Sunday, July 3, 2011

আমি একলাটি পথ হাঁটি

তেইশ বছর হয়ে গেল। মন কেমন করা বিকেলগুলোয় একা বসে বসে শুধু ভাবি। মানুষের এই এক বদ অভ্যেস। শুধু ভাবে। কেন ভাবে? কি ভাবে? নিজের কথা। পরের কথা। ভালবাসার মানুষের কথা। বাবা বলে যারা শুধু ভেবেই চলে তাদের জীবনে কিছু হয়না। জানি না ঠিক না ভুল। আমার তো ভাবতে ভাল লাগে। নানা কথা। জীবনে কত কি করেছি। ভুল, ঠিক। কাকে কি বলেছি। বলতে পারিনি। যত সব বলা, না বলা কথা মনে ভীড় করে আসে। এক ঝাঁক মানুষের দল। আসে, যায়। কেউ কেউ কাঁদায়। কেউ বা হাসায়। মুখ হল মনের আয়না। লোকের সামনে হাসতে হয়। একা থাকলেই কান্না পায়। কি জানি কেন। কত কি চেয়েছিলাম, কিছুই পেলাম না। এই ভাবেই জীবন কাটে। একটা গান মনে পড়ছে...“আমার সাধ না মিটিলো, আশা না ফুরালো, সকলি ফুরায়ে যায় মা”। আমি দুঃখবাদী। প্রেমের রোমান্টিসিজম-এ আমাকে বেঁধে রাখা শক্ত। তবে পথ হারাই মাঝে মাঝে। আবার ফিরে আসি। ভুল হয়। ভুলে যাই আমি কি চাই। আবার মনে পড়ে। বর্ষার রাতে কেঁদে কেঁদে নিজেকে মনে করাই। ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না। শপথ নেওয়া আর ভাঙ্গার মাঝেই জীবন চলে। কেউ ভগবান নয়। দিনের আলোয় যে সুখী, রাতের আঁধারে সেই সবচেয়ে একা। মন না চাইলেও জীবনের নৌকা এগিয়ে চলে। সামনের দিকে। টালমাটাল জীবন। সামলাবে কে? মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি যে আর পারিনে। চারিদিকে আঁধার। চলেছে এগিয়ে। কেউ জানে না আলো কোথায়। আঁধারে যে হাঁটে সে পেয়েছে এক বৃহৎ আলোর সন্ধান।

আমার আলাদা শোবার ঘর নেই। ভেতরের দিকে একটি ঘর। সেটিতে মা ও বাবা। বাইরের ঘরেই আমার শোয়া, বসা, দিন কাটানো। এই ঘরে একটি আত্মা থাকেন। তিনি কে আমার জানা নেই। রাতে আসেন, ভোরের প্রথম আলোয় চলে যান। লম্বা ঘর। এক কোনায় তিনটে চেয়ার পাতা। রাত গভীর হলে আমার পায়চারি। অন্ধকারে মিশে যেতে ভাল লাগে। মনে হয় কেমন অদৃশ্য হয়ে পৃথিবীটাকে দেখছি। নিজেকে ভগবান মনে হয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। একা লাগে। শূন্য বিছানার দিকে চোখ পড়ে। ছায়া ঘুমোয়, না কায়া। গভীর রাতকে মাঝে মাঝে বন্ধু মনে হয়। মাঝে মাঝে অচেনা। শত্রু। ভাবায়। হাসায়। কাঁদায়। কে যেন বলে গেছে সাধারন মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র এক-চতুর্থাংশ ব্যাবহার করে। তাতেই এত কিছু। যোগীরা নাকি আরো বেশি। তাতেই তাদের শক্তি। অলৌকিক কতো কি শুনি। কিছুই দেখলাম না। মানুষের জানার পরিধি কত সীমিত। মন কে বলি সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়তে। পারিনা। ডানার জোর না থাকলে পাখি উড়তে পারেনা। পথ হেটে চলি। একা একা। কথা বলি। নিজের সাথে নিজের তর্ক। একবার এ জেতে তো আর একবার ও। নিজেকে হারিয়ে সন্তষ্ট হই। জানি অন্যকে হারাতে পারবনা। কোনদিনই পারিনি। লাভের মধ্যে ভালবেসে ফেল্লুম। এমন একজনকে যে আমাকে চায়না। কোনদিন চাইতে পারেনা। শ্রীজিতা সে। আমার সংস্কার, আমি কি চাই সব গুলিয়ে ফেলে বলে বসলাম, ভালবাসি। একবার নয়, দু দুবার। সেই আওয়াজ পাথরের দেওয়ালে লেগে ফিরে এল। অনুমতি নেই। ছিল না। থাকবে না। পূজার ফুল বাসী হল। চোখের জলে সব ধুয়ে ফেললাম। কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। তাঁর পূজার ফুল তিনি নিয়ে গেছেন। ঘ্রানটুকু নিয়ে গেলেন। বাকিটা পড়ে রইল।

এদিকে মন বড়ই উচাটন। ভালবাসা চায়। কি করি। হস্টেল এ মানুষ। যে সময়ে মানুষ নিজের মা বাবা কে চায়, পেয়েছি বন্ধুবান্ধব। এখন তারা বাইরে বাইরে। নিজেদের জগৎ। না পারি তাদের বলতে, না পারি বাড়িতে নিজের দুঃখের কাহিনী মেলে ধরতে। অগত্যা মনেই সব। সেখানেই শুরু, সেখানেই শেষ। যাকে ভালবেসেছিলাম তাকে না পেয়ে একদিন যাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম তার কথা মনে করি। পল্লবী। তিনি আরো মহান। অহংকারের চূড়ায় বসে মনোনিবেশ করেছেন অন্য কাজে। বৃক্ষের সাথে নুড়ির কি সম্পর্ক? হাত বাড়ালেও পাওয়া যায়না। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে সিংহাসনের স্বপ্ন। তাতেও আনন্দ। মানুষের মন বড় জটিল। তল বোঝা ভার। কার মনে কি আছে কে জানে? নিজে কি চাই, তাই কি ছাই জানি? একবার এ ঘাট, তো আর একবার ওঘাট। লজ্জা ঢাকতে খান দুই টুপি কিনে ফেললাম। ওই মাথায় দিয়েই চলছে। রাস্তায় চেনা কেউ সামনে পড়ে গেলে টুপি দিয়ে মুখ ঢাকি। ভাবটা এমন যেন দুনিয়া সুদ্দু লোক আমার কীর্তিকলাপ জেনে বসে আছে।

বাড়িতে হইহই। বড়মাসী, মেসোমশাই হঠাৎ। কি কাজে এসেছিলেন, ঘুরে গেলেন। আমার মতন মুখচোরা ছেলে হয়না। জিজ্ঞেস করলেন কি পড়ছি। ভাবলাম বড় মুখ করে বলি, জার্মান শিখছি। পারলাম না। ‘টুকটাক’ বলে ছেড়ে দিলাম। চেনাজানা কারোর সাথে বেশি মাখামাখি করতে ইচ্ছে করেনা। আমার ব্যাপারে লোকে জানুক, তাও চাইনা। কি যে চাই, সেটাই বুঝিনা। ছোটবেলা থেকেই এই। বাড়ির বাইরে গিয়ে আরো কেমন হয়ে গেলাম। নিজের লোকেদের নিজের মনে হয়না। সবটাই কেমন ছাড়াছাড়া। বেহিসেবী। কে একজন আমার হাত দেখে বলেছিলেন, এই ছেলের সন্ন্যাস আছে। হায় ভগবান। আমি জানি আমার কি আছে। ওই লাইন আমার নয়। অনেক সাধনা দরকার হয়। ত্যাগ দরকার হয়। যে ছেলে সুখের খোঁজ শুধু মেয়েদের কাছেই পাবে মনে করে, তার দ্বারা এসব হওয়ার নয়। নিজেকে মাঝে মাঝে মুখোশ পরা এক শয়তান মনে হয়। কি চাই, কি করে ফেলি। কি বলতে চাই, কি বলে ফেলি। প্রেতাত্মা মনে হয় নিজেকে। একা একা হাটছি। পথ আর ফুরোয় না। হিসেবি মানুষ ধরে ফেলে। চীৎকার করে বলে, কি করছিস রে। চোখের পাতা আর পড়ে না। আগুন দেখেছি আমি। জ্বলতে চাই। নিজের ভেতরটা একদম পুড়িয়ে নিজেকে শেষ করে ছাড়ব। ত্রিকোন প্রেম, ডিভোর্স, আত্মহত্যা যোগ, সংসার, সন্ন্যাস কোনোটিই তো আর বাকি রাখেনি এই হাতে। লাফ দাও এই সাগরে। খেলো আগুন নিয়ে। কারোর মানা নেই। গেছিলে জ্যোতিষীকে ভুল প্রমান করতে। ফিরে এলে তো মাথা নিচু করে? কারোর কারোর এই জিনিসটা থাকে। সবাইকে ভুল প্রমাণ করার তাগিদ। তুমিই ঠিক, গোটা জগৎ ভুল। এবার ঠেলা সামলাও। তোমার জগৎকে আধখানা করে দিয়ে চলে গেল। অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল ভবিষ্যৎবাণী। কে আপন, কেই বা পর।

শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখি। বেনারস চলেছি। পথে হাজার লোক। এক একটা ঘটনা এমন থাকে মনকেও বিশ্বাস করানো যায়না। বেনারসের ওপর একটা অদ্ভুত টান ছিল। পল্লবীর কথা জানার পর সেটা আরো বেড়ে গেল। সব কিছু ঠিকঠাক চললে এবার পুজোয় কাশী দর্শন হবে। জানিনা মনের কি ভাব হবে সেই সময়। কি চাই তাই জানিনা। কেন যেতে চাই। পল্লবী কে খুঁজতে? সে তো তোমার বাড়ী থেকে একশ পা দূরেই থাকে। তার ছেলেবেলা খুঁজতে চাও? সে এখন কোথায় পাবে হে? রোমান্টিসিজমে না তোমার অরুচি? রাতে রুটি খাচ্ছ কার পরামর্শে? মনের মধ্যে ঝড় ওঠে। পুরনো সব কথা। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি।

আলসে দুপুর। নরম নরম। ধরনটা কেমন মেয়েলী মেয়েলী। আকাশ পাতাল ভাবি। আগে এটা ছিল না। ইদানিং হয়েছে। সব কিছু নিয়েই ভাবতে ভাল লাগে। বাইরের ঘরটাই এরকম। লোক তো লোক। কেউ নেই তো সব ফাঁকা। বেমালুম। মনে হয় কোনো এক দৈত্য যেন ভোজবাজির মতোন সব মুছে দিয়েছে। এই সময়ে একা একা ভালো লাগেনা। শ্রীজিতার কথা মনে পড়ে। মনকে বোঝালেও সে বুঝবে কেন? ভালোবাসা এমনই। সব নিয়ে চলে যায়। আমার আবার আর এক ঝামেলা। লাল এক চেয়ার। বিছানার উল্টো দিকে আমার দিকে মুখ করে আছে। সারা দিন এ এরকম। রাত্রে মুখ ঘুরিয়ে দিলেও সকালে উঠে দেখব এদিকে হয়ে বসে আছেন। কোন একজনের অবাধ প্রবেশ আছে এই ঘরে। তিনি কে আমি জানি না। জানতে চাইও না। তিনি শুধু দেখেন। আমি কি করছি। মনে মনে একদিন বলেও ফেলেছিলাম, আপনি যদি কোন শুভ আত্মা হন, আমাকে আমার ভালবাসা ফিরিয়ে দিন। বলেই জিভ কেটেছি। কে ভালবাসা। কার ভালবাসা। এ সংসার শুধু দেহ দিয়ে গড়া। দেহ চায় দেহকে। মনের খবর কে রাখে। তায় আবার ভালবাসা। মাঝে মাঝে ভয় হয় সংসার থেকে মন উঠে যাচ্ছে না তো? সব কিছুই কেমন যেন আলগা আলগা। দিদার অসুখ। শুনে মনের কোন পরিবর্তন হল না। ছোটমামার মৃত্যুসংবাদ পেয়েও ভাবলেশহীন ছিলাম। সে আজ পাঁচ বছর হয়ে গেল। জীবনের প্রথম দিকটায় একা থাকার ফলে কেমন একটা রুক্ষ হয়ে গেছি। সবেতেই মেকী মেকী ভাব। আবার কারনে অকারনে কাঁদতে ইচ্ছে করে। একটা ফন্দি করেছি। জার্মান একটা সিনেমার থিম মিউজিক মোবাইলে তুলে নিয়েছি। গভীর রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে গেলে ওটা শুনি আর কাঁদি। বালিশ ভিজে যায়। যাক। বাবা বলে আমি মেয়েলী। ছেলেদের সেই দৃঢ়তা আমার নেই। একাই চলে গেলাম চেন্নাই। একটা ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরে এলাম। লোককে ভুল প্রমান করতে বেশ লাগে। বিশেষত বাবাকে। কথা কাটাকাটি, মতের অমিল, ব্যাঙ্গ। আমি যা করি তাতেই ওনার খারাপ লাগে। এ আমাদের ফ্যামিলীতে নতুন না। বাবার সাথে দাদুর ছিল। তাঁর সাথে তাঁর বাবারও থাকতে পারে। অহংকার আর অভিমানই সব। কেউ কারোর কাছে মাথা নিচু করবেনা।

সন্ধের পর আমি রাস্তায়। হাটছি আর হাটছি। এ যেন একটা খেলা। নিজেকে আবিষ্কার করার। নিত্যনতুন চলছে। একই রাস্তা। একই মানুষজন। সেই উড়ন্ত পর্দা। চেনা, অচেনা মানুষ। চোখ খোঁজে পুরোনো কাউকে। পায়না। আর খুঁজে পেলেই বা কি? কেউ কারোর জন্যে অপেক্ষা করে থাকেনা। দুনিয়াটা অনেক বড় জায়গা। কাউকে ভাল লেগে গেলেই হলো। বসে যাও তার হাত ধরে। এ জন্মের মতন শখসাধ ঘুচে গেল। নিজেকে সামলানোই আসল জিনিস। কারোর হয়, কারোর হয়না। ফাঁদে পড়ে যায়, ছটফট করে, কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারেনা। কেউ কেউ পারে, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যায়। জীবনটাই এরকম। এই আছে, এই নেই। সূক্ষ সূতোর মতন তফাৎ। বুদবুদের মতন। হঠাৎই সব কিছু থেমে যায়। এই দিন, ত এই রাত। জীবন বড়ই অদ্ভুত। হাসি দিয়ে শুরু। কান্না দিয়ে শেষ। ওটাই সব। নিক্তি দিয়ে বিচার হবে, কি দিলে, কি নিলে। যার ভান্ডারে বেশি রইলো, সে জিতে গেল। রবার্ট ফ্রষ্ট লিখেছেন, A poem begins in delight and ends in wisdom. এও সেরকমই। লক্ষ্য রাখো কি শিখছ। কি জানছো। পাখির চোখ।

শেষটা করব শ্রীজিতার পাঠানো একটা কবিতা দিয়ে...

“আমি স্বপ্নকে দূরে সরে যেতে দেখেছি,
যা পাইনি তা হারাতেও দেখেছি
ফুল তো সদাই হাসে, লোকে বলে,
কিন্তু আমি সেই ফুলকে কাঁদতে দেখেছি।”