা বাক্য রয়েছে, এবার সেটার শেষ অংশটিকে পরিবর্তন করে ছোটো করে দিতে হবে l এইভাবে ধাপে ধাপে ছোটো হতে হতে এরকম জায়গায় আসবে যে বাক্যটি আর থাকবেই না, তখন খেলা শেষ  হয়ে যাবে l একটা উদাহরণ দিয়ে আমি বোঝানোর চেষ্টা করছি  ll


অনেক ছোটো বয়সে ময়ূখ চৌধুরীর একটা গল্পের বই পড়েছিলাম, নাম 'ভয়াবহ শিকার কাহিনী' l তাতে এরকম একটা লাইন ছিল :


"জ্বলন্ত সিগারেটটা মুখ থেকে নামিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বার্ড বললো, "জায়গাটা তোমার কেমন লাগছে অ্যান্ডি?" "


এটাকে প্রথম ধাপে ছোটো করা যায় এইভাবে :

"জ্বলন্ত সিগারেটটা মুখ থেকে নামিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বার্ড অ্যান্ডির দিকে তাকিয়ে রইলো " (বার্ড এবং অ্যান্ডির কথোপকথন এখানে ছেঁটে ফেলা হলো)


এবং পরের ধাপ গুলো এইভাবে বানিয়ে ফেলা যায় :

"জ্বলন্ত সিগারেটটা মুখ থেকে নামিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বার্ড তাকিয়ে রইলো " (এখানে অ্যান্ডিকে বেমালুম ছেঁটে ফেলা হয়েছে )


"জ্বলন্ত সিগারেটটা মুখ থেকে নামিয়ে বার্ড ধোঁয়াটাকে বেমালুম গিলে ফেললো" (এখানে ধোঁয়া আর এই পৃথিবীর আলো দেখলো না )


"জ্বলন্ত সিগারেটটা বার্ড মুখ থেকে নামালো না" (বার্ড - এর শারীরিক পরিশ্রম টিকে বাদ দেওয়া গেলো)


"বার্ড সিগারেট খায় না" (এখানে যে প্রাথমিক অনুমান, যার ওপর পুরো বাক্যটি দাঁড়িয়ে ছিল তাকেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাই বাক্যটির মেরুদন্ড বা মূল অর্থ কিছুটা বিকৃত হয়েছে )


"বার্ড বলে কেউ নেই" (এই ধাপে আমরা নাম ভূমিকাকেই সরিয়ে নিয়েছি, তাই এখানেই খেলার শেষ)


একঘেয়ে জীবনের ফাঁকে যে কোনও কথোপকথন নিয়ে এই খেলাটি খেলে দেখতে পারেন ll

Thursday, May 27, 2021

Kakolukiyam

The tables are going to turn, sooner than you can think.

About crows and owls.

Thursday, May 6, 2021

অচিনপুরের ইতিকথা

পর্ব এক : 


একফালি ঘর, একটু উঠান l

শহর থেকে দূরে, এই মোর সংস্থান ll


সাইকেল রিকশাটা যখন ঠুনঠুন শব্দ করে একটা অতি পুরোনো পুকুরের পাড় বরাবর পুরোটা ঘুরে নিয়ে এসে আমাকে একটা শতাব্দী প্রাচীন, ইঁট সুরকি বের হওয়া, হাড় জিরজিরে ঘরের সামনে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো, আমার হাতঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে চারটে বাজে l সময়টা অক্টোবরের শেষ, পৌনে পাঁচটায় সূর্যাস্ত l আর সূর্যাস্তের সময় থেকেই গ্রামের এই জায়গাগুলোয় একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে দেয় l আমি অবশ্য ট্রেন থেকে নামার সময়েই গায়ে একটা শাল ভালো করে জড়িয়ে নিয়েছিলাম l সেই থেকে ঠান্ডার কামড়টা আর অনুভব হচ্ছে না l


স্টেশন থেকে নেমে সাইকেল রিকশাতে এখানে পৌঁছতে সময় লাগলো ঠিক বারো মিনিট l স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা পাকা রাস্তা এসে মিশেছে একটা কাঁচা রাস্তায় l সেই রাস্তা উত্তর থেকে দক্ষিণে সোজা এসে গ্রামের শেষপ্রান্তে বসতবাড়িগুলোয় মিশেছে l রাস্তার পূর্বপ্রান্তটা জুড়ে একটা সরু নদীর চর l পশ্চিমপ্রান্তটা গ্রামের ঢুকে পড়েছে l সেখানে একে একে ধানের জমি, খেলার মাঠ, দুটো বড় পুকুর, এবং শ্মশান l শ্মশান আর চাষের জমিগুলোর মাঝখানে বড় একটা বহু পুরোনো দিনের ইঁটের দেওয়াল, জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে l গ্রামটা যেমন খুব একটা বড় নয়, তেমনি বসতিও খুব কম l বারো - তেরোটি ঘর লোকের বসবাস l 


এরা সবাই খুব গরীব l নিজেদের জমি আছে বটে তবে ফসল ভালো হয় না l গ্রামের একপ্রান্তে এই ত্যাজ্য ঘরটিতে থাকবো এবং তার পরিবর্তে গ্রামের আট দশটি বাচ্চাকে পড়াবো শুনে তাই এরা রাজি হয়ে গিয়েছিলো l এমনিতে এ গ্রামে মোড়ল জাতীয় কেউ নেই l তবে এই ঘরটিতে এই গাঁয়েরই এক লোকের নিজের ভাই বসবাস করতো l লোকটির নাম হলো নিতাই মন্ডল l কয়েক বছর আগে সেই নিতাইয়ের ভাই ও ভাইয়ের বউ মারা যাওয়ায় সেযাবৎ ঘরটি ফাঁকাই পড়ে ছিল l গাঁয়ের বাচ্চাদের পড়াবো একথা শুনে আর মাসিক ভাড়ার কথা ওঠেনি l দুই পক্ষেরই লাভ l


এখানে অবশ্য আমার আসা শুধুমাত্র বাচ্চাদের পড়ানো বা ছুটি কাটাতে নয় l 


রিকশাটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার ঠুনঠুন করতে করতে স্টেশনের দিকে চলে গেলো l এখানে এই স্টেশনের আশেপাশে আট দশটা গ্রাম l সারাদিন রিকশা চালিয়ে কিভাবে ওদের পেট চলে তা শুধুমাত্র ওরাই জানে l 


সূর্যের আলো কমে এসেছে l মিনিট দশেকের মধ্যেই আলো ফুরিয়ে অন্ধকার নামবে l কাঁধের ব্যাগ আর বিছানাবালিশ গুলো নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া গেল l সাকুল্যে একটাই মাত্র ঘর, সংলগ্ন একটা রান্নাঘরের মতন ছোট্ট একফালি জায়গা আছে l অদ্ভুত ব্যাপার এই হলো যে, ঘরের মধ্যে কোনও প্রস্রাবাগার নেই l যা করার করতে হবে বাইরেই, মাটির তৈরি উঠোনের একপাশে, খোলা আকাশের নিচে l গাঁয়ের অশিক্ষা এবং গরীবিয়ানা এদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের দিকে প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে l 


পুরো ঘরটা ঝাড়াঝাড়ি করে বিছানা পেতে যখন আরাম করে বসে নিতাইয়ের দিয়ে যাওয়া লন্ঠনটা জ্বেলে বসলাম তখন সন্ধ্যে সাতটা l এখানে সূর্য্য ডোবার পর সাড়াশব্দ খুব কমে যায় l একে গ্রামটা খুবই ছোটো, সেটা আগেই বলেছি l তার ওপর এখানে আসার পথে ট্রেনে কয়েকজন লোকের মুখে শুনলাম কাছাকাছি গ্রামে কোথাও দু'-একদিনের মধ্যেই দেখা দিয়েছে এক বাঘ l মানুষ এখনও সে নেয়নি কিন্তু নিতে আর কতক্ষন !


কি অদ্ভুত এদের জীবন l 


আজকের রাতটা এভাবেই কাটবে l যে জীবন ছেড়ে আমি এসেছি সেকথা নয়, বরং যে জীবন আমি মাথা পেতে নিয়েছি তা ভাবতে ভাবতে l লন্ঠনের মৃদু আলো, নিতাইয়ের ভাইয়ের মৃত্যুর পর পরিত্যক্ত এই ঘর, সোঁদা পানাপুকুর আর বট-নারকেলের ছায়াঘেরা মাঠ - এই হোক আমার জীবন l নিঃশব্দ, একাকিত্ব আর অন্ধকার - এই নিয়েই হোক আমার জীবন l এই দশ - বারো ঘর অশিক্ষিত, গ্রাম্য, সরল, সাদাসিধে মানুষ হোক আমার সঙ্গী l


একটা বছর দেখতে দেখতেই কেটে যাবে ll

শ্রাবনীকে লেখা শেষ চিঠি

 শ্রাবনী,


তোমার বিয়ের ছবিগুলো দেখলাম l ভালো লাগলো এটা দেখে যে, যে তুমি একদিন বলতে "বিয়ের কথা বললেই কথা বন্ধ করে দেবো" সেই তুমি ছবিগুলোতে আজ লাল বেনারসী পরে লজ্জা লজ্জা মুখ করে নিজের বরের দিকে তাকিয়ে আছো l আরো ভালো লাগলো এটা দেখে যে, যে তুমি একদিন বলতে "অনাবাসী ভারতীয় তো কক্ষনো নয়", সেই তোমাকেই একজন অনাবাসী ভারতীয়কে বিয়ে করে অনেক, অনেক দূরে চলে যেতে l আমাদের মধ্যের দূরত্ব আর কয়েকটা পাড়ার নয়, কয়েকটা মহাসাগরের l 


আচ্ছা, আকাশকুসুম জাহাজ বানিয়ে কি মহাসাগর ডিঙ্গোনো যায়? তাহলে হয়তো আর একবার তোমার সাথে দেখা হলেও হতে পারতো...


মনে আছে শেষবার যখন কথা হয়, আমি বলেছিলাম, "আশা করি এই পৃথিবীর বুকেই কোথাও আরো একটা সমান্তরাল বিশ্ব রয়েছে যেখানে হয়তো আমাদেরই মতো দেখতে দুজন মানুষ রয়েছে, হয়তো অন্যভাবে, অন্য সম্পর্কে l"


সমান্তরাল বিশ্বের স্বপ্নগুলো জানো, অনেকদিন হলো দেখা ছেড়ে দিয়েছি আমি... হয়তো নিজের ভালোর কথা ভেবেই l


আমাকে দিয়ে জোর করে যে দুটো গল্প লিখিয়েছিলে সেগুলো একটা পত্রিকাতে ছাপা হয়েছে... যদিও সেটা তোমার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর l তাই সে খবরটা জানার সুযোগ তোমার আর হয়নি l তাই এখন চিঠিতেই বলছি l পত্রিকার সম্পাদক ভদ্রলোক একরকম ভালোই, যদিও বড্ড কম কথা বলেন l


এক একদিন যখন বিকেলের দিকে একা ময়দানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করি, বা প্রিন্সেপ ঘাটে চলতে চলতে সন্ধ্যেবেলা সেই নকুল মাঝির জোরাজুরিতে নৌকো করে গঙ্গার বুকে ঘন্টাখানেক হাওয়া খেয়ে ফিরি, বা হয়তো রবীন্দ্র সরোবরের ধারে গিয়ে ফাঁকায় একটু বসি... মিথ্যে বলবো না, তোমার কথা মাঝে মাঝে মনে পড়েই যায় l যদিও সঙ্গে সঙ্গে এটা ভেবে কান ধরি যে অন্যের বৌয়ের কথা চিন্তা করাও পাপ l 


বিশ্বাস করো যেটুকু জল চোখ থেকে ঝরে পড়ে সবটুকুই তৎক্ষণাৎ মুছে ফেলি, গুমরে ওঠার এতটুকু আওয়াজ অব্দি কেউ পায় না l


অনেক পুরোনো কথাই আজ মনে আসছে কিন্তু এখন আর লাভ নেই l চিঠি শেষ করতে হবে, মনটা আজ ভালো নেই l


পুনশ্চ: এই চিঠি তুমি কোনোদিনও হাতে পাবে না, শ্রাবনী l কারণ ঠিকানাটা তোমার দেশের বাড়ির দিলাম... যেখানে এখন আর কেউ থাকে না l ভালো থেকো l ভুলে যেও ll

Sunday, January 24, 2021

ব্রহ্মদৈত্য


গ্রামের সকলে জানত, গ্রামের শেষপ্রান্তে যে বটগাছটা আছে, ওটার মগডালে একটা ব্রহ্মদৈত্য থাকে l


গ্রামের এক নাপিতের কাছে সকলের যাতায়াত l প্রতি রবিবার নাপিতের দোকানের বাইরে জটলা বসে l চারদিন আগে গ্রামের দুই লোক সন্ধ্যেবেলা ফেরার পথে ব্রহ্মদৈত্য দেখে অজ্ঞান হয়েছিলেন l হাজার পাঁচেক টাকাও হারিয়েছেন l দুই বুড়ো পরিষ্কার দেখেছে, মাটি থেকে বিশ হাত ওপরে গাছের ডালে সেই চেহারা l সাদা ধুতি, আদুল গায়ে পৈতে, সাদা মুখ ধবধব করছে l


            নাপিতের হাতে কাঁচি চলে চটপট l ক্ষুর চলেছে যেন মাখনের মতন l তার মনে পড়ে আছে পাশের গ্রামে, সেঁজুতির কাছে l জাত আর বয়সের ফারাক সেঁজুতির বাপ মেনে নেবে না l সে শুধু টাকা চিনেছে l


            পাশের গ্রাম থেকে বাঘ বেরোনোর কথা শোনা যায় l ইতিমধ্যে একদিন মোড়ল পাশের গ্রাম থেকে ফেরার পথে বটগাছের ওপর ব্রহ্মদৈত্য দেখে l তার হাতের হুঁকো খানা খুব চেনা চেনা l এ তো গত মাসে তারই বাড়ি থেকে চুরি গিয়েছিল না?


                                নাপিত আবারও সেঁজুতির সাথে দেখা করে l টাকায় বাপ মেয়ের মাথা খেয়েছে l সে সরাসরি না করে না l কিন্তু আশাহতও করে না l সে জিজ্ঞেস করে, "কতো টাকায় আমাকে কিনতে পারবে?"


ইতিমধ্যে গ্রামের এক মুরুব্বি মানুষ - এর মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার সময় ভিরমি খায় l বটগাছের ব্রহ্মদৈত্য নাকি গাছ থেকে নেমে এসে তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছে, "এতো গয়না তোমার কি কাজে লাগবে, দিদিভাই?"


                মোড়ল আর সব মুরুব্বিরা শলাপরামর্শ করে গাছটাকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় l কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে গাছ কাটিয়েরা সেই গাছে হাত লাগাতে চায় না l এদিকে পরের মাসে মোড়লের ছেলের বিয়ে l


         নাপিত সেঁজুতির বাপের কাছে গিয়ে তাকে বেশ কিছু টাকা দেয় l সে লোক জানায় যে তারা জাতে ব্রাহ্মণ, তাই বিয়েতে রাজি হলেও নাপিতকে তার মেয়েকে নিয়ে পালাতে হবে অন্যত্র l এবং টাকা লাগবে আরো দুগুন l নাপিত আরো একমাস সময় চায় l


মোড়লের ছেলের বিয়ের আগের দিন মোড়লের দুই পালোয়ান সাকরেদ নাপিতের কাছে চুল কাটাতে আসে l মোড়ল নাকি ব্রহ্মদৈত্য কে নিজে হাতে মারবে একথা তাদের কাছে শোনা যায় l মোড়ল তাই তাদের দুজনকে বিয়েতে ছুটি দিয়ে দিয়েছে l


নাপিত পরদিন চুপি চুপি গ্রাম ছাড়ে l রেলস্টেশন গিয়ে শহরের টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে বসে সে l পরের স্টেশনে নেমে সন্ধ্যে অবধি অপেক্ষা করে l তারপর পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরে এসে বটগাছের ওপর চড়ে বসে l মুখে ভালো করে ছাই ঘষে, নতুন পাটভাঙ্গা ধুতি পরে, পৈতেটা গায়ে জড়িয়ে নেয় l


মাঝরাতের পর মোড়লের ছেলে বিয়ে করে ফেরে, সঙ্গে পালকিতে তার বিয়ে করা বউ l


        গাছ থেকে যথারীতি ব্রহ্মদৈত্য নেমে আসে l মোড়লের ছেলে ঘোড়া ছুটিয়ে উধাও l পালকির ভেতর উঁকি মারতে দেখা যায় নতুন বউ নয়, স্বয়ং দুই পালোয়ান সাকরেদ মজুত l তারা ব্রহ্মদৈত্য রূপী নাপিতের প্রাণ নেয় l


        অষ্টমঙ্গলায় মোড়লের ছেলের বউ সেঁজুতি তার বাপের বাড়ি যায় l পরে বাপের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যে নামে l বটগাছের তলা দিয়ে আসার সময় ওপরে ধোঁয়া দেখে সেঁজুতির মনে হয় ঘন পাতার আড়ালে কেউ যেন বসে হুঁকো টানছে l মোড়লের ছেলে মস্করা করে বলে, "মানুষ মরলে তো ভূত হয়, ব্রহ্মদৈত্য মরলে কি হয় তবে?"


সেঁজুতি কিছু বলতে পারেনা l বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে সে শুধু বটগাছের দিকে তাকিয়ে থাকে ll






Sunday, December 13, 2020

একা মানুষ

এক একটা মানুষ হয়, লেপার্ডের মতো l একা একা থাকে, আড়ালে-আবডালে l লুকিয়ে থাকে অন্ধকারে l


লেপার্ড যে সবসময় শিকার ধরার জন্যই একা একা, আড়ালে থাকে তা কিন্তু নয়... কিছু কিছু জন্তু আসলে রহস্যময়তা পছন্দ করে l আর একাকিত্বর থেকে বেশী রহস্য আর কিসে আছে? কখনও কোনও রাতের জঙ্গল সাফারিতে গিয়ে এরকম মনে হয়েছে যে, এই যে দিগন্ত বিস্তীর্ণ প্রান্তর ঘেরা জঙ্গল সামনে, তাতে না জানি কতগুলো প্রেতসম জানোয়ার অপেক্ষা করে আছে? অপেক্ষা করে আছে গাড়ির হেডলাইটটা বন্ধ হওয়ার, গাড়িগুলোর আস্তে আস্তে চলে যাওয়ার l দূর থেকে তোমার গাড়ির চলে যাওয়ার শেষ চিহ্নটুকু দেখে নিজের কালো লোমশ শরীরটাকে আরেকবার চেটে পরিষ্কার করবে সে l তারপর পশ্চিমের আকাশে একফালি চাঁদটার দিকে তাকিয়ে একটা আলগোছে হাই তুলবে সেই লেপার্ড l আর তারপর তার কালো শরীরটা মিশে যাবে অরণ্যের নিকষ কালো অন্ধকারে l





Sunday, December 6, 2020

তুঙ্গভদ্রা

 এরকম একটা রাত

নক্ষত্রগুলো জ্বলে জ্বলে নিভে গেছে আকাশে

যেমন ল্যাম্পপোষ্টহীন রাতের সড়কে একা হেঁটে

অস্পষ্ট তুঙ্গভদ্রার ওপর দুটো মানুষকে ঘনিষ্ঠ দেখেছিলাম

সেরকম একটা রাতে

চুরুট আর গোলাপ আর কমলার গন্ধে মাখামাখি হয়ে

ডিসেম্বরের ঠান্ডায় মেয়েটার শুকনো ঠোঁট দুটো

ঠিক ঠিক কতগুলো রাত গেলে একটা ভালোবাসা আসে?




Friday, November 27, 2020

তোমাকে বলতে পারিনি ll

তোমাকে কতটা ঘৃণা করি, কোনোদিন বলতে পারিনি l আসলে এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেছি তো... হয়তো তাই l

তোমার বার বার ছেড়ে চলে যাওয়া, উদ্দাম হাসির সাথে সাথে প্রতিবার অজানাকে নিজের করে নেওয়া l

নিজেকে আমার থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নেওয়া কোনোদিন ভুলতে পারিনি l

মনের গভীর থেকে বলছি, কতটা ঘৃণা করি, কোনোদিন বলতে পারিনি l 


এখন যদিও আর এসবের কোনো মানে হয়না

তুমি বিবাহিতা, আর আমার একলা জীবন জেগে আছে 

সিগারেটের কটু গন্ধ, ময়দানে রবিবারের উড়ন্ত চিল 

আচ্ছা, পার্ক স্ট্রিটের ওই রেস্তোরাঁটায় কি এখনও পৌনে দু' ঘন্টা লাইন দিয়ে খেতে হয়? 

এখনও কি তোমার হাত ধরতে চেয়ে কেউ বকা খায়

ছুঁয়ে যায় তোমার কাঁধে কারো ভীরু ঠোঁট? 


অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে মাঝখানে তাই হয়তো... 

কিন্তু তাও জানিনা কেন, তোমার সাথে কাটানো এক একটা মুহূর্ত জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি 

আসলে, তোমাকে কতটা ভালোবাসি, কোনোদিন

মুখ ফুটে বলতে পারিনি ll

Monday, November 23, 2020

পাতা ঝরার পরে

ন্যাড়া গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, একা একা l নদীর কিনারায় পাথর বড় বড়, দু-তিনটে l একটা কাঠের পুরোনো বেড়া ভেঙে পড়েছে পাশেই l একটা জঙ্গুলে ঝোপ আছে, তাতে নাম-না-জানা ফুল ফুটেছে কয়েকটা l এই, ব্যাস l

            এদিকটায় কেউ সাধারণতঃ আসেনা l আমি এলাম l একলা নদীটা বয়ে চলেছে নিঃশব্দে l একটা নাতিদীর্ঘ গাছ দাঁড়িয়ে - রুক্ষ, শুকিয়ে যাওয়া ডালপালাগুলো ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় l ঝরে পড়া পাতাগুলো মাটির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্তুপ তৈরী করেছে l অদ্ভুত শান্তি, আশ্চর্য নীরবতা l

      নদীটার নাম কি, জানিনা l জায়গার নাম, তাও জানিনা l


              আসলে আমরা স্বপ্নের মধ্যে যা যা দেখি, সেগুলোর তো আর খোঁজ খবর নেওয়া সম্ভব হয় না l সেরকম জায়গা ভূভারতে আদৌ আছে কিনা, বা সেখানে আদৌ যাওয়া যায় কিনা, তাও জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না l

কয়েকদিন আগে যেমন হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম, বাংলা পরীক্ষা দিচ্ছি l কোন ক্লাসের বোঝা খুব মুশকিল, হয়তো টেন বা টুয়েলভ হবে, কারণ তারপর তো আর সাধারণতঃ বাংলা পড়তে হয়না l তো স্বপ্নে দেখলাম পরীক্ষা দিচ্ছি, মিনিট পাঁচেক বাকি হয়তো l হঠাৎই প্রশ্নপত্র উল্টে দেখলাম শেষের পাতার দুটো রচনা লেখা তখনও বাকি l চিন্তার চোটে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেলো l আর জানাও হল না, যে স্বপ্নে দেখা ওই বাংলা পরীক্ষার শেষটা কি হলো l

ঠিক যেমন এই স্বপ্নটা l শেষটা কি হয়, জানা যায়না l স্বপ্নটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখি l মূল স্বপ্নটা একই থাকে, কিন্তু এক এক সময়ে এক-আধটা জিনিস আলাদা দেখি l

                   যেমন, প্রথমবার যখন স্বপ্নটা দেখি তখন পুরো ব্যাপারটাই আবছা আবছা ছিল l একটা কালোকুলো মরা গাছ, আর একটা নদী l এর বেশী কিছু মনে ছিল না l আরো কয়েকবার দেখার পর বাকি জিনিসগুলো স্পষ্ট হলো l ঝরে পড়া পাতা, কাঠের বেড়াটা, জঙ্গুলে ঝোপের আগায় নাম-না-জানা ফুলগুলো, নদীর কিনারায় বড় বড় পাথরগুলো l

             একটা চিন্তা যেমন আমাদের মনে একবার ঢুকে গেলে আমাদের কল্পনার আশ্রয়ে সেটার ব্যাপ্তি সময়ের সাথে  ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, এটা অনেকটা সেরকমই l স্বপ্নটা দেখতে এমনিতে মন্দ লাগেনা, কিন্তু একটু একা একা, নিঃসঙ্গ লাগে l মানে ওই গাছটার কি না মরলেই চলতো না? নদীতে যদি দু একটা নৌকা চলতো তাহলে ভালো হতোনা কি?

তিনদিন আগে রাত্রে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নটা আবার এসেছিল l  আর এবার একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম l

              একটা গাড়ি l গাড়িটা চলতে চলতে যেন হঠাৎই থেমে গেলো l আর তারপরেই ঠিক সিনেমার কায়দায় সিন চেঞ্জ হয়ে চলে গেলো পরের দৃশ্যে l এবার একজোড়া পা ওই গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে পাশের রাস্তায় নেমে দাঁড়ালো l সেই পায়ে একজোড়া জুতো আর সেই জুতো আমার খুব চেনা l

কিছু কিছু বস্তু, গন্ধ, স্পর্শ - ইত্যাদির সাথে এক একটা স্মৃতি জড়িয়ে থাকে l যেমন, আমার স্কুলজীবনের একটা ঘটনা l তখন ক্লাস ফাইভ l আবাসিক স্কুলে থেকে পড়াশোনা করি l একদিন সন্ধ্যেবেলা জ্বর এলো l পরেরদিন স্কুলে যেতে পারলাম না l সেদিন পুরো স্কুলটাইমে আমি একা আমার ঘরে l আধা ঘুম আধা জাগার মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমাদের হস্টেল বিল্ডিং এর পেছন দিকে ঝরে পড়া পাতা একত্রিত করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে l সেই যে ধোঁয়ার গন্ধ জানলা দিয়ে সেই জ্বরের দুপুরে আমার স্মৃতির মধ্যে ঢুকে গেলো, তারপর সারাজীবন যেখানেই ওই ঝরে পড়া পাতা পোড়ানোর গন্ধ পেয়েছি, আমার মন এক নিমেষে ফিরে গিয়েছে সেই জ্বরে ভোগা দিনটায়, এক কিশোরের একা একা তার বিছানায় শুয়ে থাকা, তার নিজের বাড়ির থেকে সোয়া শো কিলোমিটার দূরে শুয়ে তার বাড়ির কথা চিন্তা করা l এর কোনও অন্যথা হয়নি, হবেও না l

            জুতোটা ছিল আমার কলেজজীবনের সঙ্গী l আর কলেজ বললেই প্রথম যে নামটা মনে আসে সেটা হলো, কামিনী l এখন অবশ্য ওই দুটোর কোনোটাই আমার জীবনে নেই l জুতোজোড়া অনেক দিন আগেই গিয়েছে হারিয়ে l আর, কামিনীও l

                        একটা ক্যুরিয়র এসেছিলো তিনদিন আগে l প্যাকেটটা রিসিভ করে ফেলে রেখে দিয়েছিলাম আউটহাউসে l আসলে দিনের বেশিরভাগ সময়টা আমার ওই আউটহাউসেই কাটে l তার কারণ অবশ্যই আমার বনসাই l বনসাই গাছ তৈরী করা আমার খুব ছোটবেলা থেকেই নেশা, এবং পরবর্তীকালে, পেশাও l বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা জোগাড় করে তাদের ধীরে ধীরে বড় করা এবং বনসাইয়ের রূপ দেওয়া, অথবা কোনও মৃতপ্রায় গাছকে নব্বই শতাংশ বাদ দিয়ে শুধুমাতেও একটিমাত্র ডালকে বাঁচিয়ে রেখে তাকে বনসাই তৈরী করা, এবং সেইসব গাছের তত্ত্বাবধান করা, এই সব কাজই আমি ওই আউটহাউসেই করি l আজকের দিনে, মানুষ যখন বিভিন্ন ধরণের গাছপালা বা বনসাই দিয়ে নিজেদের ড্রয়িংরুম বা বাগান সাজানো পছন্দ করেন, তখন একথা বলাই বাহুল্য যে বনসাইয়ের দাম ও কদর দুইই সময়ের সাথে উর্দ্ধমুখী l সারা বছরই আমি নিজের তৈরী বিভিন্ন বনসাইয়ের গাছ পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশে প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে যাই আর সেখান থেকে বিক্রিও ভালোই হয় l আর ভালো গাছপালা সংগ্রহের জন্য বছরের অনেকটা সময়েই আমি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াই l

আমার এই হেন অদ্ভুত শখের কারণ অবশ্যই আমার দাদু l ছোটবেলায় দাদুর সাথেই আমার গাছের পরিচর্যা এবং বাগান করার শখের হাতেখড়ি l দাদুর ছিল বিশাল বড় বাগান l আর সেই বাগানের প্রতিটি গাছের রক্ষণাবেক্ষণ, তত্ত্বাবধান উনি নিজের হাতেই করতেন l দুবেলা নিয়ম করে গাছে জল দেওয়া, সময়ে সময়ে মাটিতে বিভিন্ন সার দেওয়া, কাঁচি দিয়ে পুরোনো পাতা বা মৃতপ্রায় ডাল কেটে ফেলা - যাকে বলে প্রুনিং - এ সবই আমি দাদুর কাছ থেকে শিখেছি l

ছোটবেলার সেই শখটা রয়ে গিয়েছিলো l ইন ফ্যাক্ট, বনসাই গাছ তৈরির শুরুটাও তখনই হয়েছিল l পরে, অনেক পরে যখন বারুইপুরের বাগানবাড়িটা কেনা হলে তাতে একটা ডেডিকেটেড আউটহাউস তৈরী করেছিলাম বনসাইয়ের জন্য l দেশের বাড়িতে তৈরী করে রাখা সব পুরোনো গাছপালা আর বনসাইগুলোও পাকাপাকিভাবে স্থানান্তর করে ফেলেছিলাম l

দাদু মারা যান আমি তখন কলেজে পড়ি l কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে একটা শক দিয়ে যান l আমি দত্তক নেওয়া সন্তান l কথাটা আমাকে পুরোপুরি অবাক করে দিলেও পরবর্তী জীবনে যে খুব একটা তফাৎ করে দিয়েছিলো তা নয় l দাদুর মারা যাওয়ার পর বাবা ফিরলেন জার্মানি থেকে, মা আর ভাইকে ছাড়াই l আমিও জানতে দিলাম না দাদুর মৃত্যুর আগে আমাকে বলে যাওয়া আমার স্বরূপের কথা l তবে তাঁর সাথে ফিরে যেতেও সম্মত হলাম না l তাই দিন পনেরোর মধ্যেই দেশের বাড়ি পুরোনো বিক্রি করে কলকাতার অনতিদূরে, বারুইপুরে একটা পুরোনো বাগানবাড়ি কিনে দিলেন আমারই নামে l কয়েকদিনের মধ্যেই আমার আর দাদুর মিলে বানানো বহু চারাগাছ, বনসাই - সব নিয়ে চলে এসে পুরোপুরি সাজিয়ে নিয়েছিলাম নতুন বাড়িটাকে l বাবা ফিরে গেলেন ইউরোপ, দেশে আমার একাকী জীবন শুরু হলো l

সেই তখন থেকে শুরু করে আজ প্রায় বারো - তেরো বছর গাছের চারা সংগ্রহ, বনসাই অনুকূল গাছের খোঁজ ইত্যাদি আমি একাই করে এসেছি l দুজন লোক রেখেছি যারা গাছের পরিচর্যা করে l এর মধ্যেই আমার তৈরী বেশ কিছু গাছ বিদেশেও বিক্রি হয়েছে l সেরকম ভালো বনসাই তৈরী করা গেলে তার দাম কয়েক লাখের ওপর হয়ে যায় l তবে সেই জিনিস তৈরী করা যে খুব কঠিন তাই নয়, সময়সাপেক্ষও বটে l

              আজ প্রায় তিনদিন পর ক্যুরিয়রের প্যাকেটটা খুলে দেখার সময় হলো l চমকে যাওয়ার মতন খবর l বুধাদিত্যর বিয়ে l যে ছেলে সারা জীবন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই বুধা - আমার ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু l তাও করছে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং l মহীশূরের ললিত মহল প্যালেস হোটেলে l ইনভিটেশন কার্ডের সাথে ফ্লাইটের টিকিট পেলাম l আজ আঠারোই জুন বৃহস্পতিবার l আর আজ থেকে ঠিক দশদিন পর আঠাশে ওর বিয়ে l প্লেনের টিকিট বিয়ের একদিন আগের l

                      দিন তিনেকের মধ্যেই গোছগাছ করে ফেললাম l আমি মহীশূরে পৌঁছচ্ছি সাতাশের সকালে l এবং যেহেতু আঠাশের আগে হাতে সেরকম কোনও কাজ নেই, আমি ঠিক করেছি সাতাশ তারিখেই মহীশূর থেকে উটি ঘুরে আসবো l সাতাশের রাতে উটিতে থেকে আবার আঠাশের দুপুরের মধ্যে মহীশূর ফেরত l আঠাশের সন্ধ্যেবেলা বুধাদিত্যের বিয়ে l এবং বিয়ের পরের দিনই আমার রিটার্ন ফ্লাইট l

উটিতে যাওয়ার কারণ আর কিছুই নয়, মহীশূর থেকে উটি যাওয়ার পথে পড়ছে দু দুটো জঙ্গল, একটা বান্দীপুর ন্যাশনাল ফরেস্ট, যেটা কর্ণাটকের মধ্যে, আর তার পরেই - মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভ, যেটা তামিলনাড়ুর মধ্যে l এই দুই জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে আমার কাজ, এবং সেটা আমার নেশা ও পেশা সংক্রান্তই l

                 এখানে বলে রাখা ভালো, আমার সাথে আমারই বাগানের তত্ত্বাবধানে থাকা একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাবো ঠিক করেছি l ছেলেটির নাম ব্যোমকেশ l গাছপালা খুব ভালো চেনে, এবং আমার সাথে অনেকবার বিভিন্ন জায়গায় গাছপালা সংগ্রহের ব্যাপারে ঘুরে বেরিয়েছে l ও সঙ্গে থাকলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত l

ছাব্বিশে জুন, অর্থাৎ আমার যাত্রার ঠিক আগের দিন রাত্রে স্বপ্নটা আবার দেখলাম, এবং এবার সেই স্বপ্ন আরো বিস্তারিত l

           একটা আচমকা শিস দেওয়ার শব্দ, আর তাঁর সাথেই একটা ঝাঁকুনি l একটা গাড়ি যেন চলতে চলতে হঠাৎই থেমে গেলো l এবং তার থেকে দুটো পা বেরিয়ে এসে মাটিতে নেমে দাঁড়াল l সেই পায়ের জুতো আমার পূর্বপরিচিত l আমার কলেজ জীবনের বহুল ব্যবহৃত লাল সাদা জুতো l এর পর দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গিয়েই চলে আসে একটা নদীর কিনারা l বড় বড় পাথর l অবশ্য ভালো ভাবে দেখলে এটাকে নদী না বলে জলধারাও বলা চলে l বর্ষাকালে অনেক সময়ে পাহাড় পর্বতের দিকে এরকম জলধারা বয়ে চলে l

                  স্বপ্নটা অদ্ভুতরকমের দীর্ঘ l শেষ হয়েও শেষ হতে চায়না যেন l নদীটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি l আমার বাঁয়ে মরা একটা গাছ l পাতাগুলো সব ঝরে গিয়ে স্তুপ হয়ে আছে l আশ্চর্য্য একটা নীরবতা l

আর তারপরেই শুনলাম পেছনে পায়ের শব্দ l কেউ যেন দূর থেকে হেঁটে হেঁটে এসে আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে বললো, "কামিনীকে খুঁজে পাওয়া গেছে l"

আমার ঘুমটাও ঠিক তখনই ভেঙে গেলো l


ভোরের ফ্লাইটে বসে, কাঁধের ব্যাগটাকে ওভারহেড লকারে তুলে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে আয়েশ করে বসলাম l গোঁ গোঁ শব্দ এবং শুরুর ঝাঁকুনি বন্ধ হয়ে প্লেন যখন মাঝ আকাশে খানিকটা স্থিতিশীল হলো, একটু চিন্তা করার সুযোগ পেলাম l

                    কামিনী ছিল আমার কলেজেরই সহপাঠিনী l তবে প্রথমদিকে আলাপ হয়নি, তাই কথাবার্তাও সেরকম হতো না l কিন্তু কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে টেবিল টেনিস মিক্সড ডাবলস প্রতিযোগিতার জন্য যখন নাম নেওয়া হচ্ছিলো, ওই নিজে থেকে আমাকে এসে বলে ওর খেলার পার্টনার হওয়ার জন্য l আমি নিজে খুব একটা খারাপ খেলতাম না l কিন্তু সেবার টুর্নামেন্টে আমাদের জুটি কোয়ার্টার ফাইনালের বেশী এগোতে পারেনি l তবে টেবিল টেনিসের বাইরে আমাদের বন্ধুত্বটা টিকে গিয়েছিলো l বাকি তিন বছর কাটানোর পর কলেজের শেষ দিন আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিল ও l যে জিনিস ছিল আমার কল্পনারও বাইরে l

স্বভাবতঃই আমি 'না' বলেছিলাম l এবং তার কারণও ছিল l কামিনীকে আমি কোনোদিনও সেইভাবে দেখিনি l বন্ধুত্বের চেয়ে বেশী কিছু ওর কাছে আশাও করিনি l সেকথা সরাসরি বলেওছিলাম ওকে l কিন্তু তারপর আর ও যোগাযোগ রাখেনি আমার সাথে l পরে, অনেক পরে পস্তেছিলাম l এই ভেবে যে, হয়তো চিন্তা করে দেখলে ওকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেই আমার সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হতো l কিন্তু ওই, যে সময়টা চলে গেছে সেটা হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না l

ব্যাঙ্গালোরে একটা ফ্লাইট চেঞ্জ করে যখন মহীশূর পৌঁছলাম তখন সকাল সাড়ে ন'টা l ললিত মহলে পৌঁছে দেখলাম বুধাদিত্য আর ওর পরিবারের সবাই প্রায় চলে এসেছে l প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময় ইত্যাদির পর নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে তুললাম l প্রত্যেকটি ঘরে দু' জনের থাকার ব্যবস্থা l আমাদের ঘরে থাকছি আমি আর ব্যোমকেশ l পাশের ঘরে আমার স্কুলেরই আরো দুই বন্ধু থাকছে, কৌশিক আর অভিজিৎ l কিন্তু তারা এখনও এসে পড়েনি l

        আধ ঘন্টার মধ্যে স্নান সেরে বেরিয়ে দেখি দুই বন্ধু হাজির l এতদিন পরে দেখা, সবাই মিলে ঘরে তালা লাগিয়ে বাইরে লনে বসে গল্পগুজব শুরু করলাম l বুধাদিত্যও তাতে যোগ দিলো l বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে পরের দিন বিকেল থেকে l তাই আজকের দিনটা যে আমাদের জন্য ফাঁকা এবং আমরা চাইলে মহীশূর শহরটা ঘুরে দেখে নিতে পারি সেকথা বুধা আমাদেরকে মনে করিয়ে দিলো l এই ফাঁকেই আমি আমার নিজস্ব প্ল্যানটা বাকিদের জানালাম l কৌশিক তৎক্ষণাৎ আমাদের সাথে উটি যেতে রাজি l ওকে জানালাম যে যাওয়ার পথ দীর্ঘায়িত হতে পারে, পথে আমার কিছু নিজস্ব কাজের জন্য l ও বললো কুছ পরোয়া নেই, উটি নাকি ও কোনোদিন যায়নি এবং এই সুযোগ ও হাতছাড়া করতে চায়না l

                অভিজিৎ নিজের ক্যামেরা ও নানারকম সরঞ্জাম এনেছে মহীশূর প্যালেসের ওপর স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র করবে বলে l সে তখনই আমাদের 'অল দ্য বেস্ট' জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো l অন্যদিকে বুধাদিত্যও আমাদের গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়ে উঠে পড়লো l মিনিট পনেরোর মধ্যেই একটা ছাইরঙের টয়োটা ফরচুনার এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে, এবং তাতে চড়ে বসলাম আমি, কৌশিক আর ব্যোমকেশ l ব্যোমকেশ গাড়িতে তুলে নিয়েছে কলকাতা থেকে নিয়ে আসা ছোটো কয়েকটি যন্ত্র যা দিয়ে মাটি খোঁড়া বা গাছের বড়, চওড়া শেকড় কেটে ফেলা যায় l ঠিক দশটা বেজে চল্লিশ মিনিটে আমাদের যাত্রা শুরু হলো l

শহর ছাড়িয়েছি যখন প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ, মুষলধারে বৃষ্টি এলো l শহরের রোদ্দুরকে পেছনে ফেলে আকাশ এখন কালো মেঘে ঢেকে গেছে l এমন আবহাওয়ায় ভ্রমণ রোমাঞ্চকর তো বটেই, তবে আমার উত্তেজনার অন্য কারণও রয়েছে l

                           আরো প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর রাস্তার বামদিকে বড় বড় করে লেখা হোর্ডিং দেখা গেলো, "বান্দীপুর ফরেস্ট রিজাৰ্ভে আপনাকে স্বাগত l" ড্রাইভার চাপা গলায় বলে উঠলো, "যাঁহা সে জঙ্গল শুরু হোতা হ্যায় l" এবং এর আরো কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর পাওয়া গেলো একটা ফরেস্ট চেকপোস্ট l আর সেটা পেরোতেই আমার ব্যাগ থেকে বেরোলো ম্যাপ l

আশেপাশের জঙ্গল এবার ঘন হতে শুরু করেছে l আমরা জঙ্গলের 'কোর এরিয়া' - এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি l মহীশূর থেকে উটি যাওয়ার এই রাস্তায় পর পর দুটো জঙ্গল পড়ে l বান্দীপুর আর মুদুমালাই l এই রাস্তায় প্লাস্টিকের বোতলে জল নিয়ে যাওয়া বারণ l প্রকৃতিকে নিজের মতন করে সাজিয়ে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা l আমাদের প্রত্যেকের কাছেই কাচের বোতলে জল আছে l রাস্তায় তাই কাজে আসবে l

বামদিকে একটা ছোটো নালা পেরোনোর পর ড্রাইভারকে বললাম ডানদিকে চোখ রাখতে l ম্যাপ বলছে মূল রাস্তা থেকে এখানে ডানদিকে একটা সরু রাস্তা ঢুকে গেছে l এটা যাতায়াতের জন্য না হলেও গাড়ি চলাচলের জন্য একেবারে অব্যবহৃত নয় l  চেকপোস্ট গুলো থেকে মাঝে মাঝে দু' - একটা গাড়ি এদিকে টহল দিতে আসে একথা জানি l তবে আমার যা কাজ, তাতে মূল রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করানোয় সমস্যা l

                               রাস্তাটা খুঁজে পেতে খুব একটা সময় লাগলো না, এবং গাড়ি যখন সেই সংকীর্ণ রাস্তায় পাড়ি দেওয়া শুরু করলো, কৌশিকই প্রথম মুখ খুললো -

"তোর মতলবটা কি বলতো?"

"আর কিছুই না," আমি গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললাম, "যাওয়ার পথে ঘন্টাখানেক দেরি হলে আশা করি সমস্যা হবে না, তার মধ্যে আমার একটা কাজও হয়ে যাবে l"

"এই কাজটা ঠিক কি?" কৌশিকের গলায় সন্দেহ l

                         "তোর মনে আছে কিনা জানিনা, আগের বছরের গোড়ার দিকে এই জঙ্গলে একটা আগুন লাগার ঘটনা ঘটে l দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ঘটনাটা ঘটানো হয়েছিল l একদল চোরাশিকারী হঠাৎই বান্দিপুরের কোর এরিয়াতে ফরেস্ট রেঞ্জারদের হাতে ধরা পড়ে l সকলকে শুধুমাত্র সাবধান করে দিয়ে জঙ্গল থেকে বের করে দেওয়া হলেও তারা রাগের বশে পরে ফিরে এসে জঙ্গলের একটা অংশে আগুন লাগিয়ে দেয় l"

"ইয়েস, এটা তো খবরেও এসেছিলো l"

"হ্যাঁ l অনেক গাছপালা পুড়ে যায়, প্রচুর জীবজন্তুও মারা পড়ে l মর্মান্তিক ব্যাপার l "

"কিন্তু এর সাথে তোর কাজের কি সম্পর্ক?"

"বলছি l গাছপালা নিয়ে খুব ছোটো থেকেই কাজ করার সুবাদে এটা আমি জানি যে এই ধরণের আগুনে ঝলসে যাওয়া মৃতপ্রায় গাছপালাকে যদি ঠিকমতো কেটে ছেঁটে, স্থানান্তরিত করে উপযুক্ত যত্নআত্তি করা যায় তবে সেই গাছপালার আবার আগের মতন বৃদ্ধি শুরু হতে পারে l পুরোনো জায়গায় রয়ে গেলে যেটা কখনোই হয়তো সম্ভব নয় l এখানেই আসছে আমার ভূমিকা l আমি চাই জঙ্গলের এই অংশে যেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ফলে প্রচুর গাছের ক্ষতি হয়ে গিয়েছিলো, সেখান থেকে খুঁজে কয়েকটা অগ্নিদগ্ধ মৃতপ্রায় গাছ জোগাড় করে নিয়ে যাবো, যাতে আমার কাছে কলকাতার বাড়িতে সেগুলো যত্নআত্তি পেয়ে আবার আগের মতন বেড়ে উঠতে পারে l"

"তারপর?"

"তারপর আর কি? সময় এলে সেগুলোর বনসাই বানিয়ে বিক্রি করে দেবো l গাছটাও বাঁচলো, আমারও দু-পয়সা রোজগার হলো l কিন্তু এটা নিশ্চিত জেনে রাখ যে এই আগুনে পোড়া জঙ্গলের অংশে রয়ে গেলে সেই সব গাছে আর কোনোদিনই হয়তো সবুজের আভা আসবে না l"

                     পুরো ব্যাপারটা শোনার পর, জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গাছপালা খোঁজাখুঁজির ব্যাপারটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেই নিয়ে কৌশিক খানিকটা গাঁইগুঁই করলো l তবে আমার বিশ্বাস, দিনের বেলা কোনও হিংস্র জন্তু জানোয়ারের সম্মুখীন না হওয়াটাই স্বাভাবিক l জঙ্গলের জানোয়াররা সাধারণতঃ মানুষকে ভয় করে এবং একলা থাকতে পছন্দ করে l মানুষ আর জঙ্গলের জানোয়ারের চরিত্র আলাদা, তাই তাদের চারণভূমিও আলাদা l

গাড়ি ধীরে ধীরে চলেছে l এদিকের রাস্তা সংকীর্ণ, দুপাশের বৃক্ষরাজি যেন মাথার ওপরে গাঢ় সবুজের চাঁদোয়া বিছিয়ে রেখেছে l একদল হরিণকে দেখলাম রাস্তার পাশেই জঙ্গলে চড়ে বেড়াচ্ছে l একটা বেঁটে খাটো শিশু গাছের মরা কাণ্ডের ওপর বসে রয়েছে একটা ময়ূর l কয়েকটা বাইসনও দেখা গেলো l ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিরুদ্বেগে ঘাস খাচ্ছে l

গাড়ির মধ্যে সকলেই এখন নিশ্চুপ হয়ে বাইরের প্রকৃতির শোভা দর্শন করছে l সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছি আমি, পেছনের টানা লম্বা সিটে বাঁদিকে কৌশিক আর ডানদিকে ব্যোমকেশ l ব্যোমকেশকে আগেই বলা আছে, আমাদের পছন্দসই গাছ দেখতে পেলেই গাড়ি দাঁড় করাতে বলবে l ও গাড়ির ডানদিকটা লক্ষ্য রাখছে l জঙ্গলের সামনের দিকটা আর বামপাশটা থাকছে আমার নজরে l

                          প্রায় মিনিট দশেক চলার পর দূরে একটা গাড়ি নজরে এলো l সাদা, প্রাইভেট গাড়ি l এটা ফরেস্ট অফিসারদের নয় l গাড়িটা থেমে আছে এবং কাছে আসতে বোঝা গেলো বনেট খোলা এবং তার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে খুটখাট করছে একজন l

আমাদের গাড়ির গতি কমে এসে থেমে থাকা গাড়ির একদম পাশাপাশি চলে এলো l এবার পাশের গাড়ির পেছনের সিটের ডানদিকের জানলা দিয়ে যে মুখটি বেরিয়ে এলো তাকে অনায়াসে একজন ক্লাউনের ভূমিকায় কল্পনা করা যায় l টাকমাথা, পাতলা করে ছাঁটা গোঁফ, মিনমিনে চোখ আর দেঁতো হাসিতে প্রথম সম্বোধনটা উড়ে এলো আমার দিকেই -

"এই, এই... ইয়ে মানে, হেল্প প্লিজ!"

         ইনি বাঙালি l অগত্যা গাড়ি থেকে নামতে হলো l এবার আমাদের নামতে দেখে উনিও গাড়ির দরজা খুলে নেমে এগিয়ে এলেন l 

                   এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখ চলে গেলো ওনার পায়ের দিকে l

ওই জুতো!

এ জিনিস আমার চেনা l কলেজ জীবনের বহুলব্যবহৃত লাল আর সাদা ডোরাকাটা এই জুতো গত বেশ কিছুদিন যাবৎ বার বার ফিরে এসেছে আমার স্বপ্নে l মাথাটা কেমন যেন টাল খেয়ে গেলো l

           এর মানে কি এই ভদ্রলোকের সাথে কামিনীর কোনও সম্পর্ক আছে?

                        কৌশিক, ব্যোমকেশ আর আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ততক্ষনে নেমে এসে কথাবার্তা শুরু করেছে l যা বোঝা গেলো, ভদ্রলোক পক্ষীবিদ, নাম পান্নালাল চট্টরাজ, নিবাস কলকাতা এবং এখানে আসার উদ্দেশ্য হলো নীলগিরিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পাখির ছবি তোলা ও তাদের পর্যবেক্ষণ করা l বর্তমানে তাঁর গন্তব্যস্থল ছিল উটি কিন্তু গাড়ি মাঝপথে খারাপ হয়ে পড়ায় সেই কাজে পড়েছে বাধা l

          ভদ্রলোককে অফারটা কৌশিকই প্রথম করলো l আমাদের গাড়িটা যথেষ্ট বড় l তাই উনি স্বচ্ছন্দে আমাদের সাথে উটি অবধি আসতে পারেন l ভদ্রলোক দেখলাম বেশ খুশী হয়েই নিজের গাড়ি থেকে ব্যাগ বের করে নিয়ে এসে আমাদের গাড়িটায় উঠে পড়লেন l

                   গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে l এবার সামনে চালকের পাশে ব্যোমকেশ l পেছনের টানা লম্বা সিটে বামদিকে কৌশিক, মাঝখানে মিঃ চট্টরাজ আর ডানপাশে আমি l আমার চোখ বারবারই চলে যাচ্ছে ভদ্রলোকের পায়ের দিকে l ঠিক এই জিনিসই আমি কিছুদিন ধরে দেখছি স্বপ্নে l তাহলে কি স্বপ্নটার সাথে ওনার কোনও যোগাযোগ আছে? কামিনী কি ওনার চেনা কেউ...?

কামিনীর কথা বারবার মনে পড়ছে l এই একটা মানুষের কথা জীবনের এতগুলো বছর ভুলে থেকেও আজ বুঝতে পারছি, সেটা ঠিক করে ভোলা হয়ে ওঠেনি l একটা মানুষ নিজে থেকে এসে দাঁড়াতে চেয়েছিল আমার পাশে l এবং অচেনা অজানা কেউ নয়, সে ছিল আমার বন্ধুই l কিন্তু যে আসনে সে আমাকে বসিয়েছিলো সেই কদর আর সম্মান তাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি l আজ বুঝতে পারি, কোনও মানুষের ভালোবাসাকে চিনে, বুঝে, জেনে তাকে সেই অধিকারবোধের সম্মান করার জন্য অনেক বড় একটা হৃদয়ের দরকার হয় l হয়তো সেই জিনিসটাই আমার ছিল না, তাই 'না' বলেছিলাম l ওর আয়ত টানা টানা চোখে আমার চোখের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিল কামিনী l শুধু বলেছিলো, "যদি কখনও জীবনে এই মত পরিবর্তন করো তবে জানিয়ো, আমি এখানেই আছি l"

                     আর তারপর ও চলে গিয়েছিলো l সত্যি কথা বলতে তারপর কোনোদিনই আর ওর কাছে আমি ফিরে যাইনি l হয়তো বাঁধা পড়ার ভয়ে l হয়তো নিজের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে, যে আমার মনে হয়তো ওর জন্য কিছুটা হলেও ভালোবাসা ছিল l কিন্তু করলাম কি, যেটা পুরুষ মানুষের করা উচিত, মনটাকে একদম কাঠের মতন শক্ত করে রইলাম l

                 আজ এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি যৌবনের সেই রঙীন দিনের পাতাগুলো ঝরে পড়ে গেছে জীবন থেকে l ভেতরে ভেতরে পুরোনো হয়ে পড়েছি আমি l হয়তো বা একটু আলতো টোকা মারলে ভেঙেও পড়তে পারি l


         আড়চোখে একবার মিঃ চট্টরাজের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম l ঈষৎ হাসিমুখ, বাইরের জঙ্গলের দিকে চেয়ে প্রকৃতির শোভা দেখছেন l গায়ে ফুল আঁকা হাফ শার্ট l ভদ্রলোককে দেখলে অনেকটা যাত্রাপালার কোনও মজার চরিত্রের সাথে মিল পাওয়া যায় l

এদিকের জঙ্গলটা বেশ ঘন l আবারো একদল হরিণ দেখলাম l নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে l জঙ্গল যেন এই সব জন্তু জানোয়ারদের তুলির রঙে সযত্নে তার বুকে এঁকে দিয়েছে l ইতিমধ্যে আর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো l আমরা নীলগিরির খুব কাছে এসে পড়েছি তাই এখানে বৃষ্টি হওয়া মানেই তাপমাত্রাটা এক ঝটকায় অনেকটাই নেমে যায় l যদিও ঘড়ির কাঁটা বলছে দুপুর একটা বেজে পনেরো মিনিট, তাও বৃষ্টির দরুণ ঠান্ডাটা গায়ে লাগতে আরম্ভ করলো l

সরু রাস্তাটা জঙ্গলের মধ্যে গোল হয়ে ঘুরে যেখানে মূল রাস্তাটার সাথে মেশে, তার কয়েক কিলোমিটার আগেই আমরা গাড়ি থামালাম l এই জায়গাটা দৃশ্যতই দাবানলের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত l বুনো ঝোপজঙ্গল কম, জায়গায় জায়গায় জঙ্গল পুড়ে যাওয়ার ছাপ স্পষ্ট l মোদ্দা কথায়, আমার বনসাইয়ের জন্য গাছ খোঁজার জন্য আদর্শ l

ড্রাইভার ছাড়া আমরা সকলেই নেমে পড়েছি গাড়ি থেকে l ব্যোমকেশ আর আমি গাড়ি থেকে নেমেই বামদিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম l এদিকটার জঙ্গল বেশ খোলামেলা, একটু ছড়ানো ফাঁকা জায়গা রয়েছে l মধ্যে মধ্যে দুটো তিনটে করে গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে l কৌশিকও দেখলাম আমাদের পেছনে আট - দশ হাত তফাতে রাস্তা থেকে নেমে আমাদের অনুসরণ করলো l একটা শিশু গাছ চোখে পড়লো এবার l তাঁর পাশেই একটা গোল্ডেন শাওয়ার ট্রি, কয়েকটা আমলকি গাছ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে l

"কিছু পেলেন?" মিঃ চট্টরাজ দেখলাম নেমে আসছেন রাস্তা থেকে আমাদের দিকে l

"দেখছি l এদিকে কিছু না হলে রাস্তার ওপাশটায় একবার দেখবো" আমি গলা চড়িয়ে উত্তর দিলাম l ভদ্রলোকের জুতোটা বারবার আমার মনে সন্দেহের দোলাচল তৈরী করছে l স্বপ্নে যদি এনারই পা জোড়া দেখে থাকি, আর এনার সাথে কামিনীর যদি সত্যিই কোনও সম্পর্ক থেকে থাকে...

    "এদিকে!" ব্যোমকেশের গলার আওয়াজ পেলাম এবার l দেখলাম ওর চোখ ছোটোখাটো একটা খয়ের গাছকে চিহ্নিত করে ফেলেছে l এটার ওপরের অনেকখানি অংশই দাবানলের আগুনে জ্বলে গিয়েছে l মাটি থেকে দেড় হাত ওপরে একটা অদ্ভুতভাবে বাঁক খেয়ে উঠেছে, তাতে বনসাই বানানোর কাজটা খুব সহজ হবে আর জিনিসটা তৈরিও হবে খুব সুন্দর l ব্যোমকেশকে সঙ্গে সঙ্গে বললাম যন্ত্রপাতি গুলো বের করে ফেলতে l আর ঠিক সেই সময়েই ঘটনাটা ঘটলো l

            খয়ের গাছটা থেকে পঁচিশ তিরিশ ফুট দূরে আগেই উল্লেখ করা শিশু গাছটা, যেখানে মিনিট দুয়েক আগেও আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম l সেই গাছের ঠিক নিচেই এখন দাঁড়িয়ে কৌশিক আর মিঃ চট্টরাজ l আর সেই দিকে তাকাতেই আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে বুকের বাইরে বেরিয়ে এলো l

      শিশু গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করছে ওরা দুজন l আর ওদের ঠিক মাথার দশ বারো ফুট ওপরে গাছের একটা নিচু ডালে গুঁড়ি মেরে বসে লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে প্রায় নয়-দশ ফুট লম্বা একটা কুচকুচে কালো জন্তু l

লেপার্ড!


মুখ দিয়ে অস্ফুটে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে পড়লো l আর সঙ্গে সঙ্গেই সেটা শুনে কৌশিকের চোখ আমার চোখ অনুসরণ করে ওপরের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো l আর সঙ্গে সঙ্গেই জন্তু একটা চাপা গর্জন করে লাফ দিয়ে পড়লো চট্টরাজের গায়ে l

              খুব সম্ভবতঃ জন্তুটার উদ্দেশ্য আক্রমণ করা ছিল না, হয়তো নিজের কৌতূহল নিবৃত্তির কারণে বা নিজের এলাকার সুরক্ষার জন্যই সে ঝাঁপ দিয়েছিলো l কিন্তু ভদ্রলোক দেখলাম জন্তুর লাফের সাথে সাথেই একটা ভল্ট খেয়ে উল্টে পড়লেন মাটিতে, আর তাঁর গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে বুঝলাম তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন l  

                 লেপার্ডের দেহ এখন আড়াআড়ি ভাবে আমাদের সমান্তরালে l কৌশিক এবং মিঃ চট্টরাজ মাটিতে শুয়ে আছে লেপার্ডের অন্যপাশে তার থেকে হাত দশেক তফাতে l জন্তুটার মুখ আমাদের দিকেই ফেরানো l আমার দুটো হাতই খালি, মুঠো খোলা অবস্থায় জন্তুর দিকে ফিরে l আমার ঠিক পেছনেই ব্যোমকেশ এক হাঁটু ভাঁজ করে বসে l লেপার্ডের লম্বা বাঁকানো লেজের ডগাটা মাঝে মাঝে চাবুকের মতো মাটিতে ঝাপ্টা মারছে l আর তার মুখের ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে সে ক্ষুধার্ত ও রাগান্বিত l

                            আচমকা কি যেন মনে পড়তেই নিজের পা থেকে একপাটি জুতো খুলে এনে আমি ছুঁড়ে মারলাম জন্তুটার দিকে l জুতোটা লেপার্ডের নাকের দিকে নিক্ষিপ্ত হলেও নিপুণ দক্ষতায় নিজের দেহটাকে এক লাফে বামদিকে অনেকখানি সরিয়ে নিয়ে গেলো সে l পরক্ষনেই অপর পায়ের জুতোটাও খুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারলাম আগের মতোই l জন্তুটা এবারও একই ভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল l কিন্তু এটা বুঝলাম যে, এবারের লাফে সে সকৌশলে নিজেকে আমাদের থেকে বেশ কয়েকহাত পিছিয়ে নিয়েছে l

লেপার্ড ভয় পেয়েছে!

এর পর যে ঘটনাটা ঘটলো সেটা হলো আমি কৌশিক আর ব্যোমকেশ তিনজনেই লেপার্ডের চোখে চোখ রেখে চিৎকার করতে থাকলাম l তাঁর সাথে সাথেই আমি আর ব্যোমকেশ লেপার্ডকে সামনে রেখে অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে এসে মিঃ চট্টরাজ যেখানে শুয়ে ছিলেন সেখানে এসে পৌঁছলাম এবং অজ্ঞান ভদ্রলোককে তিনজনে মিলে টেনে হিঁচড়ে প্রথমে পেছনে রাস্তার ওপর এবং তারপর ড্রাইভারের সাহায্যে গাড়ির মধ্যে গিয়ে তুললাম l পুরো ব্যাপারটা ঘটতে যদিও এক মিনিটের বেশী লাগেনি তাও প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের মনে হচ্ছিলো এক একটা যুগের মতো l

গাড়ি চলতে শুরু করলে ব্যোমকেশ পেছন ফিরে বললো, "ওনার পাল্সটা একবার দেখুন তো l" 

ভদ্রলোক অজ্ঞান l শুধু জন্তুর থাবার একটা আঁচড়ে জামার সামনেটা ছিঁড়ে খুলে এসেছে l এছাড়া অন্য কোনও চোট দেখা গেলো না l খুব সম্ভবতঃ ঘটনার আকস্মিকতা ওনাকে কাবু করে ফেলেছে l

আমরা সকলেই একটু হলেও ভয় পেয়েছি l বন্য জন্তুর মুখোমুখি এরকম হঠাৎ করে পড়ে যাওয়া খুবই বিরল l লেপার্ড সাধারণভাবে একলা প্রকৃতির জীব l নিজের খাদ্য ছাড়া সচরাচর অন্য প্রাণীকে এড়িয়ে চলে l এই হেন জন্তুর আচমকা সামনাসামনি হওয়া এবং রক্ষা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার l

"ভাই আমার হাত এখনও কাঁপছে l" কৌশিক বলে উঠলো l


আমি জানি কিছুটা এগিয়েই মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভের এন্ট্রি পয়েন্টের কাছে আমরা একটা ফরেস্ট অফিসের চেকপোস্ট পাবো l ওখানে নেমে চা খাওয়া যেতে পারে l

গাড়ি এবার নিজের গতিতে চলছে l আমরা যেখানে লেপার্ডের মুখোমুখি হয়েছিলাম সেটা পেরিয়ে এসেছি প্রায় মিনিট কুড়ি হলো l খয়ের গাছটার জন্য মন খারাপ হয়ে গেলো l আকৃতি ও পরিমাপে একটা ভালো বনসাই তৈরী করা যেত ওটাকে l হরিদ্বার থেকে দেরাদুন যাওয়ার পথে একবার এরকমই একটা ইউক্যালিপটাস পেয়েছিলাম যেটা...


একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ হলো l আর তার সাথেই আমাদের গাড়িটা একটা হ্যাঁচকা ব্রেক কষে থেমে গেলো l জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম একটা ময়ূর, দৌড়ে ডানদিকের জঙ্গলটায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে l

আমাদের গাড়ি গিয়েছে থেমে, এবং এটা বুঝলাম সেটাকে পুনরায় চালানোর চেষ্টা করে ড্রাইভার বিফল হলো l

"ইঞ্জিনে সমস্যা হলো নাকি?" ব্যোমকেশ ড্রাইভারকে হিন্দীতে জিজ্ঞেস করলো l

"ম্যায় দেখতা হুঁ " এই বলে ড্রাইভার নেমে গিয়ে গাড়ির বনেট খুলে ইঞ্জিন দেখা শুরু করলো l


    কৌশিক আর ব্যোমকেশ গাড়ি থেকে নেমে আড়ামোড়া ভাঙছে দেখলাম l আমার পায়ে জুতো নেই কারণ সেটা লেপার্ডের সাথে সাক্ষাতের সময়েই ফেলে এসেছি l তাই গাড়ি থেকে নামার জো নেই l কৌশিক বাইরে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে মনে হয় আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলো, হেসে মিঃ চট্টরাজের দিকে দেখিয়ে বললো, "ওনারটা পায়ে গলিয়ে নেমে পড় l"

তাই করলাম l গাড়ির পেছনের সিটের ডানদিকের দরজা খুলে যখন রাস্তায় পা দিলাম, আমার পায়ে শোভা পাচ্ছে সেই লাল সাদা জুতো l

আর এই জিনিস আমি আগেই আমার স্বপ্নে দেখে ফেলেছি l


ড্রাইভার জানালো গাড়ি ঠিক করতে একটু সময় লাগতে পারে l আমরা তিনজনেই এখন জঙ্গলের শোভা দেখছি l একটা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে মাঝে মাঝে l কৌশিক একটা সিগারেট ধরালো l তামাকের কটূ গন্ধে জায়গাটা ভরে যাচ্ছে l রাস্তাটা পেরিয়ে এসে ডানদিকে দেখলাম একটা ঢাল নিচের দিকে সোজা নেমে গেছে l এই ঢাল বরাবর অগ্রসর হতেই পেছন থেকে ড্রাইভারের সাবধানবাণী শোনা গেলো,

"জাদা দূর মত যাইয়ে সাব, শের হো সকতা হ্যায় l"

ডানদিকের রাস্তার ঢালটা নিচের দিকে দেখলাম বেশ খানিকটা নেমে গিয়ে একটা ঘন ঝোপঝাড়ে মিশেছে l এক পা দু' পা করে এগোলাম l চারিদিকটা অদ্ভুত চুপচাপ l

          এখানের মাটিটা শুকনো, তার মানে এদিকটায় বৃষ্টি হয়নি l আকাশ এখন নীল, রোদ ঝলমল করছে l ঘড়ির কাঁটা সময় বলছে বিকেল সাড়ে তিনটে l একবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার ওপর থেমে থাকা গাড়ির বনেটের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে ড্রাইভার তখনও কাজ করে চলেছে l অন্য দুজন অদৃশ্য l

একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে ঝাপ্টা মেরে গেলো আবার l ঝোপঝাড়গুলো পেরিয়ে এগোতে এগোতে বুঝলাম সামনেটা আস্তে আস্তে খালি হয়ে আসছে l এ ঠিক যেন ঝোপঝাড় গুলোর অচেনা একটা পৃথিবীকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা l

এবার সামনেটা একদম ফাঁকা l হাঁটার পথ এখানেই শেষ হয়েছে l এবং শুধু পথ নয়, স্থলভাগও l কয়েক পা এগিয়ে এসে সামনের দিকে দাঁড়ালাম অবাক হয়ে l 


একটা ন্যাড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে, একা একা l সামনে নদীর মতো জলাধার একটা l নদীর কিনারায় পাথর বড় বড়, দু তিনটে l একটা কাঠের পুরোনো বেড়া ভেঙে পড়েছে পাশেই l ঠিক যেন অনেক বছর আগে একটা ছোট্ট জীবন্ত গাছকে কেউ দুহাত দিয়ে আগলে আড়াল করতো চেয়েছিলো l জঙ্গুলে ঝোপটার শেষ চিহ্ন জেগে আছে গাছটার আশেপাশে l তাতে নাম-না-জানা ফুল ফুটেছে কয়েকটা l

                 একলা নদীটা বয়ে চলেছে নিঃশব্দে l রুক্ষ, শুকিয়ে যাওয়া গাছটার ডালপালাগুলো যেন ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে l ঝরে পড়া পাতাগুলো মাটির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্তুপ তৈরী করেছে l

এর পর কি হতে চলেছে তা আমি জানি l এবার শুধুই অপেক্ষা l 

গাছটায় হেলান দিয়ে নদীটার দিকে তাকিয়ে বসে পড়লাম l আশ্চর্য একটা শান্তি বিরাজ করছে জায়গাটায় l সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু জল, ঠান্ডা বাতাস খেলে বেড়াচ্ছে l ওপরে নীল আকাশ আর সম্ভবতঃ পৃথিবীর শেষ জীবিত প্রাণী এখানে একা আমি l উত্তেজনায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে l আমি জানি এখানে আমি কামিনীকে খুঁজে পাবই, আর কেউ একজন এসে আমাকে এই খবরটা দেবে l কিন্তু কে হতে পারে সেটা? আমার সঙ্গী ব্যোমকেশ বা কৌশিক কেউই জানেনা কামিনীর কথা l তবে কি মিঃ চট্টরাজ?

                      সময় কেটে যাচ্ছে l একদল সাদা বক দেখলাম উড়ে গেলো পুরো নদীটাকে পেরিয়ে l নদীর ঠিক ধারটায় যেখানে সে স্থলের সাথে মিশেছে, সেখানে অল্প জল ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে l মাঝে মাঝে হাওয়ায় কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে গিয়ে জলে পড়ে ভাসতে ভাসতে অনেকদূর অব্দি চলে যাচ্ছে l

            একটা পুরো জীবন এখানে কাটিয়ে দেওয়া যায় l


পেছনে এবার পায়ের শব্দ পেলাম l ঝোপে ভরা রাস্তাটা দিয়ে কেউ একজন এগিয়ে আসছে l আমি পেছনে ফিরে তাকাতে পারলাম না l কে আসছে সেটা সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও আমি জানি সে কি বলবে l

পায়ের শব্দটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ঠিক আমার পেছনে এসে থামলো l আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছি l আমার চারপাশের পৃথিবী যেন এক নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেছে l

"চলিয়ে সাব, গাড়ি ঠিক হো গ্যায়া l"

মানে? এটা কি হলো?

ঘুরে দেখলাম আমাদের গাড়ির ড্রাইভার l

"চলিয়ে সাব l" সে আবার বলে উঠলো l

আমার মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে l সবকিছুই তো ঠিক ছিল, সব কিছু মিলে যাচ্ছিলো l এই জুতো, এই জায়গা, এই মরা গাছ, ওই নদী, শিসের শব্দ, আমাদের গাড়ির ঠিক এখানেই থেমে যাওয়া.... তবে? "

"কামিনী?" আমি অস্ফুটে বলে উঠলাম l

ড্রাইভার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে l ভাবছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম l ঘাড় নেড়ে সে বললো, "কৌন সাব?"

হতবুদ্ধি ও বিহবল অবস্থায় ড্রাইভারের পেছন পেছন গাড়িতে ফিরে এলাম l দেখলাম ইতিমধ্যে মিঃ চট্টরাজেরও জ্ঞান ফিরেছে l একে একে সবাই গাড়িতে উঠলো l আমি দাঁড়িয়ে আছি বাইরে l আমার মন বারবার বলছে কোথাও একটা ভুল হলো l কি যেন একটা ধরতে পারলাম না l কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেলো l এতদিন ধরে যা যা স্বপ্নে দেখেছিলাম সবই তো পরপর মিলে গেলো এই কয়েক ঘন্টার সফরে l তাহলে শেষটা কেন নয়? কামিনীকে কেন খুঁজে পেলাম না এখানে?

শেষ পর্যন্ত গাড়িতে উঠতে হলো l সামনে এবার শুধু উটির রাস্তা l মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভের মধ্যে দিয়ে বিকেলের বাকিটুকু পেরিয়ে যখন নীলগিরির চড়াইয়ে এসে পড়েছি তখন সন্ধ্যে হয় হয় l


ব্যোমকেশ এতক্ষনে কথা বললো l পেছনের দিকে ফিরে আমাকে বললো, "একটাও গাছ পাওয়া গেলো না স্যার l"

হয়তো আমার মুষড়ে পড়ার কারণ হিসেবে ও ওই গাছটা না পাওয়াকেই চিহ্নিত করেছে l যদিও এতে ওর দোষ নেই l নিজে থেকে বলে না দিলে মানুষের দুঃখ, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, আনন্দ এগুলোর কোনোটারই কারণ জানাটা অন্য কারোর পক্ষে অসম্ভব l

কৌশিক একটু হেসে আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললো, "একটা গাছ পেলিনা তো কি হয়েছে? পুরো জঙ্গলটা তো আজকের জন্য পেলি l সেটাই কি কম?"

কথাটা ঠিক l আর এটাও ঠিক যে স্বপ্নে দেখা শেষ কথাটা মিলে না গেলেও শেষ কিছুদিনে কামিনীর কথা চিন্তা করে ওকে বা ওর সেই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে যতটা যতটা বোঝার চেষ্টা করেছি, সেটাও কম নয় l


স্বপ্নটা কি সত্যিই মিলে যায়নি?

           হয়তো কামিনীকে খুঁজে পেয়েছি আমি l মাঝে মাঝে, কোনও মানুষকে বাইরের পৃথিবীতে খোঁজার চেয়ে বেশী কঠিন হয়ে পড়ে আমাদের নিজের মনের মধ্যে তাকে খুঁজে পাওয়া l মানুষের মন এতই জটিল, এতই অন্ধকার যে, বাইরের পৃথিবীতে কারোর অস্তিত্ত্ব খুঁজে পাওয়ার থেকেও বেশী কঠিন নিজের মনের গভীরে ঢুকে তার জন্য অনুভূতি খুঁজে পাওয়াটা l


নিজের মনের অজান্তেই আমার ঠোঁটের কোণায় এবার একচিলতে হাসির আভাস জেগে উঠলো l

কামিনী যাওয়ার সময় বলেছিলো, "জীবনে কখনও যদি মত পরিবর্তন করো..."


                                  বাইরে চলমান গাড়ির দুপাশে সন্ধ্যের নীলগিরি জেগে ছিল অতন্দ্র প্রহরীর মতন l সে সাক্ষী ছিল রোজকার নক্ষত্রের একটা একটা করে জ্বলে ওঠার, কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দেওয়ার আর কয়েকটা জীবনের অদ্ভুত গল্পের, পাওয়া না-পাওয়ার, দুঃখ - ভালোবাসার, হারানো - আর খুঁজে পাওয়ার এক বিচিত্র রোজনামচার ll






Saturday, August 15, 2020

বিড়াল

সকালবেলা খাটের ওপর শুয়ে রুনু কড়িকাঠ গুনছিল l গেল হপ্তায় একদিন পড়ে গিয়ে ওর কোমরে ভারি ব্যাথা, বেচারা হাঁটাচলা করতে পারেনা l এমন সময়ে নীচে ছোড়দার চিৎকার শোনা গেলো l

দালানে বাবার নতুন কেনা স্কুটারের চামড়াটা ফালাফালা করে আঁচড়ানো l এ নিশ্চয়ই মাকুর কাজ l


মাকু রাস্তার বেড়াল l দিন কতক ওদের বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে l অবিশ্যি তা হবে নাই বা কেন, ওকে খেতে দিত পাশের বাড়ির বুলুপিসি আর তার ছেলে কানাই l তারা এখন ছুটিতে সবাই হরিদ্বার বেড়াতে গেছে l

ছোড়দার চিৎকারে সবাই নিচে জড়ো হলো l মাকুকে পাওয়া গেলো না যদিও, কারণ পেলে তখন তার একটা হাড়ও আর আস্ত থাকতো না l

মমতা মাসি সারা সকাল কাপড় চোপড় কেচে কুচে শুকোতে দিয়ে দালানের কাছে বসে রুটি আর চা খাচ্ছিলো, ঠাকুমা তার পাতে আলগোছে আরেকটা রুটি ফেলে দিয়ে বললো, "বেড়াল গুলোকে নিয়ে হয়েছে বড্ড জ্বালা, হয় পায়রা নিচ্ছে নয় এই করছে l একটু বিষ যদি... "

মমতা মাসি সে কথা শুনে ঠাকুমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো l


রুনু ওপরের ঘরের খাটে শুয়ে এসব শুনছিলো l তারপর তার ছোট্ট শরীরটাকে একটু ঘষটে ঘষটে মাথার কাছের জানালাটার কাছে এনে দেখার চেষ্টা করলো বাইরের রাস্তার ওপর মাকুর কোনও চিহ্ন দেখা যায় কিনা l কিন্তু অনেক ইতিউতি খুঁজেও সে তার দেখা পেলো না l অপরাধী বমালসমেত পালিয়েছে l

বাবা দুপুরের আগেই ভাত ডাল খেয়ে মুখে একটা পান গুঁজে গম্ভীর মুখে অফিসে বেরোলেন, তার পেছন পেছন বাবুকাকাও l

দুপুরে খাবার সময়ে রুনু ওর মাকে জিজ্ঞেস করলো, "মাকু আজ কোথায় খাবে মা? "

মা একগ্রাস ভাতের সাথে একটু পুঁইশাকের চচ্চড়ি মিশিয়ে ওর মুখে পুরে দিয়ে বললো, একদিন উপোস করলে ওদের কিছু হয়না, বুঝলি? "

রুনুর কোমরে খুব ব্যাথা l তাকে এখন রোজই খাইয়ে দিতে হয়, বেচারার উঠে বসে খাওয়ারও ক্ষমতা নেই l

রাত্রে শোবার আগে ছোড়দা বললো, "দেখিস রুনু, এবার ওই মাকুকে আমি আর আস্ত রাখবো না l ইসস, বাবার অতো শখের গাড়িটার কি হাল করলো বল?"

রুনু বললো, "একেবারে মেরে ফেলবে কি? "

"না তো কি?" এই বলে ছোড়দা পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো ll


মাকুটা আবার মনে হয় বাবার স্কুটারের ওই চামড়াটা ফালাফালা করে ছিঁড়ে ফেলবে বলে ফিরে এসেছিলো l কিংবা হয়তো নিছক ক্ষিদের চোটেই l রুনু দেখলো ছোড়দা আর বাবুকাকা মিলে মাকুকে কোণঠাসা করে ফেলেছে l আর তার সাথে হাতে একটা চাবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা লোক l একে রুনু চেনে l আগের বছর যাত্রায় দুর্যোধন সেজেছিল আর হাহা করে খুব অট্টহাস্য করেছিল l সে এখন তার হাতের চাবুকটা হাওয়াতে হালকা দোলাচ্ছে আর সপসপ শব্দ করছে l মাকু আজ মরবে l

ছোড়দা মাকুর ওপর একটা বস্তা ছুঁড়ে দিয়ে বললো, "এবার একে নিয়ে গিয়ে সোজা নদীর ধারে পুঁতে দিয়ো l" বাবুকাকা আর অট্টহাস্য করা লোকটা সেই বস্তাটা হাতে করে নিয়ে বেরিয়ে গেলো l

রুনু দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে বাবুকাকা দের আটকাতে গিয়েও পড়ে গেলো l আর তখনই তার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেলো l


বাইরে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ l নিচে হাঁকডাক, গরম গরম লুচি আর আলুর তরকারির গন্ধ আসছে l আজ রবিবার l

রুনু কোনোমতে খাট ধরে ধরে নেমে বাইরে এলো l আজ সে একটু হাঁটতে পারছে l বাইরে ছাদের দিকটা আকাশের যতটুকু দেখা যায় ঘোলাটে কালচে মেঘ... টিনের শেড থেকে টুপটাপ জল পড়ছে l পায়রা গুলো নিজের নিজের খোপের মধ্যে বসে বকম বকম শব্দ করে চলেছে l পাশের বাড়ির হারান জ্যাঠা রেডিওতে পুরোনো বাংলা গান শুনছে l

বারান্দার এক প্রান্তে ছোড়দা হাতে একপ্যাকেট বিস্কুট নিয়ে বসে আর তার সামনে দুই থাবা পেতে বসে কুড়মুড়িয়ে বিস্কুট খাচ্ছে মাকু, আর তার ল্যাজটা গুটিয়ে পেছনের দুই পায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা l


রুনু খানিকক্ষণ মাকুর দিকে তাকিয়ে রইলো l তারপর ছোড়দা চোখ তুলে বললো, "বিড়ালটা মার খাওয়ার ভয়ে লুকিয়ে ছিল জানিস? কাল সারাদিন কিচ্ছু খায়নি l কিন্তু মানুষ ছাড়া ওদের আর কেই বা খেতে দেবে, বল?"




Saturday, July 11, 2020

এক-আধখানা রাজকন্যা অথবা বিদেশযাত্রার গল্প

আমার সব ছোটোগল্পের মধ্যেই একটা মিল দেখি, যেটা আমার অজান্তেই হয়ে যায় হয়তো... সেটা এই যে কাহিনীর মুখ্য ভূমিকা গুলোর জীবনের যে টানাপোড়েন দেখানোর চেষ্টা করি গল্পে, সেটার থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় আর গল্পের মধ্যে এনে ফেলতে পারি না| এ আমার লেখায় একরকম সীমাবদ্ধতা বলা যায়| চেষ্টা একদম যে করিনা তা নয়| মাঝে মাঝেই ভাবি "তারপর দেখা হলো স্বপ্নে দেখা সেই রাজকন্যার সাথে" গোছের কোনো আজগুবি পরিস্থিতি এনে গল্পটাকে মিলনান্তক করে ফেলি, কিন্তু পারিনা| বা মাঝে মাঝে ভাবি, "তারপর হঠাৎ একটা আমেরিকায় চাকরির প্রস্তাব পেলাম" - এরকম একটা কাট-কাট পরিস্থিতির অবতারণা করে গল্পটাকে একটা কাল্ট লেভেল দিই| কিন্তু ওই, হয়না ||

যেটা হয়, সেটা হলো চরিত্রগুলো হাঁটতে থাকে নিজের মতন করে, একবার তাদের প্রেক্ষাপট এঁকে ফেললে তারা আর আমার নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায়না| কিছু আধপাগল চরিত্র নিজের খেয়ালে নিজের স্বত্ত্বা কেই ভুলতে থাকে, কেউ কেউ অনেক অনেক বছর পুরোনো কোনো স্মৃতির খোঁজে শহরের পর শহর হাতড়াতে থাকে| কেউ বা ভূত, কেউ বা রাক্ষস, কেউ উড়তে চায়, কেউ বা বিভক্ত ব্যক্তিত্ব নিয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে চলে|


এই অর্ধমৃত, সদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, একা, অন্ধকারাচ্ছন্ন চরিত্রগুলোর জীবনে কি এক-আধটা রাজকন্যা বা বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্ন আঁকা যায়না?

Thursday, July 9, 2020

A writer needs saving...

On odd days.

And because he is tired of writing fairytales.

And because he is tired of saving people in his stories from darkness, loneliness, silence and suffering.

Because he has been hoping against hopes for a long, long time now, that a miracle would happen.


On some astronomical moments, while humming to himself with watery eyes and full of sad memories... Sometimes,

...a writer needs saving, from this harsh world.


Friday, May 1, 2020

... left, right and centre

And then I cut people off. Left, right and centre.

It was sixth of March, and I took the decision I should've a very long time ago. 

Wednesday, January 1, 2020

Saturday, June 29, 2019

Mad - Part 3

The men outside my eight by eight cell turn silent, as they watch their superior, the master of the firm footsteps die, in vain.

The firm bite on the jugular has broken the skin, the soft inner muscle of the throat and then crushed the windpipe, suffocating the man like a gazelle falling prey to an African lion.

And I am sitting beside my fresh kill, with remains of the tore out windpipe in my mouth. The futile, vacant eyes keep staring at me as the deep hole in the throat fills the cell with warm, smelly blood.

The horrific scene turns the stoned men go amok. About seven to eight people of the police station turn petrified, drop their guns in confusion and flee in search of support. Being a mere witness of such a savage kill turns them deranged. They escape for help.


And then I step out of the cell, inside the long hall, as blood keeps oozing out of the dead and forms a pool at my footsteps. Hitherto naked, I take good care to find a pair of trousers and lock the doors of the hall from inside. I also find a matchbox and a packet of cigarettes inside the trousers.

The silent night outside is pierced by the shocking cries of the policemen. The voices fade within seconds, as they run away, perhaps never to return.

I lit a cigarette now.

Two days ago, we had ordered chicken at dinner. She ate as if she had been kept without food for a whole week. She asked me why I wasn’t eating anything, and I had lied, that I wasn’t hungry. My hatred for her had made me lie.

Immediately after we came back from dinner, she pounced on me. I threw her away on the floor, making her gasp in pain. Nevertheless, we had sex, and after the peak, I threw up on her. Her body became wet with my smelly puke. And then I followed her to the bathroom and then we had sex on the wet floor, there.

And then I murdered her, cold blooded.

The police got into the scene really quick. There was nothing I could speak to defend myself... not that I wanted to defend though. The witch was killed. And I took great pride in claiming that to the inspector.

"Yes, I'm the witch killer.", I had said.

And then I was thrown into the eight by eight cell.

She was my wife. Her eyes were round. Eyebrows were deep black and her canines were sharp and white, which showed themselves whenever she threw a laugh. A few of her hair used to fall on her forehead.

She was my wife. She wanted to make me happy.

To ensure death, I had taken the scrapper out of the bathroom and produced a full blow on her head, from behind. The vehemently shaking legs were tied to the dressing table and as she coughed blood to my face, I tore the bloody tongue out of her mouth, with my bare hands. Death came fast.

And then after two days, I had to make another kill tonight.

I feel hungry. The bread that was served to me inside the cell on an aluminium plate swims on a pool of blood. I go ahead, pick it up and start eating. The little drops of blood sprayed out of the body made the food delicious. I finish it in no time. And then I crave for some more. Blood, that is.

And it is then, I hear voices outside.

It is the men making their way back. Only this time, it seems they bring reinforcements.

The voices approach, from all sides of the hall. The doors are tried to be broken, which I have already locked from inside. Though I do feel safe from the animals outside, I prepare to commit suicide.

I place a chair on the centre table and prepare to tie a knot with the trousers I wore in the ceiling fan. My naked body is watched by the mob outside, as the yellowish bulb from the ceiling creates a magical creature out of my sweaty, unclad figurine.

The front door breaks now. And within seconds the room is filled by a dozen of animals. They have a spear. And they use the spear now.

The futile attempts to tie the knot from the ceiling fan gives way to one of the attackers as he pierces the spear into my exposed anus. The pig hunting session comes to my memories as I throw a loud, barbaric cry. The spear is further pushed inside by four other men as I stay afloat in the air, like a piece of meat in the skewers, ready to go into the fire.

I squeal like a pig.

The spear that went inside my body now comes out, with part of my intestines with it from the other side of my body. The grunts continue, as two of the men come in front and opens my inside with their bare hands as I see my guts come out and scatter like filth, all around the room.

Before everything goes dark, I see the men smiling. Their teeth are white. Eyes full of mockery. The sharp, white canines are visible even in the dimly lit hall. And it is clear they are happy to hunt a rogue pig down.


The world that smiles at me becomes dark now.




Thursday, June 14, 2018

ভূতের গল্প





“সে আজ থেকে অনেক অনেক দিন আগের কথা...।।


                                           আসর জমিয়ে বসেছে গল্পবুড়ো। আর তার চারপাশে তাকে ঘিরে রয়েছে নাতি-নাতনীরা। এরা অবশ্য তার নিজস্ব নাতি-নাতনী নয়। বুড়োর এই সংসারে কেউ নেই। তাই প্রতি রবিবার কাঁধে ঝুলি ফেলে লাঠি ঠুক্ঠুক্ করতে করতে সে নিজের বাড়ি থেকে দু’ ক্রোশ রাস্তা হেঁটে এই গ্রামের রায়বাড়ি চলে আসে। নবীন এবাড়িরই ছেলে, আট-দশ বছর বয়েস। তার দুই বোনও বুড়োর খুব ন্যাওটা। আর ফি রবিবার বুড়ো দাদুর গল্প শোনার জন্য নবীনের বন্ধুরাও সেখানে জড়ো হয়ে যায়। কানাই, সুভাষ, বিকু, মানিক ইত্যাদি। এরা সবাই গ্রামের মাঠে একসাথে খেলা-টেলা করে।   
                                    প্রতি রবিবার রায়বাড়ির সামনে ঠাকুরদালানে বসে গল্পের আসর। সনাতন রায় – নবীনের প্রপিতামহ একসময়ে জমিদার ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারী প্রথা আস্তে আস্তে উঠে গেল। জমি-জমা, পুকুর ইত্যাদিগুলো ইজারা দেওয়া হলো গ্রামেরই কিছু কিছু লোককে। দুই তরফেরই সুবিধে।


গল্পের আসর উঠেছে জমে। আজ বুড়োর নাতি-নাতনীদের জোরাজুরিতে তাকে শোনাতে হচ্ছে ভূতের গল্প। এরকম প্রতি সপ্তাহতেই রাজা-রানী, ভূত-পেত্নী, কিনারা-না-হওয়া খুনের গল্প শোনাতে হয় বুড়োকে। কচিকাঁচারা দাবী করে, বুড়ো নাকি তার ওই ঝোলাতেই তার গল্পগুলো ভরে নিয়ে চলাফেরা করে। বুড়ো আসলে ঠিক গ্রামের মধ্যে থাকেনা। সে থাকে ক্রোশ দুয়েক দূরে। গ্রামের খেলার মাঠটা পেরিয়েই একটা বাঁশজঙ্গল আর তার পাশেই শ্মশান। এই শ্মশান ঘেঁসেই চলে গেছে নদী। নদীর ওপরের পুরোনো পুল ধরে হেঁটে পেরোলেই বুড়োর বাড়ি।

                                                বুড়োর গল্পে ভর করে বিষণ্ণ, একলা দুপুর আস্তে আস্তে গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসে। পশ্চিমের আকাশের কালো একটা মেঘও ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসে। গল্পে পুরোপুরি ডুবে থাকা বক্তা বা শ্রোতাদের অলক্ষ্যেই বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলে।

                        ঝড়-বৃষ্টির জন্য সন্ধ্যে অবধি ঠাকুরদালানে আটকে পড়ল বুড়ো। তারপর টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই লাঠি হাতে ঠুক্ঠুক্ করতে করতে বেরিয়ে পড়ল।


তোমরা যারা গ্রামে থাক বা কখনও থেকেছ তারা জানো যে বৃষ্টির পরে গ্রামের মাটির রাস্তাঘাট আর চলাচলের যোগ্য থাকে না। বিশেষ করে সন্ধ্যের পর। এখানে সেখানে জমা জল, পিচ্ছিল মাটির রাস্তা। তার ওপর সাপ-খোপ তো রয়েছেই।

            বুড়ো লাঠিতে ভর করে সাবধানে হেঁটে চলেছে, বাড়ির পথে। তার কাঁধে ভারী ঝোলা।

                                                মাঠের পাশ দিয়ে আসতে আসতে সে বুঝল ঝড়-বৃষ্টির জন্যই হোক বা অন্য কোনও কারনে, আজ গ্রামের সবকটা আলো গেছে নিভে। সময়ের খেয়াল করেনি সে আগে। রাত হয়ে গেল না তো?

বাঁশজঙ্গলটা এসে পড়তেই ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজে জায়গাটা ভরে গেল। অনেক, অনেকদিন আগে জায়গাটা নাকি একটা কবরখানা ছিল। সেই পরিত্যক্ত কবরখানার ওপরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠল বাঁশগাছের জঙ্গল।

                                                মাঝে মাঝে বুড়োর এই বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়, ওপর থেকে কেউ যেন তাকে দেখছে। সেটা যে কে বা কী, তা বুড়ো জানেনা। জানতে চায়ও না। সাদা চাদরের মতো কি যেন একটা বাঁশবনের ওপর দিকটায় বসে থাকে।

                 বুড়ো ভীতু নয়। কিন্তু সে চায় না জানতে। তবে সে জানে, একদিন না একদিন তাকে জানতে হবে।


বাঁশবনের উল্টোদিকটায় রয়েছে একটা পুকুর। কালো, অন্ধকার জল তাতে কানায় কানায় ভর্তি। ওপরটায় পানা আর গাছের পাতা পড়ে পড়ে সবুজ হয়ে থাকে। দূর থেকে এক ঝলক দেখলে একফালি সবুজ জমি বলে মনে হতে পারে। সেবার একটা ছ’-সাত বছরের বাচ্চা তলিয়ে গিয়েছিল। আর পাওয়া যায়নি তাকে।

                                                  এই পুকুরে নাকি পানিমুড়া আছে।

পানিমুড়া একধরনের ভূত। সে জলের তলায় থাকে। স্নান করতে নামা লোকজনকে পা ধরে নীচের দিকে টান দেয় সে। যতক্ষণ না মানুষটার দমবন্ধ হয়ে শরীর থেকে প্রাণটা বেরিয়ে যায়। তারপর দুই পানিমুড়ায় মিলে মজা করে একসাথে থাকে। অনেক সময়ে দেখবে বিশাল বিশাল পুকুরের মাঝে ভুস করে কিছু যেন ডুব দিল। গ্রামের লোকেরা বলবে, ওসব অনেক বড় বড় মাছ।

                        ওগুলো আসলে পানিমুড়া।  


দূরে, শ্মশানের শেষ প্রান্ত থেকে একদল শেয়াল ডেকে উঠল। টিপটিপ বৃষ্টিটা থেমে গেছে। ভেজা ঘাসে চটির মসমস আওয়াজ শুধু। চটিটা খুলে রেখে বুড়ো পুকুরপাড়ে এসে খানিক বসল।


তার ভয় নেই। তাকে নেওয়ার মত কেউ নেই যে। না ওই বাঁশবনে, না এই পুকুরে, না ওই শ্মশানে। বয়সের তার আর গাছপাথর নেই। 

                                              ঝুলিটাকে শক্ত করে আগলে ধরে রাখে সে। তার গল্পের ভাণ্ডার।

                        ওই ঝুলি। এই লাঠি। এই তার সম্বল।

বুড়োর এই দুনিয়ায় কেউ নেই। সে একা। বড়ই একা সে ।


একটা হাওয়া দিল আচমকা। হাওয়াটা গ্রামের দিক থেকে উঠে এসে বাঁশবনের মাঝখান দিয়ে সোঁ- সোঁ শব্দে ঘুরপাক খেয়ে আবার ফিরে গেল। ওপরের গাছগুলো থেকে টুপটাপ অনেকগুলো পাতা খসে পড়ছে। কয়েকটা ওই কালো, আঁধার জলে আর কয়েকটা তার আশেপাশে।

                        জঙ্গলের মধ্যে কি যেন একটা মচমচ শব্দ করে খানিক এগিয়ে এসেও আবার উল্টোদিকে ঘুরে চলে গেল। শেয়াল-টেয়াল নয়তো?

                                                            আবার নিস্তব্ধতা। বুড়ো উঠে পড়ল।

ঠুকঠুক। ঠুকঠুক।


শ্মশানের পাশ দিয়ে যেতে তার যে একেবারে গা কাঁপে না তা নয়। তবে এই শ্মশানটাও পরিত্যক্ত। নদীর এপাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে জায়গাটার অনেকটাই ডুবিয়ে দিয়েছে। সেরকম ওপরটাও এগিয়ে এসেছে অনেকটা।

                                                নদীর ওপরের পুরোনো পুল ধরে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে সে। কী অন্ধকার আজ বাবা! চাঁদটাও আজ আকাশে নেই কেন কে জানে? তারার আলোয় রাত্রে কতটুকুই বা দেখা যায়?


গ্রামের অনেকেই বলে, এই পুলের ওপর কেউ কেউ নাকি ভুলোর খপ্পরে পড়েছে।

                                    ভুলো কুকুর বা মানুষ নয়। ভুলো হল মানুষের ভ্রম। ভুলো ভোলায়।

ধরো তুমে অন্ধকার রাতে একা পথ চলতে চলতে তোমার কোনও বন্ধুর কথা ভাবছ। হঠাৎ দেখলে সে তোমার সামনে উপস্থিত। এই হচ্ছে ভুলো।তুমি বলে উঠবে, “আরে তুই! তোর কথাই তো ভাবছিলাম।” সে বলবে, “হ্যাঁ রে, তাই তো এলাম। এবার আয়।”

                                                তারপর তুমি দিকবিদিক জ্ঞানশুণ্য হয়ে সেই ভ্রমের পিছু পিছু হাঁটবে। আল,মাঠ-ঘাট, পথ বেয়ে দৌড়বে। তারপর একসময়ে জ্ঞান ফিরে পেলে বুঝবে, হয়তো ঘন্টা দুই-তিন ধরে চার-পাঁচ ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছ।

                                                                    জ্ঞান না ফিরে পেলে অবশ্য অন্য ব্যাপার।

তবে বুড়ো এসব কোনওদিনই দেখেনি। সে শুধু শুনেছে। মাঝে মাঝে একা রাতের বেলা হেঁটে এসে এই পুলের মাঝখানে বসে অপেক্ষা করেছে। কীসের জন্য অপেক্ষা তা সে জানেনা। অন্ধকার, নিস্তব্ধতা, একাকীত্ব – এই তার জীবনের অংশ। সময় তার চারপাশে যেন থমকে থমকে দাঁড়ায়। তার কোটরে ঢোকা চোখে, কপালের অজস্র ভাঁজে, সাদা দাড়ি আর জীর্ণ চেহারাটায় প্রত্যাখ্যান কথাটা খোদাই করা। মৃত্যুও যেন তাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে।

ঘরে ঢুকে পাল্লাদুটো বন্ধ করে একটা আলো জ্বালালো সে। তারপর ভারী ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে বিছানার ওপর রাখল।

                                    ঝোলাটার ভেতর থেকে এবার বেশ কয়েকটা পাথর বের করে আনে সে। সাত-আটটা, বেশ বড় বড়। সব কটার ওপরেই সাদা চকখড়ি দিয়ে এক একটা নাম লেখা। কোনওটায় লেখা নবীন, কোনওটায় সুভাষ বা কানাই।

            এরাই শ্রোতা তার। প্রতি রবিবার রায়বাড়ির ঠাকুরদালানে এদের ঘিরেই বুড়োর গল্প বলা।


আসলে গেল বছর মড়কের সময়ে যখন গ্রামের বেশীর ভাগ লোকই পালাল, বুড়ো ভেবেছিল বছর ঘুরলে তারা আবার ফিরে আসবে। কিন্তু ফিরল না কেউই। কারন আশে পাশের আট-দশটা গ্রামেরও তো সেই একই অবস্থা।

                                                বুড়োর নাতি-নাতনীদের নিয়ে তাদের মা-বাবারা সেই যে গেল, আর ফিরেই এল না। পেছনে ফেলে রেখে গেল প্রায় জনশুণ্য পরিত্যক্ত একটা গ্রাম। আর রয়ে গেল সেই বুড়ো।


                                    বুড়োর চোখে অতীতের স্মৃতির জল টপটপ করে ঝরে পড়ে।


আর যেটা অতীত, সেটাও তো ভূতেরই গল্প ।।  
  

                                       

Tuesday, April 3, 2018

About forgetting..

People forget... perhaps easier than I can. It's probably in my blood than I do not forget the tiniest of things, which inadvertently makes me one of the gloomiest persons.

Elephants can forget but I don't. 😁

She went away again, without much hassles. Leaving me alone has been her ritual... and she has been maintaining with much consistency.

I hope not to meet her again in this lifetime.


So here is a picture I drew at office today out of sheer boredom. And because I want to get away somewhere quiet, away from all of this.


Wednesday, February 21, 2018

The waiting continues

And then she said.... I have feelings for someone. Someone who is way, way older than me. Something my family would never accept.

I realised something had started burning inside me.

So... I said, who's he?

She mentions his name. He is her Director of Photography, double her age. I become silent. She reads out their conversations over social media. He's separated from his wife. She, on the other side is innocent of the futility of these sort of infatuations. I am jealous. I am sad. Tears roll down my eyes as I tell her that what she is doing is wrong. This doesn't have any future. But she keeps on saying that she has feelings for him.

I am crying. Like a baby. But I do not let her know that. My love knows no bounds. But I do not want to become a chain in her feet.

So... this is what I propose. I tell her, as she finishes up reading their private conversations.

First, I am confining all social media connections with the outer world starting from now. Facebook. Whatsapp. And everything else. That includes you too. I am a one woman man and I expect my woman to be one man woman too. And I do not want to come between you and your man. I wish you all the very best with him. Though I believe it's only an infatuation from your side, I'll let you do what you like. If it was meant for you two be together, then let it be.

Okay. What's the second? She asks.

That I will wait for you. And if it doesn't work, then you will come back to me. And that time, it should be forever. No short span infatuations, no casual business. What I mean is... I want it forever with you.

Okay. She says.

Be happy. Take care. I say, as I hang up.

Life has taken so many tests of me. In so many ways. And some times the war that decides your fate is fought between some other people. All you can be is a mere spectator.


And now we wait?

And now we wait.

Tuesday, August 15, 2017

নাটমন্দির

“মাঝখানে কদ্দিন হবে বলতো?” ডানহাতে জ্বলন্ত সিগারেটটা আলগোছে গাড়ির জানলার কাছে ধরে আর বামহাতটা স্টিয়ারিং-এর ওপর রেখে রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই সন্দীপ জিজ্ঞেস করল।

“তা মন্দ কি?” আমি হেসে বললাম। “নাইন্টি ফাইভে বাবা ট্রান্সফার হয়ে মেদিনীপুর শহর থেকে চলে এলেন কাঁথি শহরে, মানে এখন যেটা কন্টাই আর কি। সঙ্গে মা আর আমি। আমি তো পুরোনো স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হলাম কন্টাই নার্সারি স্কুলে, যেখানে তোর সাথে আলাপ। তারপর নাইন্টি সিক্সের মাঝামাঝিই তো আবার বাবার বদলির অর্ডার আসে। ততদিনে আমাদের ক্লাস থ্রির অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ। তখনই ফিরে আসি। হিসেবমতো একুশ-বাইশ বছর তো বটেই।”

“তাহলেই বোঝ। তবে তোর মুখের আদলটার কিন্তু বিশেষ হেরফের হয়নি। এক ওই চাপদাড়িটা ছাড়া।”

“হা হা। তা হবে। তবে তোর মুখটা স্মৃতির প্রায় বাইরেই চলে গিয়েছিল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে যে চিনতাম না এটা শীওর। গলার আওয়াজ তো একদমই অচেনা। তারপর হাসিটা দেখে সেই বাইশ বছর আগের চেহারাটার হাল্কা আভাস ফিরে এল।”

“বলছিস?” একগাল হেসে সন্দীপ এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।

“আলবৎ”


বাঁয়ে জানলার পাশে পেছনদিকে ছুটে চলা গাছপালাগুলোর দিকে তাকিয়ে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। বাবার ছিল বদলীর চাকরি। সেই সুবাদেই কাঁথিতে গিয়ে পড়েছিলাম। তখন আমার বয়স কতই বা হবে? সাত-আট বছর। এত ছোটো বয়সে একটা নতুন শহরে একজন বাচ্চা ছেলে যে কতটা একা হয়ে যেতে পারে, এখন তাই ভাবি। দিন পনেরোর মধ্যেই অবশ্য স্কুলে ভর্তি হয়ে যাই ওখানে। আর সেখানেই বন্ধুত্ব হয় সন্দীপের সাথে। তবে গাঢ় বন্ধুত্বের পাশাপাশি আর একটা জিনিস যেটা ছিল আমাদের মধ্যে, তা হল পড়াশোনায় রেষারেষী। ও ছিল স্কুলে বরারবরের ফার্ষ্ট বয়, হেডমাষ্টারের নয়নের মণি। স্পোর্টস আর আবৃত্তিতেও ছিল তুখোড়। ক্লাশের একটা অংশ ওকে আড়ালে ‘পড়াকু’ বলে ডাকত, এটাও মনে আছে। ঘন্টার পর ঘন্টা পড়তে পারত। ওদের বাড়ির সামনে একটা মাঠ ছিল, যেখানে আমরা বিকেলে খেলাধূলা করতাম। সকালে আমাদের স্কুল থাকত। দুপুর বেলাটা আমি ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেল চারটের মধ্যে চলে যেতাম ওর বাড়ির সামনে। সন্দীপকে অবশ্য ওর মা গোটা দুপুর পড়াত। প্রায় পাঁচটা নাগাদ ওর পড়া শেষ হলে শুরু হত আমাদের ফুটবল খেলা। মাঝখানের এক ঘন্টা আমি ভবঘুরের মতন ওদের বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াতাম।


সন্দীপের টেলিফোনটা আমার কাছে এসে সোমবার, অর্থাৎ পাঁচদিন আগে। ধর্মতলায় আমার অফিসের কোনও এক কলিগের কাছ থেকে ও আমার ঠিকানা আর টেলিফোন নাম্বারটা পেয়েছিল। প্রারম্ভিক উচ্ছ্বাস, কুশল বিনিময়, বাক্যালাপ ইত্যাদির পর প্রস্তাবটা ওই দেয়। অবশ্য এই বাইশ বছরে আমি নিজে যে একবারও ও জায়গায় ফিরে যাওয়ার কথা ভাবিনি, এটা বললে মিথ্যে বলা হবে। তবে সরকারি চাকরি, কলকাতা থেকে দুম করে বাইরে যাওয়াটা মুশকিল। খুব বেশী হলে সপ্তাহান্তে কলেজের কোনও পুরোনো বন্ধুবান্ধবের সাথে রেস্তোরাঁতে বসে ঘন্টাখানের আড্ডা, ব্যাস। তাই তিনদিনের জন্য কাঁথিতে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাবটা পেয়ে ভালোই লেগেছিল। শুক্র, শনি আর রবি – তিনদিনের প্ল্যান। তাই অফিসে শুক্রবারের জন্য একটা ছুটির আর্জি জানিয়ে দিলাম। শুক্রবার, মানে আজ সকালে সন্দীপ ওর সাদা হুন্ডাই ইলান্ট্রা গাড়িটা নিয়ে চলে এসেছিল আমার বাসস্থানে। আর তার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা।


“হেডমাস্টার সুশীলবাবুকে মনে আছে তোর?”

“তুই নামটা বলায় মনে পড়ল।” আমি উত্তর দিলাম। “অবশ্য ওই নাম অব্দিই। চেহারা, মুখ কিচ্ছু মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। আমাদের কোনও একটা সাবজেক্ট পড়াতেনও যতদূর মনে পড়ে। তোকে তো অসম্ভব স্নেহ করতেন উনি।”

“তার কারণ একটা আছে। স্কুলে বরাবর ফার্স্ট হয়ে এসেছিলাম। অবশ্য...”

গাড়ির গতি কমাতে হয়েছে। কাছাকাছি নিশ্চয়ই লোকালয় আছে। কারন একপাল মহিষ এসে পড়েছে গাড়ির সামনে। একটা সতেরো-আঠেরো বছরের ছেলে ‘হেট, হেট’ করতে করতে পুরো পালটাকে রাস্তা পার করিয়ে ডানদিকে একটা মাঠের মধ্যে নেমে গেল। জন্তুগুলোর পায়ে পায়ে ধূলো উড়ে জায়গাটাকে হলুদ আর ধোঁয়াটে করে দিয়েছে। জানালার ফাঁক দিয়ে দূরের সবুজ গাছপালা, ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি, ধানক্ষেত, কয়েকটা উঁচু-নিচু টিলা – একেবারে ছবির মত মনে হয়। গ্রামবাংলা বলে একটা ব্যাপার যে এদেশে আছে, কলকাতায় বসে তা প্রায় মাথাতেই থাকে না। আসলে সিটি আর কান্ট্রিলাইফের মধ্যে যে বিস্তর একটা ফারাক আছে, সেটা শুধু এই বন-জঙ্গল, নদী-গাছপালা, বা উঁচু ইমারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, তা ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মনেও।

                   আধখোলা কাঁচের জানালা দিয়ে দূরের গাছপালাগুলোর দিকে দৃষ্টি চলে যেতে বুঝলাম সেগুলো হাওয়ায় দুলছে। আমরা কলকাতা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে চলেছি সমুদ্রের দিকে। পূবের আকাশে রোদের তেজ খানিকটা থাকলেও ওপাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে বোঝা গেল, পশ্চিমের আকাশ ছাই রঙের মেঘে ঢাকা। সময়টা জুনের মাঝামাঝি। গত তিন চার মাস বৃষ্টি প্রায় হয়নি বললেই চলে। তাই এখন বৃষ্টি হলে পুরো আকাশ জুড়ে জল নামবে।


“...অবশ্য তুই স্কুলে আসার পর ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যায়। বলতে পারিস আমি একজন পারফেক্ট কম্পিটিটর পেয়ে গিয়েছিলাম।”

“তুই তো বরাবরের স্টুডিয়স ছিলি, ভাই।” আমি বললাম।

“তা ছিলাম। তবে তোর মতন মেরিটটা ছিল না। বিজ্ঞান মেধা পরীক্ষাটার কথা মনে পড়ে?”

“ওটা মনে আছে। জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম। তবে একটা আফশোস রয়ে গিয়েছিল। প্রথম পুরস্কারের  সোনার মেডেলটা কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত পাঠাননি। এটা অনেকদিন মনে রয়ে গিয়েছিল।”

          একথার সন্দীপ কোনও উত্তর দিল না। ওর নজর গাড়ির উইন্ডস্ক্রীনের দিকে। কয়েকটা বড় বড় জলের ফোঁটা কাঁচটার ওপর এসে পড়তে শুরু করেছে। পশ্চিমে যে কালো মেঘটা দেখেছিলাম সেটা এরই মধ্যে কাছে এসে পড়ল নাকি?

কোলাঘাট হয়ে মেচেদা অবধি এসে একটা পেট্রোল পাম্প দেখে আমরা গাড়ি থামালাম। টিপটিপ বৃষ্টিটা এখনও পিছু ছাড়েনি। গাড়িতে তেল ভরে নিয়ে সামনেই একটা রেস্তোরাঁতে ঢোকা গেল। রুটি আর মাংসের অর্ডার দিয়ে বসে সন্দীপ একটা সিগারেট ধরালো।

“আমার ডাউনফলের শুরুটা ওখানেই হয় বলতে পারিস।” সন্দীপ বলল। “বছর কয়েকের মধ্যে শুনেছিলাম তুই চলে গিয়েছিস দুন স্কুলে পড়তে। তাই যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে যায়। বাবা চলে গেলেন তখন আমার ক্লাস টেন, ষোলো বছর বয়েস। সতেরোয় ব্যাবসায় নামি। শুরু করি লোহা-লক্কড়ের ব্যাবসা দিয়ে। সেটা ডাহা ফেল করে। সাড়ে উনিশ বছর বয়েসে কিছু মূলধন যোগাড় করে একটা কাঠের ব্যাবসা খুলে বসি। বরাতজোরে এটা টিকে যায়।”

“টিকে যায় কি বলছিস! শুনলাম তো তুই এখন বিশাল বড়লোক।”

এ কথার জবাব ও দিলনা। শুধু মুচকি হেসে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে আরেকটা সিগারেট ধরাল। এক ঝলকের জন্য ব্র্যান্ডটার দিকে চোখ চলে গেল। বিলিতী কোম্পানী, বেনসন এন্ড হেজেস। বিলিতী জিনিষের প্রতি আকর্ষণ বড়লোকদের একটা অতিপ্রাচীণ দোষ বলা যায়। অবশ্য এটা দোষ না গুণ সেটাও বিতর্কসাপেক্ষ। সন্দীপকে আক্ষরিক অর্থেই একজন সেলফ-মেড পার্সেন বলা চলে। অল্পবয়সে নিজের বাবাকে হারানোর পর যেভাবে নিজেকে জীবনে প্রতিষ্ঠা  প্রতিপত্তি স্থাপন করেছে, তাতে কিছু বাহুল্য থাকার অহংকার ওর পক্ষে স্বাভাবিক।

          লাঞ্চের পর্ব শেষ করে গাড়িতে ফিরে আসছি, এমন সময়ে বৃষ্টির জোরটা বাড়ল। গাড়ি লক করে স্টার্ট করতেই উইন্ডস্ক্রীনের ওয়াইপার তার কাজ শুরু করে দিল। অঝোর ধারায় বৃষ্টির মধ্যে আবছা, অস্পষ্ট হয়ে পড়া দুপাশে দূরের গাছপালা আর সড়কের ওপর ফুল স্পীডে চলা একটা গাড়ির মধ্যে দুই বন্ধু।

“ভাল কথা,” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “থাকার ব্যাবস্থার কথা কিছু ভেবেছিস?”

“আজকের মত আপাততঃ একটা হোটেলে উঠতে হবে। যদিও তারপর একটা সারপ্রাইজ থাকছে।”

“কিরকম?”

“...নাটমন্দির মনে পড়ে?”


এবার বেশ অবাক হলাম। নাটমন্দিরের কথাটা এতদিনে প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। বাইশ বছর আগে কাঁথিতে বদলি হওয়ার পর বাবা আমাদের যে বাড়িটিতে ভাড়ায় থাকার জন্য নিয়ে যান, তার তদানীন্তন মালিক ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ মজুমদার। ভদ্রলোকের বাপ-দাদুর আমলকার জমিদারী ছিল ওখানে। বাড়িটা ছিল প্রকান্ড, আর নামটাও ছিল জমকালো – ‘মজুমদার ভিলা’। জমিদার বংশের মানানসই। প্রকান্ড একটা সদর, বাহির মহল একখানা, মাঝের একটা বিশাল দালান পেরিয়ে ডানদিকে ছিল একটা নাটমন্দির। প্রাণকৃষ্ণবাবুর ঠাকুর্দার আমলে এখানে পূজাপাঠ, নৃত্যগীত এবং কালেকস্মিনে যাত্রাপাঠ ইত্যাদি পরিবেশনা হত বলে শোনা যায়। এটা পেরিয়ে ছিল অন্দরমহল। যদিও আমি যে সময়টায় বাড়িটায় ছিলাম, বাড়িটার শতকরা সিকি শতাংশই বাসযোগ্য ছিল। তার একটা প্রধান কারন ছিল এই যে, পূর্বপুরুষ জমিদার হলেও স্বাধীন ভারতে জমিদারি ফলানোর অধিকার প্রাণকৃষ্ণবাবুর ছিল না। ক্ষেতিবাড়ি করানোর লোকজন থাকলেও তা থেকে যা আয় হত, তা অধিকাংশই বাড়ি দেখভালের পেছনে খরচ হয়ে যেত। আমাদের মতোই আরও একটি পরিবারকে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল বাইরের মহলের একটি অংশে। মনে পড়ল অব্যাবহৃত নাটমন্দিরের আনাচে কানাচে ছোটোবেলায় আমার আর সন্দীপের খেলে বেড়ানোর কথা।

“সে জিনিষ এখনও আছে নাকি? যতদূর মনে আছে জায়গাটা তখনই ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থায় ছিল।”

“ইয়েস স্যার। সে জায়গা আছে। যদিও বাসযোগ্য নয়, তবে একটা রাত কাটানোর মত অবস্থায় নিশ্চয়ই হবে। সাপখোপের ভয় নেই, সঙ্গে আলাদা ব্যাবস্থা আছে।”
                                 
                                                      ঘড়ির কাঁটায় যখন ঠিক তিনটে বেজে কুড়ি মিনিট, আমরা কাঁথি শহরে পৌঁছলাম। বাইশ বছর আগের স্মৃতি হলেও এটা মনে পড়ল যে, ছোট্ট শহরটায় দুটো বাসস্ট্যান্ড ছিল। একটা খড়গপুর, অর্থাৎ কাঁথি থেকে খড়গপুর ও মেদিনীপুরের অন্যান্য গ্রাম ও শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া বাসের স্ট্যান্ড, আর একটা হাওড়া বাসস্ট্যান্ড – এখান থেকে হাওড়া অভিমুখে যত বাস ছিল তা চলত। যদিও মাত্র সাত বছর বয়সে শুধু এক বছরের জন্যেই এই শহরটায় ছিলাম, তবুও আজ প্রায় দু’ দশকেরও বেশী সময়ের পর অনেক ছোটোখাটো কথা মনে পড়ে গেল।  

                   আমরা প্রথমে একটা হোটেলে উঠলাম। হাতমুখ ধুয়ে হোটেলের বারান্দায় বসে কফি আর টোস্ট খেতে খেতে সন্দীপ ওর প্ল্যানটা জানাল।

“দেখ আকাশ, আমার প্ল্যানটা হল এরকম। আজকের রাতটা আমরা হোটেলেই থাকছি। কাল সকালবেলা হোটেল থেকে মালপত্র সমেত চলে যাওয়া যাবে ‘মজুমদার ভিলা’-তে। ওখানে আপাততঃ চৌকিদার গোছের একজন লোক থাকে। তাকে বলে কয়ে একরাত্রির জন্য ওই বাড়ির কোনও একটা ঘরে থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। যদিও ঘরটা শুধু ম্যানেজ করার জন্যই। আমি চাইছি রাতটা ওই নাটমন্দিরেই কাটাব। কি বলিস?”

নাটমন্দিরে রাত কাটানোর প্ল্যান শুনে পুরোনো দিনের স্মৃতি মনের মধ্যে ভেসে উঠল। তখন আমাদের বয়স হবে সাত বা আট। নাটমন্দিরের চাতাল, দোতলার ঘোরানো সিঁড়ি, ওপরে জালি দেওয়া ঘেরা অংশ – যেখানে জমিদার আমলে মহিলামহলের সদস্যরা বসে নাটমন্দিরের নাচ-গান, নাটক ইত্যাদি দেখতেন – এইসব জায়গা ছিল আমাদের খেলাধূলা করার অবাধ এলাকা। স্কুলের ভেতরের বন্ধুত্ব ছাড়াও স্কুলের বাইরের বেশীর ভাগ সময়েই আমরা খেলে বেড়াতাম হয় সন্দীপদের বাড়ির সামনের মাঠে ফুটবল খেলে, নয়তো ‘মজুমদার ভিলা’-এর আনাচে কানাচে। বেশীর ভাগ ওই নাটমন্দিরেই।

রাতটা কোনওমতে হোটেলে কাটিয়ে দেওয়া গেল। বৃষ্টির রেশটা যে তখনও পিছু ছাড়েনি, এটাও বোঝা গেল। সারা রাত ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা চলতেই লাগল। যদিও আগামীকালের আবহাওয়ার পূর্বাভাস আছে পরিষ্কার আকাশের, তবু মনটা আনচান করতে লাগল। এতদিন পর এই জায়গায় এসে শুধুমাত্র বৃষ্টির জন্য ঘোরাঘুরি আর থাকাটা মাটি হয়ে গেলে তার থেকে খারাপ জিনিষ আর হয় না।

              সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল বাইরে চড়া রোদ। একটা ভালো দিনের শুরু। হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ‘মজুমদার ভিলা’-এর উদ্দেশ্যে। পায়ে হেঁটেই চলা। কাঁথি শহরটা দৈর্ঘ্যে খুব বেশী হলে চার-পাঁচ কিলোমিটার আর প্রস্থে বড়জোর দুই-তিনেক। হোটেল থেকে আমাদের গন্তব্যস্থল এক-দেড় কিলোমিটারের মতন রাস্তা। মনে পড়ল চলার পথে এই রাস্তাতেই বাঁয়ে ঘুরে মিনিট পাঁচেক এগিয়ে ছিল রামকৃষ্ণ মিশন। ডানদিকে একটা খেলার মাঠ পেরিয়ে ছিল সন্দীপদের পুরোনো বাড়িটা। এখানটায় আমরা খানিকক্ষণ থামলাম। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সন্দীপ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

          সময় মাঝে মাঝে মানুষকে কত একা করে দেয়, আমি চিন্তা করলাম। শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলোকে মানুষ সবসময়ে তার সুখের স্মৃতিগুলোর সাথেই জড়িয়ে রাখে। জীবনে বেড়ে ওঠার নামই কি আসলে দুঃখ? হয়তো তাই। নাহলে দুই দশকেরও বেশী সময়ের পর আমাদের তাগিদই বা কি থাকত একটু সুখের স্মৃতিগুলো ঝালিয়ে নেওয়ার?

          সন্দীপের মুখে একটা কালো ছায়া নেমে এসেছিল। সেটা কাটানোর জন্যই প্রশ্ন করলাম, “কাঁথি ছাড়লি কবে?”

“কাঠের ব্যাবসাটা মোটামোটি দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর পরই। সাপ্লাই আর ডীলারদের কাজে কলকাতায় যাতায়াত ছিলই। প্রথমে ভাড়ায় একটা ছোটোখাটো অফিস খুলে বসি। আড়াই বছর পর কলকাতাতেই একটা ফ্ল্যাট কিনে মাকে নিয়ে চলে আসি। ফ্ল্যাটেরই একটা ঘরকে এখন অফিসঘর বানিয়েছি।”

মনে পড়ল সন্দীপের বর্তমান অর্থ ও প্রতিপত্তির কথা। তবু একটা কথা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।

“এতদিন পর তোর হঠাৎ আমার কথা মনে পড়ল কি করে বল তো?”

সন্দীপ হাসল। বলল, “কারন একটা নিশ্চয়ই আছে। এবং সেটা যথেষ্ট পাকাপোক্ত, এটুকু বলতে পারি। তবে এখন আর এবিষয়ে কথা নয়।”

কথা বন্ধ করতে হল। তার কারন আমরা এসে পড়েছি ‘মজুমদার ভিলা’-এর সদর ফটকে। একসময়ে এখানে মোটা লোহার রেলিং দেওয়া দরজায় আটকানো থাকত গেট। এখন সেসব ভেঙ্গে শুধু কাঠের উঁচু দরজাটাই যা পড়ে আছে।

চৌকিদারের সাথে বন্দোবস্ত করতে সময় লাগল না। বৃদ্ধ লোকটি আধা বাংলা আধা বিহারী হিন্দীতে বিড়বিড় করে “কুছ বখশিস হুজুর...” বলে উঠতেই দেখলাম সন্দীপ ওর মানিব্যাগটা থেকে পাঁচশো’ টাকার কড়কড়ে চারটে নোট বের করে লোকটার হাতে গুঁজে দিল। চৌকিদার তিনবার সেলাম ঠুকে রাতের রান্নার উপকরণ জোগাড় করতে চলে গেল।

              চৌকিদার লোকটার কাছ থেকে নেওয়া চাবি দিয়ে গেস্টরুমটা খুলে মালপত্রগুলো সেখানে রেখে আমরা গোটা বাড়িটা ঘুরে দেখতে বেরোলাম। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই হয়তো ভালো। বাইরের মহল আর ভেতরের মহলের মাঝখানে প্রকান্ড একটা দালান। বড় বড় স্তম্ভগুলোর চুন-সুরকি খসে পড়ে গোটা বাড়িটার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। ভেতরের মহলের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। দেওয়ালগুলো ভেঙ্গে গিয়ে বট-অশ্বত্থের চারা গজিয়ে উঠেছে এখানে সেখানে। ছাদের দিকটায় চোখ যেতে দেখলাম বৃষ্টির জলে শুধুই ঘাস, ফার্ণ আর শ্যাওলা পড়ে গিয়েছে সেখানে। এখানে সেখানে পাখির বাসার চিহ্ন, পাখির বিষ্ঠা পড়ে আছে। জায়গাটা অতীতের ধ্বংসাবশেষ বললেও কম বলা হয়। ভেতরের দিকে একটা ছোটোমতন বাগান ছিল মনে পড়ল। জায়গাটায় এসে দেখা গেল সেই বাগান এখন এক মানুষ উঁচু ঘাসের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। একটা জমিদার বংশ এভাবে শেষ হয়ে গেল। চৌকিদার বলছিল এই বাড়ির শেষ উত্তরাধিকারী আসামের কোনও এক টি-এস্টেটে কাজ করে। তারই আদেশে এবং মাসিক যৎকিঞ্চিত মাইনেতে সে রক্ষা করে চলেছে বাড়িটা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। হয়তো ডিসপুটেড প্রপার্টি বলে সরকারও সরিয়ে রেখেছে জায়গাটাকে।

                    এবার নাটমন্দিরের দিকটায় পা বাড়ালাম। এই জায়গাটা অনেকখানি ছড়ানো। অন্দর মহলের সাথেই লাগোয়া ডানপাশে ঘেরা অনেকটা জায়গা। আগেই বলেছি, এখানে জমিদার আমলে একসময়ে নাটক, নাচগান এসব হত। প্রতি বছর দূর্গাপূজাও হত এখানে। পরে অবশ্য সেসব বন্ধ হয়ে যায়। চওড়া দালানের শেষপ্রান্তে দুধারে ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরদিকে একটা জালি দেওয়া অংশে। এটা ছিল মহিলাদের বসার জায়গা। সিঁড়িটা বহুকালের অব্যাবহারের ফলে নোংরা আর শ্যাওলা পড়া। ওপর দিকে তাকিয়ে বোঝা গেল ছাদের অনেকটা অংশ ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে দিনের আলো সোজাসুজি এসে পড়ছে নাটমন্দিরের মেঝের কিছুটা জায়গা জুড়ে। মেঝের একটা কোণায় একটা সাপের পুরোনো খোলস পাওয়া গেল। সর্বনাশ! এখানে বিষধর সাপ থাকলে তো রাত কাটানো মুশকিল।

              কিন্তু এর নিদান তখনই পাওয়া গেল। সন্দীপ দেখলাম এবার এগিয়ে এসে ব্যাগ থেকে একটা কালো কাঁচের শিশি বের করে চারিদিকে একটা তরল ছড়িয়ে দিতে লাগল। কার্বলিক অ্যাসিড। যাক, তাহলে এই ব্যাপারটা ওর মাথায় ছিল। এ জিনিষ ছড়িয়ে রাখলে রাত্রে আর কোনও সাপ বাবাজি বিরক্ত করার জন্য এমুখো হবেন না।

“এ জিনিষ ভূতকেও তাড়ায় নাকি?” আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম।

“এ বাড়ির যা অবস্থা, তাতে কয়েক ডজন ভূত রাত্রে আনাগোনা করলেও অবাক হব না।” সন্দীপ অর্ধেক খালি বোতলটা আবার ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল।

          কথাটা সত্যি। গাঁ-গঞ্জে এরকম আধা ভেঙ্গে পড়া জমিদার বাড়িতে ভূতের দেখা পাওয়া যায় - একথা ছোটোবেলা থেকেই সব ভৌতিক গল্প-উপন্যাসে পড়ে এসেছি। তা স্বচক্ষে সেরকম কোনও জিনিষ প্রত্যক্ষ করা গেলে সেটা মন্দ ব্যাপার হবে না। 

এর মধ্যেই সন্দীপ দেখলাম ঘোরানো সিঁড়িগুলো দিয়ে ওপরে একপা একপা করে উঠতে শুরু করেছে। মতলব কি? এই বাড়ির যা অবস্থা দেখছি, হঠাৎ করে সিঁড়িশুদ্ধ গোটা জায়গাটা ভেঙ্গে পড়লেও আশ্চর্য হব না। কলকাতা থেকে এতদূর এসে শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়লে মুশকিল।

          সিঁড়ির সাত-আট ধাপ উঠে সন্দীপ দেখলাম ডাইনে দেওয়ালের লাগোয়া একটা কুলুঙ্গির মত জায়গায় হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। মনে হল হাতড়ে কিছু খুঁজছে। সর্বনাশ! পাখির ডিম-টিম খোঁজার তালে আছে নাকি?

আধ মিনিট এদিক-ওদিক হাতড়ে শেষটায় আবার ধীরে ধীরে নীচে নেমে এসে আমার জিজ্ঞাসাপূর্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে সন্দীপ বলল, “একটা জিনিষ ছিল, বহু বছর আগে। খুব সম্ভবতঃ আমার আগে কারোর হাত পড়েছে। এখানে আসার আসল কারনটা ভেস্তে গেল।”

সন্দীপ যে এত রহস্য কেন করছে তা বুঝলাম না। তবে এবিষয়ে আমিও আর কোনও উচ্চবাচ্য করলাম না।

সারাটা দিন আমরা এদিক ওদিক ঘুরে কাটালাম। প্রথমে যাওয়া গেল কন্টাই নার্সারি স্কুলে, যেখানে আমরা একবছর একসাথে পড়াশোনা করেছিলাম। ছোটোবেলার স্মৃতির সাথে মিলিয়ে নিতে অসুবিধে হল না। যদিও স্কুলের উঁচু দেওয়ালগুলোকে এখন আর অতটা উঁচু বলে মনে হল না। ক্লাসরুমের টেবিল-চেয়ারগুলোকেও এখন অনেকটাই নিচু মনে হয়। বয়সের ধর্ম।

স্কুল থেকে বেরিয়ে একবার এখানকার বাজারের দিকটায় যাওয়া গেল। নিউ মার্কেট এরিয়াটা আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে দেখলাম। কিছু জিনিষপত্র কেনাকাটা করে দুপুরের খাওয়াটা বাইরেই একটা হোটেলে সেরে আমরা ফিরে পড়লাম।


          সময়টা বিকেল। গতকাল সারাদিন বৃষ্টি থাকলেও আজ সারাদিনই আকাশ পরিষ্কার ছিল। দিনের আলোর যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা কাজে লাগিয়েই আমরা দুজনে মিলে নাটমন্দিরের চাতালের একটা কোণাতে রাত কাটানোর মতন একটা ব্যাবস্থা করে নিলাম। ব্যাবস্থা বলতে চৌকিদার লোকটাকে দিয়ে কিছুটা জায়গা ধুয়ে মুছে সাফ করিয়ে দুটো তোষক, চাদর আর বালিশ পেতে দেওয়া। চৌকিদার দেখলাম একটা হ্যাজাক জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে রাখার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। “কুছ পরোয়া নহী” বলে একটা হাঁক পাড়লাম। বৃদ্ধ লোকটা আরও কয়েকবার দোনামানা করে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল সন্ধ্যে সাড়ে ন’টায় আমাদের রাতের খাবার গেস্টরুমে দেওয়া হবে। তারপর সে নাকি আফিম খেয়ে শুয়ে পড়ে এবং গোটা রাত তার কোনও হুঁশ থাকে না। তাই খাওয়ার জল বা অন্যান্য কিছু দরকারি জিনিষ চাওয়ার হলে আমরা যেন এখনই চেয়ে নিই।


              রাতের খাওয়া দাওয়া করে যখন আমরা ফিরে এলাম, হাতঘড়ি বলছে রাত এগারোটা। যদিও আমাদের সাথে টর্চ আছে, তবুও যেন মনে হল একটা হ্যাজাক জ্বালিয়ে রাখলেই ভালো হত। সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টার দিকে আকাশে একবার চাঁদ উঠেই মিলিয়ে গেছে মেঘের আড়ালে। এখন চারিদিকে শুধুই অন্ধকার। অন্দরমহলের বাগানটা থেকে অজস্র ঝিঁঝিঁর ডাক আসছে। আজ খুব সম্ভবতঃ এখানে কোথাও পুজো আছে। একটা খুব ক্ষীণ ঢাক, ঢোল আর সংকীর্তনের আওয়াজ আসছে অনেক দূর থেকে। কিছুক্ষণ পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। একটা চামচিকে বা বাদুড়ের ডানা ঝাপটিয়ে ওপরের বাহির মহলের এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দায় চলে যাওয়ার আওয়াজ পেলাম। তারপর সব চুপচাপ।

নাটমন্দিরের চাতালটার এক কোণায় পাশাপাশি দুটো বিছানা পাতা হয়েছে। এর মধ্যে একটায় আমি গিয়ে বসলাম। সামনের চওড়া উঠোনের মতন জায়গাটাতে সন্দীপ পায়চারি করছে আর মাঝে মাঝে টর্চটা জ্বেলে এদিক ওদিক নিরীক্ষণ করছে। এরই মধ্যে তামাকের একটা কটূ গন্ধ পেয়ে বুঝলাম এবার ও একটা সিগারেট ধরিয়েছে।

              সন্দীপের হাবভাব একটু অস্বাভাবিক লাগছে। বিকেলের ওই ঘটনার পর ও কিছুটা যেন গুম মেরে গেছে। হাঁ-হুঁ করে জবাব দিচ্ছে। ‘এখানে আসার কারনটা ভেস্তে গেল’ বলতে ও ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছিল?

চক বাঁধানো চাতালের একটা কোণায় ফ্যাকাশে হলুদ রঙের একফালি আলো এসে পড়তে এবার বুঝলাম মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঁকি মারছে আকাশে। পুরো চাতালটা, ওপরের বারান্দা আর সন্দীপের চেহারাটা – এ সবই অন্ধকারেও খানিকটা স্পষ্ট লাগছে। আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে হেঁটে কয়েক পা এগিয়ে উঠোনটায় নেমে দাঁড়ালাম।

“তোর কি হয়েছে বল তো?” আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম।

কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে সন্দীপ কি যেন ভাবল। তারপর বলল, “সব কথা কি আর অত সহজে বলা যায় রে? শুধু একটা কথা বলতে পারি, হেডমাস্টার সুশীলবাবুর মুখ আমি রাখতে পারিনি। উনি আমাকে স্কুলের সেরা ছাত্র বলে এসেছিলেন স্কুলের শেষদিন পর্যন্ত। তার মর্যাদা আমি রাখতে পারিনি।”


          এই কথায় রহস্য কমার বদলে আরো বেড়ে গেল। সন্দীপের স্কুলের সেরা ছাত্র হওয়া বা না হওয়ার সাথে বাইশ বছর পর ‘মজুমদার ভিলা’-তে ফিরে আসার সম্পর্ক কি? মর্যাদা রাখার ব্যাপারটা...

          আমার চিন্তার সূত্রটা মাঝপথেই থেমে গেছে। সন্দীপও দেখলাম বিছানাগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়েছে।

একটা শব্দ।

শব্দটা কোথা থেকে আসছে তা জানার উপায় নেই। একটা হালকা, ধুপ ধুপ আওয়াজ। খুব চেনা চেনা লাগছে। অথচ এত ক্ষীণ যে ধরা যাচ্ছে না। কয়েকবার হয়েই শব্দটা থেমে গেল।

          আমাদের হাতের টর্চগুলো জ্বালিয়ে এদিক ওদিক ফেলেও কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই আওয়াজটা আবার শুরু হল। এবার আওয়াজ স্পষ্ট। এবং শব্দটা আগেরবার চেনা লাগার কারনটাও পরিষ্কার হয়ে গেল। টর্চের আলো এদিক ওদিক ফেলার মাঝেই সন্দীপের সাথে আমার একবার চোখাচোখি হয়েছে। এবং আমাদের দুজনের মুখ দিয়ে একই সময়ে একটা কথা অস্ফুটে বেরিয়ে পড়েছে।

“ফুটবল!”


একবিংশ শতকের কলকাতা শহর থেকে দেড়শো’ কিলোমিটার দূরে এক ছোট্ট শহরের অতি প্রাচীন এক জমিদার বাড়িতে মাঝরাতে কে বা কারা ফুটবল নিয়ে খেলছে।  

              শব্দটা কোথা থেকে আসছে বলা দুষ্কর। হতে পারে এই বাড়ির লাগোয়া মাঠে রাত্রে খেলা হচ্ছে এবং তারই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে কানে। কিন্তু সেই ধারণা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা কম। মাঝরাতে এই অন্ধকার আধা শহরের এক কোণে কোনও পুরোনো জমিদার বাড়ি সংলগ্ন মাঠে কেউ ফুটবল খেলবে, এটা ভেবেও হাসি পায়।

শব্দটা ইতিমধ্যে আবার থেমে গেছে। চৌকিদারকে ডাকলে যে কোনও ফল হবে না সেটা জানি। সে আফিমের নেশায় চুর হয়ে ঘুমোচ্ছে। হ্যাজাকটা কেন চেয়ে নিলাম না সেটা ভেবে আবার আফশোষ হল। অন্ততঃ যদি অতর্কিতে চোর হানা দেয় তাকে রুখতে পারা যেত। অবশ্য আমাদের সাথে মূল্যবান এমন কোনও জিনিষ নেই যার খোঁজে চোর চুরি করতে আসবে। তবে একথা কি আর চোর জানে? সশস্ত্র চোরকে আর যাই হোক, টর্চের আঘাতে বাগে আনা যাবে না।

আমরা দুজনে আবার নাটমন্দিরের চাতালে আমাদের তোষকের বিছানায় ফিরে এসেছি। সন্দীপ দেখলাম প্যান্টের পকেট হাতড়ে লাইটার বের করে আরেকটা সিগারেট ধরালো। আগুনের হালকা আলোয় বুঝলাম ওর কপালে চিন্তা আর দ্বিধার হাল্কা ছাপ।

“তোকে এতগুলো বছর একটা কথা আমি বলিনি রে, আকাশ। বলিনি, কারন সেটা আমি বলতে পারিনি। একটা কথা যেটা বলা যায় না।”

আমি চুপ। আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধছে। কিন্তু সেটা এতটাই অসম্ভব, যে আমি নিজের মনকেও বিশ্বাস করতে পারছি না।

ও বলে চলল, “আজকের বিকেলে আমার ওই খোঁজাখুঁজি যদি বিফলে না যেত, তাহলে এতদিনের পুরোনো সব গ্লানি আমার মন থেকে মুছে যেত। কিন্তু আমি পারলাম না ভাই। আমি পারলাম না।”

                   ওর শেষ কথাগুলো কিরকম হাহাকারের মতন শোনালো। এটুকু বুঝেছিলাম যে কলকাতা থেকে আমাকে নিয়ে এত বছর পর কাঁথি আসার মধ্যে সন্দীপের একটা উদ্দেশ্য ছিল। আমার মনে তখন থেকেই একটা সন্দেহ ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু যে জিনিষ বিফলে চলে গেছে তাকে আর খুঁচিয়ে লাভ নেই ভেবে কিছু বললাম না।

হাতঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত দেড়টা। আজ সকালে দেরী করে ঘুম ভেঙ্গেছিল বলেই কিনা কে জানে, ঘুম খুব একটা পাচ্ছে না। জলের বোতলটা বের করে খানিকটা জল খেয়ে একবার নিচের উঠোনটায় পা বাড়িয়েছি, এমন সময়ে আরেকটা শব্দ পাওয়া গেল।


এ শব্দ সম্পূর্ণ আলাদা। এই আওয়াজ পায়ের আওয়াজ। মানুষের পায়ের। এবং সেটা আসছে নাটমন্দিরের ছাদের অংশ থেকেই। পায়ের মালিক যে একের বেশি সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা যেখানে বসে আছি, পায়ের আওয়াজ আসছে তার ঠিক ওপরে ছাদের অংশ থেকে। সামনে আরও এগিয়ে পড়বে সিঁড়ি। সিঁড়ির ঠিক ওপরেই ছাদের অনেকটা অংশ ভাঙ্গা, যেখান থেকে অনেকটা চাঁদের আলো এসে নাটমন্দিরের চাতালটাকে আলোকিত করে রেখেছে।

সন্দীপের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আমার মত ও সচকিত হয়ে উঠেছে। ছাদ থেকে নিচে নামার একমাত্র উপায় ওই সিঁড়ি। দুজনে টর্চদুটোকে হাতিয়ারের মত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

              আচমকা একটা কান্ড ঘটল। সিঁড়ির ওপরে ছাদের যে অংশটা ভাঙ্গা ছিল, সেখান থেকে একটা প্রমাণ সাইজের ফুটবল সোজা নিচে পড়ে কয়েকটা ড্রপ খেয়ে নিচের চাতালটায় পড়ে গেল।

আর তার ঠিক পরেই যেটা ঘটল তাতে আমার দেহের সমস্ত রোম একসাথে খাড়া হয়ে উঠল।


সিঁড়ির ওপরের জায়গাটা থেকে এক পা এক পা করে নেমে আসছে অস্পষ্ট অবয়বের একটা সাত-আট বছরের বাচ্চা ছেলে। ঠিক বারোটা ধাপ নেমে সে নিচে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে চাঁদের আলো চাতালটায় সরাসরি এসে পড়েছে।


“কে?”

সন্দীপের মুখ দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় একটা অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছে। তার কারন আর কিছুই না, আমাদের থেকে হাত বিশেক দূরে যে বাচ্চাটি এসে দাঁড়িয়েছে, সে।

              চাঁদের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে এসে পড়েছে বাচ্চাটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাটায়। আর তার মুখ এখন স্পষ্ট।


এ মুখ আমার চেনা। বাইশ বছর পরের সন্দীপকে দেখে চিনতে কষ্ট হলেও এই চেহারা আর মুখ আমার ভুলবার নয়। সেই গোল গোল বিস্মিত চোখ, এলো চুল আর হঠাৎ অপরচিত লোককে দেখে ঈষৎ হাঁ করা মুখ। কোনও এক অদ্ভুত মায়াবলে আমাদের সামনে বিশ হাত তফাতে এসে দাঁড়িয়েছে বাইশ বছর আগের সন্দীপ। এবং তার দৃষ্টি এখনের সন্দীপের দিকেই।

কয়েকটা মুহুর্ত চুপচাপ। তারপর বাচ্চাটা গলা থেকে চাকতি জাতীয় কিছু একটা খুলে নিয়ে দু’পা এগিয়ে এসে সেটা সন্দীপের দিকে উঁচিয়ে ধরে রিনরিনে গলায় বলে উঠল,

“মেডেলটা ফেরত দেবে না?”

আরেকটা অস্ফুট চিৎকারের সাথেই একটা ধপ করে আওয়াজ করে দেখলাম সন্দীপের সজ্ঞাহীন দেহটা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। আর তার সাথেই আমার সামনের ওই ছেলেবেলার সন্দীপের অবয়বের আঙুলের ফাঁক গলে চাকতির মত জিনিষটা মাটিতে ঠং করে পড়ে গেল।

এটা... এটাই কি সেই বাইশ বছর আগের বিজ্ঞান মেধা পরীক্ষায় আমার না-পাওয়া সোনার মেডেলটা?

মুহুর্তের মধ্যে রহস্যটা আমার চোখের সামনে উন্মোচন হয়ে গেল। আমার মনের সন্দেহটাও সত্যি বলেই পরিণত হল। প্রধান শিক্ষকের নয়নের মণি হিসাবে পরিচিত সন্দীপের অবাধ যাতায়াত ছিল স্কুলে ওনার ঘরে। কোনও এক সময়ে ওনার অনুপস্থিতিতে ঘরে ঢুকে হয়তো ঈর্ষার বশবর্তী হয়েই মেডেলটা সরিয়ে ফেলেছিল সন্দীপ। পরে মেডেলটা না পাওয়া যাওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে আমাকে জানানো হয় যে মেডেলটা আসেইনি। পরে হয়তো অনুশোচনার বশেই আমাদের এই বাড়িতে খেলাধূলার ফাঁকে ওই কুলুঙ্গীতে মেডেলটা লুকিয়ে ফেলেছিল সন্দীপ। সরাসরি বলতে পারেনি লজ্জায়, ভয়ে। এবং এই কথাটাই এতদিন ধরে আমাকে বলতে পারেনি ও।

                   মনটা অদ্ভুত একটা তিক্ততায় ভরে গেল। একটা চাপা রাগ, ক্ষোভ আর দুঃখ মিশিয়ে গলার কাছটায় কিছু একটা দলা পাকাচ্ছে, এমন সময়ে আর একটা জিনিষ চোখে পড়ল।

ওপরের অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে এবার নেমে আসছে আরও একটা অবয়ব। একপা একপা করে সেও এবার নিচে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে। তার গায়ে লাল একটা জামা আর হাফ প্যান্ট। চুল উস্কো-খুস্কো, দোহারা চেহারা। পকেট থেকে বেরিয়ে আছে একটা বাঁশির কিছুটা অংশ।

              মুখ অস্পষ্ট হলেও এর পরিচয় সম্পর্কে আমার কোনও সন্দেহ নেই। ওই লাল জামা আজ থেকে বহু বছর আগে কিনে দিয়েছিল আমার জ্যাঠা। এতই প্রিয় ছিল যে ছোটোবেলায় সবসময় ওটাই পরে থাকতে চাইতাম। আর বাঁশির শখ ছিল বলে দাদুর কিনে দেওয়া ওই বাঁশি নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম আমি।

এরপর দেখলাম সেও এগিয়ে এসে আগের বাচ্চাটার পাশে এসে দাঁড়াল। দুজনের মুখ চাঁদের হাল্কা আলোয় এখন আমার সামনে পরিষ্কার। বাইশ বছর আগের আমি আর সন্দীপ পাশাপাশি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।


শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত উঠে মাথায় পৌঁছনর আগেই বুঝলাম এবার জ্ঞান হারাব।

                          আর হলও তাই।


*    *    *


যখন জ্ঞান ফিরল তখন সকাল হয়ে গেছে। চারিদিকে রোদ। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সন্দীপেরও সংজ্ঞা ফিরেছে। একটা স্তম্ভে পিঠে হেলান দিয়ে মেঝের ওপর পড়ে থাকা কিছু একটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমি উঠে গিয়ে চাকতির মত জিনিষটা তুলে নিলাম।


কাল রাত্রে আমরা কাদের দেখেছি তা জানার উপায় ছিল না। তবে যাদের দেখেছিলাম তারা অশরীরি কোনও প্রেতাত্মা নয়। তবে তারা হল ভূত। আসলে ভূত মানেই তো অতীত। যে অতীত আমরা ফেলে এসেছি বহু বছর আগে। ভুলে যাওয়া সময় আর ঘটনার ভীড়ে। এই ভূত বন্ধুত্বের। আমাদের দুজনেরই অবচেতন মনের গভীরে চাপা পড়ে যাওয়া সেই বন্ধুত্বের অতীত। সন্দীপের অতীত মানতে পারেনি তার কৃতকর্মের কথা। তাই তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল সেই জিনিষ ফিরিয়ে দেওয়ার কথা, যার অনুশোচনার ভার এতদিন নিজের মনের গভীরে নিয়ে বেড়াচ্ছিল ও। আর আমার অতীত কেন ফিরে এসেছিল সে সম্পর্কে আমার একটা আবছা ধারণা আছে। জ্ঞান হারাবার আগে তার এগিয়ে এসে ছোটোবেলার সন্দীপের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে কি ছোটোবেলার বন্ধুর একটা ভুলকে ক্ষমা করে দেওয়ার কোনও ইঙ্গিত ছিল?


আমার হাতের তালুর মধ্যে মেডেলটা সকালের সূর্যের আলোয় একবার চকমক করে উঠল। দু’ দশকের বেশি সময় হয়ে গেলেও তার ওপরের খোদাই করা লেখাটা এখনও পড়া যায়।


আকাশ চ্যাটার্জী
বিজ্ঞান মেধা পরীক্ষা ১৯৯৬
প্রথম স্থানাধিকারী ।।


বাইশ বছর আগের সেই সোনার মেডেল এতদিন পর আবার তার আসল মালিকের কাছে ফিরে এসেছে।।