Sunday, June 30, 2013

অচেনা এক রাতে

টেলিফোনটা ছন্দে ছন্দে বাজছে।

ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় বাস্তব জগতের কোনও আওয়াজ সহসা কানে গেলে মনে হয়, যেন স্বপ্নে কোনও আওয়াজ শুনছি। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। অতল অন্ধকারের এক স্বপ্নের জগৎ থেকে মুহুর্তের জন্য একটা আধা-বাস্তব শব্দের অস্তিত্ব উপলব্ধি করেই আবার ডুবে গিয়েছিলাম সেই ঘুমের জগতে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সেই একই শব্দের পুনরাবৃত্তিতে মস্তিষ্ক এবার একেবারে সজাগ হয়ে ঘুমটাকে ছুটিয়ে দিল। এবং পরক্ষণেই সজাগ মন ও মস্তিষ্ক বলে উঠল, স্বপ্ন নয়, শব্দ হয়েছে বাস্তবেই। এবং শব্দের উৎস হল ওই এক টেলিফোন।

হ্যাঁ। টেলিফোনটা ছন্দে ছন্দে বাজছে।


শব্দটা আসছে একতলা থেকে। আমার ঘর তিনতলায়। লম্বা বারান্দার পাশে সারি দিয়ে পরপর তিনটে ঘর। উঁচু, লম্বা, দুই পাল্লা দেওয়া দরজার ঘর এক-একটা। বারান্দার শেষ প্রান্তে বাঁহাতে রয়েছে কাঠের হাতলওয়ালা ঘোরানো সিঁড়ি। এই সিঁড়ি যেমন নেমে গেছে একতলা পর্য্যন্ত, তেমনি সোজা উঠে গেছে ওপরের ছাদ অবধি। ছাদে যাওয়ার পথে ডানদিকে কাঠের দরজাওয়ালা একটা ঘর। লোহার তালা দিয়ে বন্ধ করা।

                                    এই বাড়ি দাদুর বাবার বানানো। চৌকো সাদা পাথরের চকমেলানো বারান্দার পাশে লোহার জাফরি। তাতে হরেক রকমের কারুকার্য করা। বারান্দায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে একতলার লম্বা একফালি উঠোন, আর তার পাশে বহুকালের অব্যাবহৃত একটা কুঁয়ো। উঠোনের পাশের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে বাঁদিকে বাগানে, যেটা বহু বছরের যত্নের অভাবে ছোটোখাটো একটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।  

রাত্রির নিস্তব্ধতা খান খান করে প্রায় আধ মিনিট ধরে শব্দ করে যন্ত্রটা থামল।

                                  বাড়িতে এসময়ে কেউ নেই। বছরের এই সময়টা গোটা বাড়িটাই প্রায় ফাঁকা পড়ে থাকে। অবশ্য বেশীর ভাগ সময়েই তাই। দাদুরা ছিল তিন ভাই। এক ভাই বিয়ে করেননি। দাদুর তিন ছেলে। আরেক ভাইয়ের এক ছেলে, এক মেয়ে। সব মিলিয়ে এক সময়ে অনেক লোকজন ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যা হয়, তাই ঘটেছিল। শরিকেরা আস্তে আস্তে নিজেদের মত সংসার গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এখন শুধুমাত্র পুজোর সময়ে বাড়িতে কিছু আত্মিয়ের আনাগোনা হয় বটে, কিন্তু তাও কম। আশ্রিতের সংখ্যাও কম ছিল না এই বাড়িতে। কিন্তু সবাই একাকিত্বের ভয়ে ধীরে ধীরে সরে পড়েছে। কারওর বা বিয়ে হয়ে গেছে। 

সত্যি কথা বলতে কি, এই অবস্থার জন্য কিছুটা আমরাই দায়ী। বাড়ির পুরোন দলিল একটা ছিল। কিন্তু বাড়ির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে কোনও কথাবার্তা দাদু বা তার ভাইয়েরা করে যাননি। তাই পরবর্তী প্রজন্ম যখন আস্তে আস্তে বড় হল, বাড়ি-বিষয়-সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। তার প্রধান কারণ এতগুলি শরিক, কেউ তার নিজের এতটুকু অসুবিধা করে পরের জন্য ভালো দিকটা ছেড়ে দেবেনা। তাছাড়া ভাগ-বাটোয়ারা হলে বহুকালের যারা আশ্রিত তাদের পথে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। তাই বাবা-কাকা-জ্যাঠারা এত হাঙ্গামা করতে চাননি। মানুষগুলো আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। পড়ে রইল একা এই বাড়িটা।

                                                এবং অবশ্যই আমি।


মেঝেতে পা ফেলে চটিজোড়া খুঁজতে গিয়ে পেলাম না। আশ্চর্য্য! এই পুরোনো বাড়িতে খালি পায়ে হাঁটা দুষ্কর। বিছানার পাশে উত্তরের জানালাটা কখন জানি খুলে গেছে। নভেম্বরের শুরু। একটা ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকছে। এদিকটা ফাঁকা বলেই মনে হয় একটু বেশী ঠান্ডা লাগে। জানালার ওদিকটায় একটা ফাঁকা জমি বহুকাল ধরে পড়ে আছে। অনেকদিন আগে স্থানীয় একটা মিষ্টির দোকান তাদের কর্মীদের বসবাসের জন্য নিয়েছিল। এখন জঙ্গল। বাড়িটার পূর্বদিকে রাস্তা পেরিয়ে একটা পাঁউরুটি কারখানা ছিল। এখনও আছে অবশ্য। মনে আছে ছোটোবেলায় সকালবেলা কারখানাটা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসত। অতীতের কত স্মৃতিই না মানুষের বুকে জমে থাকে। শুধু মাঝে মাঝে সেগুলো...

                                              ওটা কী?

                                    একটা শব্দ। আসছে পূর্বদিকের বাগান থেকে। শব্দটা বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে ক্রমশঃ যেন এগিয়ে আসছে। কারোর একটু পা ঘষটে, খুঁড়িয়ে চলার শব্দ। কিছুদূর এসে আওয়াজটা হঠাৎ থেমে গেল। চোর-ছ্যাঁচোড় নয় তো? বলা যায় না। যদিও এই বাড়িতে চুরি করার মত জিনিষ বলতে সেরকম কিছু অবশিষ্ট নেই, তবু সাবধানের মার নেই।

কি করব, কি করব ভাবছি, এমন সময়ে আওয়াজটা আবার শুরু হল। বাগানের মাঝখান থেকে শুরু হয়ে অস্পষ্টভাবে পা ঘষটে, ঝোপ-জঙ্গল ঠেলে কেউ যেন এগিয়ে আসছে। প্রায় বিশ গজ চলে আওয়াজটা ক্রমাগত হওয়ার পর অস্পষ্ট ঘষটানিটা এবার স্পষ্টতর হল। বাগান পেরিয়ে আওয়াজ এবার উঠোনে।    

                               
                             বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। টেবিলের ওপর কয়েকটা মোমবাতি রাখা থাকে। তারই একটা জ্বালিয়ে নিয়ে ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। অবশ্য এতে কাজের চেয়ে অকাজের সম্ভাবনাই বেশী। চোরজাতীয় কেউ বাড়িতে ঢুকে থাকলে এই মোমবাতির মৃদু আলোয় তাকে দেখা প্রায় অসম্ভব। উলটে আলোর উৎস অনুসন্ধান করে চোর আমার উপস্থিতি ঠাহর করে নিতে পারে। বারান্দার জাফরিগুলোর কাছ থেকে সরে এসে দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়ালাম। একবার নীচে নেমে না দেখলেই নয়।

                     লম্বা বারান্দায় আরও দুটো ঘর পেরিয়ে সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। মোমবাতির আলো এসে পড়ছে ঘোরানো সিঁড়িটায়, উল্টোদিকের কাঠের দরজাওয়ালা ঘরটায় আর ছাদে যাওয়ার সিঁড়িতে।


কাঠের দরজাওয়ালা ঘরটা আজ বহু বছর হল তালাবন্ধ। এটায় একসময়ে বুইপিসী থাকত। বুইপিসী আমাদের নিজেদের কেউ না। অনেক বছর আগে দাদুর এক বন্ধু ও বন্ধুপত্নী হঠাৎ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে দাদু বুইপিসীকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখেন। তারপর থেকে পিসী আমাদের বাড়িরই একজন হয়ে গিয়েছিল। পরে এই বাড়ি থেকেই বুইপিসীর বিয়ে হয়ে যায়। মনে পড়ল, যখন ছোটো ছিলাম, সাত-আট বছর বয়সে, এই ঘরটায় পিসী তখন দিনেরবেলা নাচ শিখত। ঘুঙ্গুরের আওয়াজ পাওয়া যেত বেশীর ভাগ সময়ে। অনেক বছর পর, খবর এসেছিল পিসী নাকি হঠাৎ শ্বশুরবাড়ি থেকে নিঁখোজ হয়েছে। অনেক খোঁজা-খুঁজি, থানা-পুলিশ করেও কোনও লাভ হয়নি। কিন্তু এর পরে কিছুদিনের মধ্যেই কাণাঘুষো শোনা যেতে লাগল বাড়ির আনাচে-কানাচে। গভীর রাতে নাকি এই ঘর থেকে নাচের আওয়াজ পাওয়া যায়। আসে ঘুঙ্গুরের শব্দ। বাড়ির প্রতি বাসিন্দাদের চাপা ভীতি ও বিরাগের সেই সূত্রপাত।
                                    
                              কিন্তু সেই শেষ নয়। আগেই বলেছি বাড়িটা অনেক পুরোনো। সেবার দোতলায় আমার ঘরটার ওপরের ব্যালকনির কিছুটা অংশ ভেঙ্গে পড়ল। মেরামতি আর যত্নআত্তির অভাব। অবশ্য হলও কিছুটা এর পর। কিন্তু আমার ঘর গেল বদলে। ঠাঁই হল তিনতলার কোণার ঘরে।  


বাড়ির কথা বলছিলাম। ছোটো-বড় নানা ঘটনা দিয়ে সাজানো এই বাড়ি। আরেকটা ঘটনা, এটা এক খুড়তুতো দাদার কাছে শোনা। তারই অভিজ্ঞতা। তিনতলারই একটা ঘরে থাকত সে সেইসময়ে। কলেজের পরীক্ষা শেষ। দুপুরবেলা সেই দাদার এক বন্ধু দেখা করতে এসেছে। দাদার ঘরে ঢুকেই তার বন্ধুটি বলল, তিনতলা থেকে সাত-আটটি ছেলেমেয়েকে সে দৌড়ে ছাদের দিকে উঠে যেতে দেখল তারা কারা? কারন এদের তো সে কোনওদিন এই বাড়িতে দেখেনি। দাদাও শুনে অবাক। এত কমবয়সী এত ছেলেমেয়ে একসাথে কোথা থেকে এল? দুজনে মিলে দৌড়ে গেল ছাদে খোঁজ করতে। কিন্তু না। ছাদে বা গোটা বাড়ি খুঁজেও এরকম বাচ্চা ছেলেমেদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দাদার বন্ধু, যে সেই বাচ্চাদের ছাদের দিকে একসাথে দৌড়ে যেতে দেখেছিল, সে তখন আতংকে আর উত্তেজনায় ঠকঠক করে কাঁপছে। 

                          
                       কাঠের হাতলওয়ালা ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে একহাতে মোমবাতিটা ধরে এগিয়ে চললাম। আটটা ধাপ নেমে একশো আশি ডিগ্রী ঘুরে আবার আটটা ধাপ নামলে দোতলা। মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় চার-পাঁচ হাত দূরের জিনিষও ভালো করে দেখা কঠিন। মেঝেতে আলো পড়ে ঠিকরে পড়েছে কিছুদূর। দোতলার মেঝেটা তিনতলার মতোন চৌকো পাথর-বসানো নয়, গাঢ় লাল পাথরের। একটু বেশী ঠান্ডা। জাফরীগুলোও এখানে অনুপস্থিত। খোলা বারান্দা দিয়ে নভেম্বরের একটা ঠান্ডা মাঝে মাঝেই এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এখন বুঝলাম নিজেরই ভুল হয়েছে। ঘর থেকে বেরোনোর সময়ে আলোয়ানটা গায়ে চাপিয়ে বেরোলে এই জিনিষটা হত না।

                              পায়ের আওয়াজটা অনেকক্ষণ হল থেমে গেছে। ওটা কি উঠোন থেকে আবার বাগানের দিকেই ফিরে চলে গেল? নাকি উঠোন পেরিয়ে দক্ষিণে কুঁয়োর দিকে গেছে? এত অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার মধ্যে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। শীতের শুরু, এইসময়টায় একটা ঝিঁঝিঁপোকাও ডাকে না। চারদিকটাই কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে আছে। কতক্ষণ এইভাবে আলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব? 

বাইরে কোথাও একটা কুকুর ডাকছে। কাছেপিঠে নয়, অনেক দূর থেকে। ক্রমাগত ডেকেই চলেছে। রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে অনেক দূরের শব্দও কাছের বলে মনে হয়। এক সময়ে, বড়মাসীদের একটা ভালো জাতের কুকুর ছিল। আলশেসিয়ান, নাম ছিল জ্যাকি। যতদিন সে বেঁচে ছিল, আমি মাসীদের বাড়ি যেতে ভয় পেতাম। মারা যাওয়ার পর খারাপ লাগত। শেষ কয়েকটা মাস কুকুরটা চুপচাপ শুয়ে থাকত। বাড়িতে একবার পোষ্য আনলে সে বাড়িরই একজন হয়ে যায়। তারপর তার অকালে চলে যাওয়াটা কে ভালো মনে কিছুতেই নেওয়া যায়না। 

                         এবার যেন আরও কতকগুলো কুকুর প্রথম কুকুরটার ডাকে সাড়া দিয়ে উঠলো। মনে হল, ডাকগুলো যেদিক থেকে আসছিল সেইদিকেই আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। আবার সেই গভীর নিস্তব্ধতা।

দক্ষিণের খোলা বারান্দা দিয়ে হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া বয়ে এল। মোমবাতিটা নিবু-নিবু হয়েও কোনওমতে জ্বলছে। বেশ বড় মোমবাতিটা। পুরোনো আমলের, একটু পেঁচানো, আর লাল মোম দিয়ে বানানো। সঙ্গে পেতলের মোমবাতিদানি। নীচের দিকে ধরার ছোটো হাতলও রয়েছে। দমকা হাওয়াটায় সামনের ঘরের ওপর থেকে কি একটা খসে পড়েছে মনে হল। কাছে আলো নিয়ে যেতে বুঝলাম, আর কিছুই না, চড়ুই পাখির বাসা। তত্ত্বাবধানের অভাবে পুরো বাড়িটাই জীব-জন্তুর বাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে।       


                                               যে ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেটা এককালে ছিল দাদুর। এইঘরে একসময়ে আমি আর খুড়তুতো ভাই-দাদারা ভিড় জমাতাম দাদুর কাছে গল্প শুনব বলে। সেসব গল্প অবশ্যই দাদুর নিজের জীবনের ঘটনা। হাজারীবাগে বনভোজনে গিয়ে একবার বাঘ দেখেছিল দাদু খুব সামনে থেকে। সেই গল্প এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। আর ছিল স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী দেশের ঘটনা। আমাদের বাড়ির দক্ষিণে রাস্তা পেরিয়ে জেলা কলেজের বিশাল বড় মাঠ। সেই মাঠ পেরিয়ে আরও দক্ষিণে ছোটো একটা পায়ে চলা রাস্তা-লাগোয়া পুরোনো জেলখানা। শোনা যেত, স্বাধীনতার আগে, যারা স্বদেশী করত, রাত-বিরেতে পুলিশ তাদের ধরে এনে এখানে বিনা বিচারে ফাঁসি দিয়ে দিত। স্বাধীনতের পরে কিন্তু ওই জায়গাটা ভেঙ্গে ফেলা হয়নি। ওরকমই রয়ে গেছে। শোনা যেত, রাত্রেবেলা ওই পথ দিয়ে গেলে লোকে নাকি চাপা কান্না শুনতে পেত। পুরোনো, ভাঙ্গা কারাগারগুলো থেকে রক্তের ফোঁটা পড়ার আওয়াজ পাওয়া যেত। দাদুর নিজের জীবনেও এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছিল। একবার, দাদু তখন অনেক ছোটো, দাদুর বাবা তাকে আর তার ভাইকে নিয়ে ওই জায়গায় খাবারের জল আনতে গিয়েছিলেন। ওই জেলখানার পাঁচিল লাগোয়া ঝোপ-জঙ্গলে ভরা একটা জমিতে খুব গভীর একটা কুঁয়ো ছিল।। শহরের অনেকেই ওখান থেকে জল আনতে যেত। 

                                              সময়টা তখনও ছিল শীতকাল। পড়ন্ত বিকেল।  সূর্য প্রায় অস্ত যায় যায়। দাদুর বাবা যখন তার দুই ছেলেকে নিয়ে মাঠটা পেরিয়ে কুঁয়োর দিকে রওনা দিয়েছেন, অন্ধকার প্রায় নেমে এসেছে। জেলখানার পাঁচিল বরাবর হাঁটতে হাঁটতে ওরা লক্ষ্য করলেন একদম শেষ প্রান্তে একটি সাদা কাপড়ের ওপর বসে একমনে একজন মুসলমান ফকির প্রার্থনা করছেন। সাদা বেশ, মাথায় ভাঁজ করা টুপি, চোখ বন্ধ। ওরা তিনজন লোকটিকে পেরিয়ে ঝোপঝাড়ে ভরা জমিটায় এসে পড়লেন। কুঁয়োর থেকে যখন হাত বিশ দূরে, তখন হঠাৎ একটা কান্ড ঘটল। কোথা থেকে একটা বাদামী রঙের নরম পদার্থ চাকার মতোন গড়াতে গড়াতে এসে কুঁয়োর মুখটা একেবারে বন্ধ করে দিল। দাদুর বাবা, দাদু ও তার ভাই অবাক।     

দাদুর বাবা ছিleলেন বিচক্ষণ মানুষ। বুঝলেন কেউ যেন চায় না তার প্রার্থনার সময়ে ব্যাঘাত ঘটুক। তিনি তার দুই ছেলেকে ডেকে বললেন, “চল রে, আজ আর জল নেওয়া হবেনা।” ফেরার পথে দেখা গেল, যেখানে লোকটিকে প্রার্থনারত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল, সেখানে শুধুই সেই সাদা কাপড়টা পড়ে আছে। জনমানুষের দেখা নেই।


ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি। হঠাৎ নীচের তলায় টেলিফোনটা আবার বেজে উঠলো। আবার সেই ধাতব, একটানা শব্দ। আধমিনিট কলের পুতুলের মত এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে যন্ত্রটা থামল। আশ্চর্য্য! এত রাতে কে কথা বলতে চায়? কার সাথে কথা বলতে চায়?

                                             ঠিক এইসময়ে আরেক পুরোনো উপদ্রব শুরু হল। অস্পষ্ট, পা-ঘষটানির শব্দ। এবার শব্দটা জোরালো। উঠোন পেরিয়ে মনে হল কেউ যেন দক্ষিণে কুঁয়োর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ধাতব কিছু একটা জিনিষের শব্দ পেলাম মনে হল। শাবল কী? ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। iইতিমধ্যে আরও একটা পদশব্দ পেলাম। দক্ষিণ-পূর্বের সদর দরজা পেরিয়ে হেঁটে আসার। এই আওয়াজ অপেক্ষাকৃত ভারী পায়ের। দ্বিতীয় পদশব্দ মনে হল কুঁয়োর কাছে এসে প্রথম পদশব্দের মালিকের সাথে যোগ দিল। শাবলের ঠং ঠং শব্দ হচ্ছে। এত রাতে কেউ কি মতলবে কারোর বাড়িতে খোঁড়াখুঁড়ি করতে পারে? চোর কী? মনে হল বারান্দার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ানো উচিত। আলো দেখলে চোরেরা যদি কিছুটা ভয় পায়। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম বারান্দাটার সামনের দিকে, তারপর মোমবাতিটা আস্তে করে তুলে ধরলাম। 

                                        চকিতের মধ্যে কোথাও একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। ধাতব শব্দটা মুহুর্তের মধ্যে গেল থেমে। তারপর একটা শব্দ পেলাম। আর্তনাদ। কেউ যেন প্রচন্ড ভয়ে, আতংকে চেঁচিয়ে উঠল। আর তারপরেই দুটো জিনিষ ঘটল। ভারী পায়ের শব্দটা একটা অস্ফুট আওয়াজ করে হুড়মুড় করে সদর দরজার দিকে দৌড় লাগাল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই কুঁয়োর জলে কিছু একটা পড়তে শুনলাম। চোরের শাস্তি। মৃত্যু না হলেও সকাল অবধি বাবাজীর রক্ষে নেই। কাল সকালে পাড়া-পড়শীরা এসে উদ্ধার না করলে চোরের কপালে দুঃখ আছে।


                                                            মনে মনে একচোট হেসে আলো নিয়ে ওপরের ঘরে ফিরে যাব ভাবছি। এমন সময়ে টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। বিরক্তিকর। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে দুটো ঘর পেরিয়ে তৃতীয় ঘরে টেলিফোন। কাঠের দরজার পাল্লাদুটো ঠেলতে ক্যাঁচ করে খুলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনের শব্দটা গেল থেমে।

                   কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এবার টেলিফোন বাজলে অবশ্যি ধরতে হবে। চোরগুলোর কথা ভেবে আবার হাসি পেল। নির্ঘাত ভূত ভেবেছে। তবে মোমবাতি-হাতে ভূতের কথা এবাড়িতে আগেও শুনেছি। এবারই পুজোতে একদল আত্মীয় এসে উঠেছিল এখানে ছুটি কাটাতে, তাদের মুখ থেকে। তবে চোর-ডাকাতের আনাগোনার ব্যাপারটা ভালো ঠেকল না। বাড়িটা একসময়ে কত লোকজনে গমগম করত। আর আজ অন্ধকারে নিস্তব্ধ প্রেতের মত একাকী দাঁড়িয়ে আছে। উল্টোপাল্টা লোকজন এসে ঢুকে পড়ছে রাতবিরেতে।

                                            ঘরটা অসম্ভব গুমোট লাগছে। আর অন্ধকারও। মোমবাতির আলোয় দু-তিন হাতের বেশী দৃষ্টি যায়না। সাবধানে এগিয়ে গিয়ে উল্টোদিকের একটা জানালার পাল্লাদুটো খুলে দিলাম। ঘরটায় খানিকটা হাওয়া আসুক। জানালার উল্টোদিকেই টেলিফোন। কালো রঙের যন্ত্রটার দিকে চোখ পড়তেই সেটা বেজে উঠল। ডান হাতে মোমবাতিটা ধরে বাম হাতে রিসিভারটা কানের কাছে তুলে ধরলাম। আর ঠিক সেই সময়ে খোলা জানালা দিয়ে দমকা একটা হাওয়া এসে মোমবাতিটাকে দিল নিভিয়ে। আর সেই সঙ্গে আমিও একটা জিনিষ লক্ষ্য করে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। 

                                       ঘরের একমাত্র বাতি গেছে নিভে। কিন্তু খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের যে একফালি আলো এসে আমার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা আয়নাটায় পড়েছে, তাতে একটা অদ্ভুত জিনিষ দেখা যাচ্ছে। মাটি থেকে অনেকটা ওপরে ফোনের রিসিভারটা ঝুলছে। তার সামান্য পাশেই একটু আগেই নিভে যাওয়া মোমবাতিটা থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে। কিন্তু দুটো জিনিষই যেন এক অদৃশ্য সুতো দিয়ে ঝুলে আছে। যেখানে আমার শরীরটা থাকার কথা ছিল, সেই জায়গাটা শূন্য। একেবারেই শূন্য।


আসলে এতবছর হয়ে গেছে বলেই হয়ত মাঝে মাঝে মনে থাকেনা। সেবার দোতলায় আমার ঘরের ওপরের বারান্দার অংশটা ভেঙ্গে পড়ার সময়ে আমি ওই ঘরের মধ্যেই ছিলাম। পরের দিন বাড়ির লোকজন অনেক কষ্টে ইঁট-পাথর সরিয়ে দেহটাকে উদ্ধার করে। কিন্তু তখন আমি আর সেই আমি নেই।
                                     

                              
                              যাই হোক, এবার আবার তিনতলায় নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার পালা ।। 




        

10 comments:

  1. As usual tui sei twist diyechhis last e jeta amar sorbopriyo laage as a style. Chaliye jaa. Tor saamne birat future. ;)

    ReplyDelete
    Replies
    1. Ar bhai future. Time pai na beshi lekhar.

      Delete
  2. jodio ending ta predictable .. but lekhar badhon ar shobdo-choyon khub sundor .. tor hobe bhai ,, :)

    ReplyDelete
  3. Replies
    1. Arre bhai. Gurujon der niye tana-tani keno. :'(

      Porar jonne dhonnobaad. :)

      Delete
  4. darunnn likhechis! :) banglay lekha bole onek khon time laglo porte, but it was worth reading! next golper jonno wait kore roilam!!!

    ReplyDelete