Saturday, October 24, 2015

মোমপাহাড়ের আতঙ্ক


ছোটোবেলা থেকেই আমি মানুষটা একটু এলোমেলো, খামখেয়ালী ধরনের। গতানুগতিক জীবনের কোনোকিছুই কোনওদিন ভালো লাগত না। কলেজের ডিগ্রী পাশ করার পর তাই চাকরি-বাকরির চেষ্টা না করে ঠিক করলাম লেখক হব। কারোর অধীনে কাজ করা কোনওদিন ভালো লাগেনি। ভাবলাম, সারাজীবন বাগদেবীর আরাধনা করে কাব্য-সাহিত্যচর্চা নিয়ে কাটিয়ে দেব। বন্ধু-বান্ধবের বেশীর ভাগ সরকারি-বেসরকারী চাকরি নিয়ে এদিক-ওদিক ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পড়ে রইলাম একা আমি, আমার লেখক হওয়ার স্বপ্ন আর কিছু নতুন-পুরোনো খাতা-ভর্তি লেখা।

                            কিন্তু কপাল মন্দ। গল্প-কবিতা লেখা আর সেগুলো ছাপার মাঝখানে যে একটা বিস্তর কাঠখড় পোড়ানোর ব্যাপার আছে, সেটা জানা ছিলনা। বয়স কম, অভিজ্ঞতাও অল্প। প্রকাশকেরা কেউ আমল দিলেন না। কেউ বললেন, লেখায় সেই ব্যাপারটা নেই, যেটা আর পাঁচটা সাহিত্যিকের মধ্যে আছে। কেউ বা বললেন ভারতভ্রমণ করে বিস্তর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তারপর লেখালেখির কাজে হাত দিতে। মোট কথা, সাহিত্যচর্চার স্বপ্ন ব্যর্থ হতে বেশী দেরী হলনা। দু’-তিন বছরের মধ্যেই বাস্তব জগৎটা চোখের সামনে একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। মাসিক পত্রিকায় আর সাপ্তাহিক কাগজে কালে-কস্মিনে দু’একটা গল্প-কবিতা লিখে যে টাকা রোজগার হচ্ছিল তাও তলানিতে এসে ঠেকল। বুঝলাম, এ জিনিষে বেশীদিন চলবে না।


তবে মানুষের ভাগ্য তাকে কখন কিভাবে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলে, কেউ জানে না। বরাতজোরেই হোক বা অন্য কোনওভাবে, হঠাৎই ব্যাঙ্কের একটা সরকারি চাকরি জুটে গেল। সহকারি ম্যানেজারের পদ, বেতনও বেশ ভালো। অসুবিধের মধ্যে একটাই, নিজের রাজ্যের বাইরে চাকরি। থাকা-খাওয়ার অনিশ্চয়তা। ভাবলাম, এক দিক থেকে ভালোই হল। এই সুযোগে বাইরের পৃথিবীটাকে একটু কাছ থেকে দেখতে পাব। কিছুদিনের মধ্যে ব্যাঙ্ক চিঠিও পাঠিয়ে দিল। অন্ধ্রপ্রদেশের ছোট্ট একটা শহরে পোস্টিং। নাম, মেহবুবনগর।  

               কথামতো এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ফলকনামা এক্সপ্রেস ধরে ‘জয় দুর্গা’ বলে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম চাকরির রোমাঞ্চ, তাই সাতাশ-আঠাশ ঘন্টার জার্নি যেন কোথা দিয়ে চলে গেল। হায়দরাবাদ অবধি ট্রেনে এসে সেখান থেকে কানেক্টিং বাসে মেহবুবনগরের পথ ধরলাম।

            শহর ছাড়িয়ে ঘন্টাখানেক যেতেই দুটো জিনিষ নজরে পড়ল। প্রথমতঃ, ইংরাজীতে যাকে আমরা আউটস্কার্টস বলি, অন্ধ্রপ্রদেশের মূল জোড়া শহর হায়দরাবাদ-সেকেন্দ্রাবাদ ছাড়া সেই আউটস্কার্টসের পুরোটাই উঁচু-নিচু পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা। অনেক জায়গায় দেখলাম পথের দুধারেই পাহাড় যেন উঁচু দেওয়ালের মতন দাঁড়িয়ে আছে। আর অন্য ব্যপারটা হল এখানকার আবহাওয়া। হায়দরাবাদে ট্রেন থেকে নেমে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল বাসের জন্য, এবং তার মধ্যেই জায়গাটার রুক্ষ আবহাওয়া অনুভব করেছিলাম। কিন্তু বাসে করে যতই দূরের পাহাড় আর জঙ্গলগুলোর কাছে এগোতে লাগলাম, ততই যেন ঠান্ডা কনকনে একটা বাতাস সোঁ সোঁ শব্দে এসে মুখে ঝাপটা মেরে গাল আর কানদুটোকে অবশ করে ফেলতে লাগল।

                       ঘন্টা তিনেক চলার পর বাস গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছল। পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা অন্ধ্রপ্রদেশের মেহবুবনগর ডিস্ট্রিক্টের জেলা সদর। একসময় শহরটাকে ‘পালামুর’ বলেও ডাকা হত। আঠারোশ’ নব্বই সালে হায়দরাবাদের নিজাম মীর মেহবুব আলি খানের নামে এই শহরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মেহবুবনগর।  

         জায়গাটা বেশ পছন্দই হয়ে গেল। অফিসে জয়েন করার প্রথম দিনই আমার বয়সেরই একটি ছেলের সাথে পরিচয় হল। নাম রাজন রক্ষিত। জন্মসূত্রে বিহার থেকে হলেও পড়াশুনা কলকাতার কাছেই, শ্রীরামপুরে। বাংলাটাও দিব্যি বলে। আর আমারই মত তারও নতুন চাকরি। দেখলাম, ভালোই হল। স্বদেশ থেকে এতদূর এসে অন্ততঃ বাংলা ভাষাটা আমার থেকে আলাদা হবেনা। দুজনে মিলে কয়েকদিন খোঁজাখুঁজি করে একটা ভাড়াবাড়িও দেখে ফেললাম থাকার জন্য। একমাসের মধ্যেই সবকিছু গুছিয়ে ফেলে একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেললাম।  


                           যে সময়টার কথা বলছি, সেই সময়ে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যটা তেলেঙ্গানা বা রয়ালসীমায় বিভক্ত হয়ে যায়নি। কিন্তু নিউজে-খবরের কাগজে নিত্য-নতুন অনশন-বিরোধ-আন্দোলনের খবর উঠে আসছে। সবাই বলছে, এবার অন্ধ্রপ্রদেশ বিভক্ত হবেই। আর মেহবুবনগর হবে তেলেঙ্গানার অন্তর্বর্তী। এমনকি আমাদের বাসা থেকে অদূরবর্তী একটা চৌমাথার নামও দিয়ে ফেলা হয়েছে – তেলেঙ্গানা চৌরাস্তা। চারদিকে সাজো সাজো রব।

             আগেই বলেছি, শহরটা খুব ছোটো। মাস দুয়েক থাকার পর বুঝলাম, যতটা ছোটো ভেবেছিলাম, জায়গাটার পরিধি তার থেকেও কম। বসতি বলতে গেলে শরটা দৈর্ঘ্যে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার। আর প্রস্থে বড়জোর এক-দেড় কিলোমিটারের মতন। হায়দরাবাদ থেকে ন্যাশানাল হাইওয়ে নম্বর সেভেন ধরে প্রায় একশ’ কিলোমিটার গিয়ে ডাঁয়ে বেঁকে একটা অপেক্ষাকৃত সরু দু’লেনের রাস্তা সোজা চলে এসেছে মেহবুবনগর। এই একই রাস্তা আরও এগিয়ে সোজা চলে গিয়েছে ভূতপুর অবধি। মেহবুবনগর থেকে আবার আরেকটা দু-লেনের রাস্তা ডাইনে বেঁকে পৌঁছে গেছে মহারাষ্ট্র-অন্ধ্রপ্রদেশের সীমায় অবস্থিত তান্ডুর শহর পর্যন্ত।  

মেহবুবনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে তেলেঙ্গানা মোড়টা কাছেই, হাঁটাপথে তিন-চার মিনিট। শহরের কেন্দ্রস্থল বলতে এটাকেই বলা যায়। উত্তরের রাস্তাটা এখান থেকে সোজা চলে গেছে দু-তিন কিলোমিটার দূরের রেললাইনটা পেরিয়ে উঁচু স্থানীয় পাহাড়গুলোর দিকে। দক্ষিণের রাস্তাটা মিশেছে বাসস্ট্যান্ডে। এখান থেকেই ডানদিকে ভূতপুর আর বামদিকে হায়দরাবাদের রাস্তা। তেলেঙ্গানা মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তাটা মিনিট দশেক হাঁটাপথ হয়ে পড়েছে আর একটা চৌমাথায় – নাম, ইয়ারা সত্যামা স্টাচু চৌরাস্তা। আমাদের বাড়িটা ঠিক এখানেই। ইয়ারা সত্যামা স্টাচু থেকে ডানদিকের রাস্তাটা আমাদের বাড়ির সামনে হয়ে একটা বড় খেলার মাঠের পাশ দিয়ে গিয়ে মিশেছে হায়দরাবাদ যাওয়ার মেন রোডে। বাঁয়ের রাস্তাটা ঢালে অনেকখানি নেমে গিয়ে পাহাড়ের দিকে যাওয়ার রাস্তাটায় মিশেছে। আর অন্যদিকের রাস্তাটা উর্ধ্বমুখে সোজা গিয়ে মেহবুবনগর রেলস্টেশনে শেষ হয়েছে।

          দু’-তিন মাসের মধ্যে জায়গাটা ধাতস্থ হয়ে গেল। সকালে ব্রেকফাস্ট করে অফিসে বেরিয়ে যাই, সন্ধ্যেবেলা ফিরে কফি-টোস্ট খেতে খেতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। সন্ধ্যের অন্ধকারে দূরের পাহাড়গুলোকে মোহময় রহস্যে ঘেরা দৈত্যের মতন লাগে। জুলাইয়ের অঝোর ধারায় বৃষ্টি মাঝে মাঝে পাহাড়গুলোকে অস্পষ্ট করে দেয়। ধূমায়মান কফির কাপ হাতে নিয়ে তাই শুধু দূরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকি। নিকষ কালো অন্ধকারে দিগন্তবিস্তীর্ণ শুধু ধূসর বৃষ্টির রেখা।

            মাঝে মাঝে ফেলে আসা জীবনের কথা মনে পড়ে। আমার লেখক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার অভিমান...

দিনের আলোয় দূরের পাহাড়গুলোর মধ্যে একটাকে একদম স্বতন্ত্র লাগে। রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনগুলোয় সারাদিন কোনও কাজ থাকেনা, তাই বাড়িতেই বন্দী থাকতে হয়। মধ্যাহ্নে, সূর্য যখন মাথার একদম ওপরে, তখন স্থানীয় দোকান থেকে কিনে আনা একটা দূরবীন দিয়ে পাহাড়টাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করি। আমাদের বাড়ির পূর্বদিকে চওড়া খোলা বারান্দা। সেখান থেকে পাহাড়গুলোকে পরিষ্কার দেখা যায়। পাহাড়গুলোর ঢালটা উত্তর-পশ্চিম থেকে শুরু হয়ে উত্তর-পূর্বে শেষ হয়েছে। যে স্বতন্ত্র পাহাড়টার কথা বলছি, সেটা একদম শেষে। ঢালটা কোথায় শেষ হয়েছে এখান থেকে দেখা যায়না। শুনেছি পাহাড়গুলোর ওপাশে অন্ধ্রপ্রদেশ গভর্ণমেন্টের একটা জঙ্গল আছে। হয়তো ঢালটা ওখানেই কোথাও শেষ হয়েছে। স্বতন্ত্র পাহাড়ের ডানদিকের ঢালটা একটু অদ্ভুত। একদম ন্যাড়া। একটা গাছপালা বা ঝোপজঙ্গলেরও অস্তিত্ব নেই। আর পাথরের রঙটাও অদ্ভুত, হলদে বাদামী। রোদ পড়লে মনে হয় পাথরের গা থেকে রঙ পিছলে পড়ছে। অনেকটা মোমের মতন।

             এই স্বতন্ত্র পাহাড়ের চূড়ার দিকটা, মানে ওপরের এক-তৃতীয়াংশ, খুব ঠাহর করে দেখলে বোঝা যায়, মোটা তার দিয়ে ঘেরা। অবশ্য, সরু না মোটা সেটা এত দূর থেকে বোঝা মুশকিল। এখান থেকে জায়গাটার দূরত্ব দু-আড়াই কিলোমিটার হবেই। তবে এটা বেশ বোঝা যায়, পাহাড়টার পুরোটাই গাছপালা দিয়ে ঘেরা। হঠাৎ দেখলে কৃত্রিম অরণ্য বলে মনে হয়। ওপরের ঘেরা অংশটায় জঙ্গলের ঘনত্ব বেশী। পাহাড়টার চূড়াটা সমতল। আর তাতে একটা বিশাল ক্রশ রাখা। ক্রশটার উচ্চতা অনেকটাই হবে, প্রায় পনেরো-কুড়ি ফুটের কাছাকাছি, কারণ এখান থেকেও ওটাকে বেশ বড়সড় দেখতে লাগে। তবে দূর থেকেই এটা পরিষ্কার, যে জায়গাটায় মানুষের আনাগোনা একদমই নেই। কোনও এক অজানা কারণে যেন বিধাতা ওইটুকু অংশকে বাকী পৃথিবী থেকে আলাদা করে রেখেছে। 

                     যাইহোক, এর মধ্যে একটা ব্যাপার ঘটল। মেহবুবনগরে একজন বাঙ্গালীর সাথে পরিচয় হল। বছর পঁয়ত্রিশের ছেলে, নাম মহাবীর। বাড়িতে বসার চেয়ারের অভাব বলে এক ছুটির দিনে স্থানীয় এক কাঠের দোকানে গিয়ে কথাবার্তা বলছিলাম, তারই সূত্রে আলাপ হল। দোকানটা মহাবীরেরই স্বর্গীয় পিতার নামে। পিতার মৃত্যুর পর মেহবুবনগর, করিমগঞ্জ সহ প্রায় তিন-চার জেলায় কাঠের ব্যাবসা শুরু করেছে। জানা গেল, বাঙ্গালী হলেও মহাবীরের পরিবার প্রায় চব্বিশ-পঁচিশ বছর অন্ধ্রপ্রদেশে আছে। দেখলাম, ব্যাবসায়ী হলেও সে বেশ খোশমেজাজী এবং মিশুকে। খুব সহজেই আলাপ জমে উঠল। 
  
          এর কিছুদিনের মধ্যেই দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে মহাবীরের সাথে আমার আর রক্ষিত দুজনেরই বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। ছুটির দিনগুলোয় আমাদের তিনজনেরই কোনও কাজ নেই, তাই একসাথে আমাদের বাড়িতে চা-সহযোগে আড্ডা হত। এরকমই এক শনিবার দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আড্ডা, গল্পস্বল্প চলছে, এমন সময়ে ভূতের প্রসঙ্গ উঠল। কথায় কথায় মহাবীর জানালো, মেহবুবনগরে এমন একটা জায়গা আছে যেখানে দিনের বেলাতেও যেতে মানুষজন ভয় পায়। এবং জায়গাটা নাকি আমাদের বাড়ি থেকে খুব কাছেই।

                আমরা তিনজনেই তখনই দেখতে যেতে তৈরী।

দেখা গেল, জায়গাটা সত্যিই আমাদের বাড়ি থেকে বেশী দূরে নয়। ইয়ারা সত্যামা স্টাচু চৌরাস্তা থেকে যে রাস্তাটা পূর্বে রেলস্টেশনের দিকে চলে গেছে, তারই সমান্তরাল আর একটা রাস্তা এঁকে-বেঁকে, জঙ্গল-গাছপালা ভরা আর একটা নির্জন জায়গার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে রেলস্টেশনের উত্তর-পূর্ব কোণে মিশেছে। এই রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ আর নির্জন। পথের দুধারে বড় বড় গাছপালা চাঁদোয়া তৈরী করে ওপরের আকাশটাকে প্রায় পুরোটাই ঢেকে ফেলেছে। মিনিট দশেক হাঁটার পর একটা পাঁচিল পেরিয়ে লোহার একটা গেটের সামনে পৌঁছে মহাবীর হাত তুলে দেখাল, - “ওই যে!” আমরা চোখ তুলে দেখলাম গেটের ওপরে মরচে ধরা একটা বোর্ডে খোদাই করে লেখা –



রেস্ট হাউস
অফ
সাউথ-সেন্ট্রাল রেলওয়ে


                 লোহার গেটটা ঠেলে ঢুকতে কয়েকটা জিনিষ চোখে পড়ল। একটা বিশাল বাগানবাড়ির মতন এলাকা। রেস্ট হাউসটা একতলা, প্রবেশপথের দরজার কড়াদুটো দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। জানালার কাঁচগুলো ভাঙ্গা, এদিকে সেদিকে পাখির বাসার ভাঙ্গা অংশ, মলমূত্র পড়ে আছে। সদর দরজার সামনে একটা ছড়ানো বারান্দা। সামনে দু’ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমেই একটা শুকনো ফোয়ারা। ফোয়ারাটার নিচের অংশটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। বাগানের মত অংশটার পুরোটাই শুকনো পাতায় ভর্তি। বোঝাই যাচ্ছে এই জায়গাটা বহুকালের অব্যবহৃত। বাগানটা বড় বড় শিশু, ইউক্যালিপটাস আর নিমগাছে ভর্তি। আগাছা আর নাম-না-জানা ফুলের গাছ পুরো জায়গাটাকে জঙ্গুলে রূপ দিয়েছে।  

                     পুরো এলাকাটা জুড়ে হাওয়া-বাতাস একদম নেই। এমনকি একটা শব্দও নেই। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমার থেকে হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষিতের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও যেন আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।

                       জায়গাটা সত্যিই ভয়ের।

আসলে, যদি ভেবে দেখা যায়, যতটা না ভয়ের, জায়গাটা তার থেকে অনেক বেশী একা। এই সব স্থান মানুষকে আরো একা করে দেয়। তার আত্মাকে প্রশ্ন করে। এবং কিছু মানুষ সেই সব প্রশ্নের সন্মুখীন হতে ভয় পায়। পৃথিবীর অন্ধকার দিকটা, তাদের জীবনে না-ঘটা, না-দেখা, না-হওয়া জিনিষগুলোকে অভিজ্ঞতা করার চেয়ে উপেক্ষা করতেই তার সুখী জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য বেশী। গভীর রাতের মগ্ন ঘুমে সে জানতে পারেনা একটা পেঁচা রোজ রাতে কেন শেষ প্রহরে ডেকে যায়। সে জানতে পারেনা, হাওয়া-বাতাসহীন একটা জায়গায় কেন হঠাৎ গা-শিরশির করে ওঠে। কেন তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক একটা নিঃশব্দ এলাকায় এসে তিনটে মূক ছায়ামূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে।

                        রক্ষিতের দিকে ফিরে দেখলাম তার দৃষ্টি রেষ্ট হাউসের টানা বারান্দাটার দিকে নিবদ্ধ। মহাবীর লম্বা গাছগুলোর ওপরের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কি যেন খুঁজছে। দু’জনেই নির্বাক।  

“ভয় পেলে নাকি, মহাবীর?” আমি উচ্চকন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম। শুনে চটকা ভেঙ্গে সে আমার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসল।
                     “এবার অন্য একটা জায়গায় যাব।” গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার পথে মহাবীর বলল।


ঘড়িতে দেখলাম চারটে বেজেছে। এবারও মহাবীর পথপ্রদর্শক। কিন্তু তফাৎ হল, এবার কোনদিকে যাচ্ছি সেটা আমি বা রক্ষিত দুজনেই জানিনা। মহাবীরও একেবারে চুপ করে গিয়েছে।

                      স্টেশনের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা পেছনে ফেলে এবার আমরা হাঁটছি উল্টো দিকে। প্রায় দশ-পনেরো মিনিট চলার পর একটা চৌমাথা এসে পড়ল। বাঁদিকে একটা ছোটো বাজার বসেছে। এদিকটায় আমি বা রক্ষিত আগে আসিনি। চৌমাথা থেকে ডানদিকে ঘুরে আমরা এগিয়ে চললাম। অনেকক্ষণ ধরেই একটা কথা মনে হচ্ছিল। রাস্তাটা যেন সমতল নয়, খুব ছোট্ট একটা কোণ তৈরী করে যেন আমরা চড়াইয়ের পথে হেঁটে চলেছি।  

               আরো মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর একটা খোলা জায়গায় এসে পড়লাম আমরা। সামনেই রেলওয়ে ক্রসিং গেট। তার মানে রেলস্টেশনটা এর সমান্তরাল মাইলখানেক দূরেই। এদিকটায় লোকজন আরও কম। শহরের একেবারে শেষ প্রান্ত বললেই চলে। সময় দেখলাম সাড়ে চারটে। এখন সেপ্টেম্বরের শেষ। এই সময়টায় রোদ থাকলেও সূর্য্য তাড়াতাড়ি ডুবে যায়। এবং ঝপ করে অন্ধকার নেমে আসে।

                    মহাবীর কি চায় বোঝা যাচ্ছেনা। রেলওয়ে ক্রসিং-এর জায়গাটা ফেলে আমরা এগিয়ে এসেছি অনেকটা। এখানটা শহরের একদমই বাইরেএকটা কাঠের গুদাম চোখে পড়ল। অনেক দূরে ছোটো একটা কারখানার চিমনি। আর ডানদিকে পুরোনো একটা...

মহাবীর থেমেছে। সামনে তাকানো অবস্থা থেকে একশ’ আশি ডিগ্রী ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে সে এবার জিজ্ঞেস করল, “কেমন জায়গাটা?”

         দেখলাম চড়াই রাস্তাটা সোজা চলে গেছে পাহাড়গুলোর দিকে। ডানদিকে মুসলমানদের একটা পরিত্যক্ত কবরখানা। উঁচু রাস্তাটা থেকে নীচে দিগন্তবিস্তৃত পোড়ো জমি নেমে গিয়েছে। দূরে পাহাড়গুলোর চূড়ায় বিকেলের শেষ রোদ খেলা করছে। চারদিক জুড়ে অদ্ভুত এক শান্তি বিরাজমান। অপূর্ব!

“ওই পাহাড়টা লক্ষ্য করো। কি মনে হচ্ছে?” মহাবীর আঙুল দিয়ে দেখাল। তাকিয়ে দেখলাম একধারে ঘন জঙ্গলে ঢাকা আর এক ঢালে উজ্জ্বল হলুদ পাথরে রৌদ্রস্নাত যে পাহাড়টার দিকে মহাবীর অঙ্গুলিনির্দেশ করেছে, সেটা আমি অনেকদিন আগেই নিজের বাড়ির বারান্দা থেকে স্বতন্ত্র পাহাড় হিসেবে চিহ্নিত করেছি।

     “স্থানীয় লোকেরা এই পাহাড়টাকে যে নামে ডাকে, তার বাংলায় তর্জমা করলে হয় ‘মোমপাহাড়’।” মহাবীর বলল।

আমি হেসে ফেললাম। তবে এটা বললাম না যে পাহাড়টাকে দেখে সবার আগে আমারও একই কথা মনে হয়েছিল। জিজ্ঞেস করলাম, “এরকম নাম কেন?”

       “পাহাড়ের ডানদিকের ঢালটা লক্ষ্য করলে দেখবে, একেবারে ন্যাড়া, আর অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হলুদ পাথরে ঢাকা। রোদ পড়লে দূর থেকে মনে হয় মোমবাতির মোম গলে পড়ছে। ওই থেকেই নাম।” মহাবীর ব্যাখ্যা করল।

                    সরু চড়াই রাস্তাটা দিয়ে এঁকে বেঁকে এগোতে এগোতে বুঝছিলাম, এই রাস্তা সোজা পাহাড়ের দিকেই গেছে। রাস্তা যত এগিয়েছে, চড়াইয়ের ঢাল তত বেড়েছে। এখান থেকে পাহাড়গুলোর দূরত্ব পাঁচশো’ মিটারেরও কম। তবে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, রাস্তা পাহাড়ে গিয়ে শেষ হয়নি, বরং পাহাড়ের শ্রেণীকে দু’ভাগে ভাগ করে করে এগিয়ে গেছে দূর অবধি। এই সব পাহাড়ি এলাকায় বহু বছর আগে পাহাড়ের ঢাল কেটে রাস্তা তৈরী করে দুটো শহরে মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা হত। শহরগুলো পরে পরে উন্নত হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু যোগস্থাপনের মাধ্যম এখনও আদিম যুগেই পড়ে আছে।

                     এতক্ষণের কথাবার্তায় আর প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে হারিয়ে থাকার জন্যে খেয়াল ছিলনা। হঠাৎ নজরে এল, পাহাড়গুলোর চূড়ায় শেষ বিকেলের যে রোদটুকুর আভাস ছিল, সেটাও মুছে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাঁচটা বেজে কুড়ি মিনিট। শিগগিরই সন্ধ্যে নামবে।

         আমি ভীতু নয়। কিন্তু অচেনা, অজানা একটা জনমানুষহীন এলাকায় মাত্র তিনটে মানুষ এই অন্ধকারে নির্জন পথে ভ্রমণ করবে, এরকম নির্বোধ কল্পনার রোমান্টিক কবিও আমি নই। মহাবীরকে তাগাদা দিয়ে তাই তিনজনে ফেরার রাস্তা ধরলাম। একাকী কাঠগুদাম, পুরোনো কবরখানা, রেলগেট ক্রসিং এবং আরো তিনটে চৌমাথা পেরিয়ে যখন ঘরে পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যে সাতটা। মহাবীর শেষ অবধি আমাদের সাথে এসে বাড়ি পর্য্যন্ত এগিয়ে দিল।
তবে পাহাড়গুলোর প্রতি একটা অজানা কৌতূহল বোধহয় আমাদের তিনজনকেই আকর্ষণ করছিল। বিশেষতঃ ওই স্বতন্ত্র পাহাড়টা। ঠিক হল, পরেরদিন রবিবার খাওয়া-দাওয়া করেই বেরিয়ে পড়া হবে। গন্তব্যস্থল, মোমপাহাড়।

পরদিন খাওয়ার পর্ব তাড়াতাড়ি চুকিয়ে আমি আর রক্ষিত তৈরী। রক্ষিত আবার দেখলাম পাহাড়ে চড়বে বলে স্পেশ্যাল জুতো পরেছে। অন্যদিকে আমার পায়ে শুধুই স্লীপার। আমার মন বলছিল, পাহাড়ের পাথুরে দিকটা শুধুমাত্র চূড়ার দিকের এক-তৃতীয়াংশই হওয়ার সম্ভাবনা। নীচের দিকের বাকী অংশটা ঘাস, ঝোপঝাড়ই বেশী থাকা উচিত। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীচে রাস্তার দিক থেকে মহাবীরের ডাক শুনে আমরা নেমে এলাম। এবং এসেই আমাদের দুজনকে একসাথে থমকে দাঁড়াতে হল।

             মহাবীর আজ একা নয়। এবং তার পাশে মাটি থেকে প্রায় সাড়ে তিন ফুট ওপরে যে জন্তুটা একটা প্রকান্ড হাঁ করে তার জিভটাকে বের করে রেখেছে তাকে দেখে আমাদের দুজনের পা-ই একটু পিছিয়ে এল।

“এই হচ্ছে টাইগার।” মহাবীর ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি এনে বলল।     

     
                        কুকুর যে এত বড়, এত কদাকার আর এত হিংস্র দেখতে হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতায় একবার একটা ভালো জাতের বুলডগ দেখেছিলাম। কিন্তু এজিনিষ চোখে দেখলে হিংস্রতার দিক থেকে তাকেও নিতান্ত শিশু বলতে হবে। এই জন্তুর প্রকান্ড চওড়া কাঁধ মহাবীরের কোমরের কাছে। ঘাড়ের কাছে লম্বা লোমগুলো কেশরের আকার নিয়ে কুকুরকে প্রায় একটা সিংহের রুপ দিয়েছে। দুগ্ধসাদা ক্যানাইনগুলো রোদে ঝিকমিক করছে, আর রক্তাভ লাল জিভটা প্রকান্ড হাঁ-কে ভেদ করে প্রায় আধ হাত বেরিয়ে এসেছে। বাদামী রঙের নাকের ওপরে বসানো হলুদ চোখ দুটো দিয়ে আমাদের দুজনকে জরিপ করছে টাইগার। 

কুকুরের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে মহাবীর আমাদের সাথে হাঁটা লাগাল। চামড়ার বকলেসের সাথে শক্ত করে আটকানো চেন হাতে টেনে নিয়ে সে বলল, “প্রায় ষোলো বছর আগে হায়দরাবাদে বাবা কিনেছিল টাইগারকে। আমারও অনেকদিন শখ ছিল একটা কুকুর পুষব। তাই যখন পেলাম, আর ছাড়তে পারলাম না।”

          “কী জাতের এটা?” রক্ষিত আর থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই বসল।

“কক্যাসিয়ান মাউন্টেন হাউন্ড। প্রধানতঃ শিকারী কুকুর। কিন্তু ভয়ঙ্কর প্রভুভক্ত, আর বিশ্বাসী। এই জাতের কুকুর সাধারণতঃ এত বড় হয়না। উচ্চতায় দু-আড়াই ফুটের বেশী তো নয়ই। আর সাধারণতঃ তেরো-চৌদ্দ বছরের বেশী বাঁচেও না। টাইগারের বয়স এখনই সাড়ে ষোলো। এখানকার জল-হাওয়ার গুণে ও সবদিক থেকেই নিজের পূর্বপুরুষদের হার মানিয়েছে।” মহাবীর গর্বিত কন্ঠে বলল।

                    কুকুরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এবার আমরা দূরে তাকালাম। রাস্তা সেই একই। সেই বাজার, তারপর রেলওয়ে ক্রসিং। এখান থেকে ডাইনে বেঁকে পথ চলে গেছে সোজা। চলার সময়ে ডানদিকে অব্যবহৃত কাঠের গুদাম, আরও দূরে পুরোনো কারখানার চিমনী এবং পরিত্যক্ত কবরখানা।  

        আগের দিন এখান থেকেই ফিরেছিলাম। আজ এগিয়ে চললাম চারজনে। আজ দলের নেতৃত্বে টাইগার।
পিচের চওড়া রাস্তাটা কয়েকশ’ মিটার এগিয়ে একটা বাঁক নিয়ে দুভাগে ভাগ হয়েছে। একটা মূল ভাগ, পিচের রাস্তা হিসাবেই এগিয়ে গেছে সামনে। পরে জেনেছিলাম এটা আরও তিনটে গ্রামকে অতিক্রম করে মুম্বই-হায়দরাবাদ হাইওয়েতে গিয়ে মিশেছে। আর একটা অপেক্ষাকৃত সরু, পথ চলার মত রাস্তা চড়াইয়ের পথে ধাপে ধাপে উঠে গেছে মোমপাহাড়ের দিকে। আমরা এই রাস্তাই ধরলাম।    

                  ঝোপঝাড়, বন্য ফুল, ছোটো ছোটো গাছের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো যেন জুরাসিক যুগে এসে পড়েছি। পাহাড়ের পাদদেশে কয়েকটা ইউক্যালিপটাস আর নিমগাছ দেখলাম। কয়েকটা বুনো সীতাফলের গাছ, মানে আমাদের দেশে যেগুলোকে আতা বলে, সেই গাছও দেখলাম, কিন্তু চেনা আর কোনও গাছ নজরে পড়ল না। আর একটা আশ্চর্য্যের জিনিষ নজরে এল। গোটা পাহাড়টা জুড়ে বিরাজ করছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। একটা পাখির ডাক অবধি নেই। সত্যিই অদ্ভুত!

            পাহাড়ের উচ্চতার মাঝামাঝি পৌঁছে মহাবীর একটা কথা বলল।

“তোমাদের একটা কথা বলিনি। তার কারন সেটা বললে হয়তো তোমরা আমার সাথে এখানে আসতে রাজী হতেনা।”

আমাদের দুজনের মনেই অজানা কৌতূহল। জিজ্ঞাসা।

“এই পাহাড়টার আরো একটা নাম আছে। নামটা স্থানীয় বানজারা প্রজাতির লোকেদের দেওয়া। বাংলায় সেই নামের তর্জমা করলে হয় ‘শয়তানের পাহাড়’।”

         “এরকম নামের কারন?” আমরা একসাথেই জিজ্ঞেস করলাম।

“এই পাহাড়ের ধারেকাছে সাধারণতঃ মানুষজন থাকেনা।” মহাবীর বলতে শুরু করল। “শুধু উত্তরের দিকের ঢালে তিন-চার গোষ্ঠী বানজারা প্রজাতি প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে থেকে প্রতি গ্রীষ্মকালে এসে আস্তানা বাঁধে। আবার শীতের শুরুতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে অন্যদিকের নদী পেরিয়ে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে চলে যায়।”

“এই হেন বানজারাদের মধ্যে থেকে প্রতি বছর দু-একজন করে এই পাহাড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়হয় মানুষ, না হয় পোষা কুকুর, ছাগল, ভেড়া। যদিও পাহাড়ের ওপরের কিছুটা অংশ শক্ত লোহার তার দিয়ে ঘেরা, তবুও, মানুষজন নাকি এই পাহাড়ে এসে মাঝেমধ্যে স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়। ম্যাজিকের মতো।”

         কেমন একটা ঘোরের মত লাগছিল। মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন আসছে। মানুষ হাওয়া হয়ে যায়? ম্যাজিক? শয়তানের পাহাড় কি জিনিষ? মহাবীর আমাদের এরকম একটা জায়গায় জেনেশুনে নিয়ে এসেছেই বা কেন?

               একটা প্রশ্ন মুখ দিয়ে বেরিয়েই পড়ল।

“একটা পাহাড়কে কেউ কেন লোহার তার দিয়ে ঘিরে রাখবে?”

মহাবীর হাসল। তারপর বলল, “এর কোনও সঠিক উত্তর নেই। আমিও যা জানি, সবই লোকমুখে শোনা। শুনেছি উনিশশো আশির দশকে এক সাহেব এসেছিলেন মেহবুবনগরে। পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। এখানকার অনেক গাছপালা ওনার হাতেই লাগানো। উনিই নাকি এখানে আসার বছর কয়েকের মধ্যে বনদপ্তরের সাহায্য নিয়ে পাহাড়ের ওই অংশটাকে ঘিরে দিয়েছিলেন।”

“দুর্লভ কোনও গাছপালা সংরক্ষণের ব্যাপার কি?” রক্ষিত প্রশ্ন করল।

“বলা যায় না। হতেও পারে। এই পাহাড়ের চূড়ায় মানুষের পা শেষবার পড়েছিল হয়তো প্রায় ত্রিশ বছর আগে। চূড়ায় একটা চার্চের ভগ্নাবশেষ আছে বলে শুনেছি। সেটা নদীর ওপার থেকে দেখা যায়। শহরের এদিক থেকে একমাত্র ওই বিশাল এক ক্রশই দৃশ্যমান।” মহাবীর আঙুল দিয়ে চূড়ার দিকের ক্রশটা দেখাল।

“বোটানিক-টোটানিক হবে হয়তো।” আমি মনে মনে ভাবলাম।

               পাহাড়ের গা বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে কতটা চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। খেয়াল হল, যখন দেখলাম দূরে ঝোপঝাড় আর গাছপালার ফাঁকে মোটা তারের জালি দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখলাম লোহার মোটা তারজালি, মাটি থেকে প্রায় আট-নয় ফুট ওপরে উঠে গেছে। জালের এখানে-ওখানে জং ধরা, বেশীর ভাগই লতানো গুল্ম আর ঝোপঝাড় ওই তারগুলোকেই অবলম্বন করে উঠে গেছে ওপরে।  

এখানে দাঁড়িয়ে সামনে যতদূর চোখ যায় দেখার চেষ্টা করে বুঝলাম, পাহাড়ের ঢাল এখান থেকে অনেকটাই খাড়া। জঙ্গলের ঘনত্বও অনেকটাই বেশী। মহাবীর যে সাহেবের কথা বলছে সে কি বিশেষ ধরনের কোনও গাছের সংরক্ষণ করতেই জায়গাটাকে ঘিরে দিয়েছিলেন? পাহাড়ি জঙ্গলের ঘন ছায়ায় দাঁড়িয়ে কল্পনায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের মোমপাহাড়ে ফিরে গেলাম। আমার চারিধারে নৃত্য করছে অগুণতি অদৃশ্য ছায়ামূর্তি। লালমুখো এক সাহেব তাদের সঙ্গী। লোহার ভারি ভারি জালে ‘শয়তানের পাহাড়’কে বেঁধে ফেলতে তারা প্রস্তুত...

               হঠাৎ রক্ষিতের ডাকে হুঁশ ফিরে এল।

“আকাশের অবস্থা ভালো নয়।”

ঘাড় তুলে ওপরের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আকাশ হঠাৎই ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সাড়ে চারটে। কিন্তু আলোর বেশী অবশিষ্ট নেই।

এবার ফেরার পালা। এবং চারজনেই তাড়াহুড়ো করে নামছি। বাতাসের গতি অনেকটাই গেছে বেড়ে। তাপমাত্রাও অনেকটাই কম লাগছে। এবং এর কারন হতে পারে একটাই। কাছাকাছি কোথাও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, এবং বাতাসের সঙ্গী হয়ে সেই বৃষ্টি এগিয়ে আসছে এই দিকেই।

                 পাহাড়ের পাদদেশ অতিক্রম করে রাস্তায় নেমে এসে আমরা দৌড় লাগালাম। এটা না করলে আগত বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচা দুষ্কর। মহাবীর বলল ও আর টাইগার নাকি বহুদিন ধরেই এই পাহাড়গুলোর চারপাশে চলে আসে সময় পেলে। টাইগারের ছোটো বয়েস থেকেই। মহাবীর আরও একটা কথা বলল যেটা আমরা প্রথমবার শুনলাম। চতুষ্পদ মাংসাশী প্রাণীদের মধ্যে খনিজ লবণ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যগুণসম্পন্ন ধাতুর অভাব হলে সেটা তারা প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেয়। এই পাহাড়গুলোর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হলুদাভ পাথর নাকি সেই সব গুরুত্বপূর্ণ পদার্থের উৎস। টাইগারকে সে নাকি প্রায়ই এখানে এলে ওইসব পাথর চাটতে দেখেছে।

কথা বলতে বলতেই চারদিক ভয়ঙ্কর কালো হয়ে এসে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির মধ্যে ছোটা সম্ভব নয়, পা পিছলে চোট পাওয়ার সম্ভাবনা। তাই অগত্যা হাঁটা লাগাতে হল। রেলওয়ে ক্রসিং থেকে আরো তিনটে চৌমাথা পেরিয়ে আধঘন্টা পর যখন বাড়িতে ঢুকলাম, তখন কাকভেজা অবস্থা। পরের রবিবার একই প্ল্যান থাকবে, একথা জানিয়ে মহাবীর নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিল।

                     কিন্তু মুশকিল হল অন্য জায়গায়। বৃষ্টিতে ভিজে রক্ষিত শরীর খারাপে পড়ল। প্রচন্ড জ্বর, আর তার সাথে ঠান্ডা লাগা। এদিকে সেদিনের বৃষ্টির পর আবহাওয়া একই রয়ে গেল। সমানে বৃষ্টি। খবরে জানা গেল বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণাবর্তের ফলে ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশে পরবর্তী সাত-আট দিন নিম্নচাপ চলবে। এবং তার সাথে ঝোড়ো হাওয়া। এমনিতেই মেহবুবনগর পাহাড়ী জায়গা। রোদের সময় পাথর তাড়াতাড়ি গরম হয় বলে অল্প গরমেই গোটা শহর প্রচন্ড উত্তপ্ত হয়ে ওঠেতেমনি একটু বৃষ্টি হলেই আবহাওয়া এত ঠান্ডা হয়ে পড়ে যে রাতে গায়ে লেপ-কম্বল চাপা দিয়ে শুতে হয়। মাঝে মাঝে রাতের দিকে আট-নয় ডিগ্রী অবধিও নেমে যায় তাপমাত্রা।

পরের ছ’-সাত দিন একরকম ঘরবন্দী হয়ে কাটালাম। রক্ষিতের শরীর খারাপ, অফিসে ছুটি নিয়ে বাড়িতে বিশ্রাম নিল। আমিও সকালে ছাতা নিয়ে অফিস যাই, বিকেলের মধ্যে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আসি। সন্ধ্যেবেলাটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধূমায়মান কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আর গল্পগুজব করে কাটিয়ে দিই। তারপর টুকটাক রান্না করে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি।

              সোমবার সন্ধ্যেবেলা একটা একদম অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। দুপুর থেকে বৃষ্টির জোরটা কম থাকায় অফিস থেকে ফিরে রক্ষিত বাজারের দিকটায় গিয়েছিল। এবং সে ফিরে এল অত্যন্ত আকস্মিক আর অদ্ভুত একটা খবর নিয়ে।
মহাবীরকে রবিবার সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এবং তার সাথে টাইগারও উধাও।

                     ব্যাপারটা একদমই অভাবনীয়।

রক্ষিত বাজারের দিকে গিয়েছিল। মহাবীরের কাঠের দোকানটা ওই রাস্তায় ডানদিক পড়ে। ওখানেই দোকানের কর্মচারীদের কাছ থেকে ও ঘটনাটা শুনে এসেছে।

কথাটা শোনার পরই আমার প্রথম মনে পড়ল যেটা, সেটা হল রবিবার আমাদের তিনজনের আবার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল ওই পাহাড়ে। কিন্তু বৃষ্টি আর রক্ষিতের শরীরের অবস্থা খারাপ থাকায় আমাদের তো বাড়ি থেকে বেরোনোই সম্ভব হয়নি। মহাবীর একা একাই টাইগারকে নিয়ে ওই পাহাড়ের দিকে যায়নি তো?

আমার আর মাথা কাজ করছে না। রক্ষিতেরও দেখলাম একই অবস্থা। মনে পড়ে গেল মহাবীরের কয়েকটা কথা, “মানুষজন নাকি এই পাহাড়ে এসে মাঝেমধ্যে স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়। ম্যাজিকের মতো।”

         মহাবীরের পরিবার আগেই পুলিশে ডায়রি করেছে শুনলাম। পরেরদিন রক্ষিত আর আমি অফিস থেকে কয়েকদিনের জন্যে ছুটি নিয়ে বনদপ্তরে গিয়ে বিস্তারিত জানালাম। সেইদিনই দুপুরের মধ্যে বনদপ্তরের তিনজন কর্মী, লোকাল থানার দুজন কনস্টেবল, রক্ষিত, আমি আর মহাবীরের দোকানের দুজন ছোকরা কর্মচারী – মোট ন’জন ওই মোমপাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে অবধি পাহাড়ে কিছু পাওয়া গেলনা। তারপর বনদপ্তরের কর্মীদের আনা হ্যাজাক জালিয়ে পাহাড়ের ঘেরা অংশটার কাছাকাছি খোঁজা শুরু হল। প্রায় আধঘন্টা কেটে যাওয়ার পর দেখা গেল লোহার জাল দিয়ে ঘেরা একটা অংশের ওপর একটা গাছ উপড়ে ভেঙে পড়েছে। নিরীক্ষণ করে দেখা গেল গাছটার গোড়ার দিকের অনেকটাই পোকায় কাটা, ভারী বর্ষণে ভেঙে পড়েছে গাছটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। ঘেরা অংশের বেশ খানিকটা ভেঙে যাওয়ায় যাতায়াতের একটা প্রশস্ত পথ তৈরী হয়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়ার একটা পথ।
                  এখানে একটা সমস্যা তৈরী হল। পাহাড়ের এই অংশে সুদীর্ঘ বহু বছর কারোর পা পড়েনি। বনদপত্রের লোকজন স্বাভাবিকভাবেই সকলের সুরক্ষার জন্য এই অংশে প্রবেশ করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু আমাদের পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এবং আমার মন বলছে মহাবীর এই পথেই গেছে।

এবং হলও তাই। ভেঙে পড়া গাছটা থেকে পাহাড়ের চড়াই বরাবর ঠিক বারো মিনিট হাঁটার পরেই হাতে হ্যাজাক ধরা একজন বনকর্মী আমার ঠিক উত্তর-পূর্বে কুড়ি-পঁচিশ গজ দূর থেকে চীৎকার করে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা যে যেখানে ছিলাম সেখান থেকে বন্য ঝোপঝাড় ঠেলে, কাদা আর পাথরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয়ে যা দেখলাম, তা এক ভয়াবহ দৃশ্য!


পাহাড়টার দুটো সমান্তরাল ঢালের মধ্যে বৃষ্টির জল জমে ছোট্ট একটা নালার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই নালার মধ্যেই পড়ে আছে মহাবীরের ছিন্নভিন্ন দেহ। অথবা বলা যায় দেহাংশ। দেহটা উল্টো করে শোয়া। হাত দুটো দুপাশে ছড়ানো। যেন মৃত্যুর আগে কোনও কিছুকে বাধা দিতে বা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল সেপরণের জামাটার ছিন্নভিন্ন অবস্থা। কোমরের নিচ থেকে পা অবধি কিছু আর বাকি নেই, শুধু হাড় এবং রক্তাক্ত শিরা-উপশিরা ছড়ানো। কোনও এক অপার্থিব জান্তব শক্তি যেন অপার হিংসায় দেহটাকে ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলেছে।    

         আমরা এর বেশী আর কিছু দেখতে পারলাম না। বনকর্মীরা কনস্টেবল দু’জনের সাহায্য নিয়ে দেহটাকে একটা প্লাস্টিকে মুড়ে থানায় নিয়ে গেল, পরের দিন পোস্টমর্টেমের পর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে। কিন্তু টাইগারের কোনও খোঁজ মিলল না। শয়তানের পাহাড় যেন কোনও এক আজব ভোজবাজিতে তাকে পৃথিবীর বুক থেকে স্রেফ উধাও করে ফেলেছে।


এই ঘটনার পর আমি বা রক্ষিত কেউই প্রায় সাত-আট দিন কাজে মনোযোগ দিতে পারলাম না। চোখ বন্ধ করলেই শয়াতানের পাহাড়ে বৃষ্টির জলে তৈরী নালার মধ্যে পড়ে থাকা একটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহের ছবি ভেসে উঠছে। আর তার সাথে সাথেই শিউরে উঠছে গোটা শরীর। রোজ আমরা অফিস থেকে বিকেলের মধ্যেই ফিরে পড়ি। কফির কাপ হাতে নিয়ে তারপর শুধুই চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা। অক্টোবরের মাঝামাঝি। একটা হাল্কা কুয়াশার পর্দা গোটা মেহবুবনগরটাকে ঘিরে থাকে। বারান্দা থেকে সন্ধ্যের গাঢ় অন্ধকারে মোমপাহাড়ের চূড়ায় সাদা ক্রশটা হালকা দৃশ্যমান। রাত্রি বাড়তে থাকলে আস্তে আস্তে ওটাও ঘন কুয়াশার সাদা পর্দায় ডুবে যায়। তখন গোটা দিগন্ত জুড়ে শুধুই ধোঁয়াশা।


প্রায় এগারো-বারো দিন কেটে গেল। রোজ রাত্রি বারোটা-একটা অবধি আমি আর রক্ষিত বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীরবে ওই পাহাড়গুলোকে নিরীক্ষণ করি। মাঝে মাঝে দু-একটা কথার আদানপ্রদান। মহাবীরের বলা বেশ কিছু কথার অর্থ বুঝিনি। আমিও না, রক্ষিতও না। এর মধ্যে একবার মেহবুবনগরের জেলা লাইব্রেরীতে গিয়ে কয়েকটা বিষয়ে পড়াশুনা করে এসেছি। দুটো ব্যাপারে খটকা লাগছে। এক, টাইগার। মহাবীরের কথা সত্যি হলে টাইগারের বয়স প্রায় সাড়ে ষোলো কি সতেরো। কয়েকটা বিদেশী বই উল্টেপাল্টে যা ধারণা হল, তা অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর। কক্যাসিয়ান মাউন্টেন হাউন্ডের গড় বয়স হয় সাধারণতঃ তেরো বা চৌদ্দ। এবং উচ্চতায় কখনওই দুই বা আড়াই ফুটের বেশী হয়না। কিন্তু মহাবীরের এই কুকুর সেই ‘গড়’কে শুধু হার-ই মানায়নি, বরং অদ্ভুত একটা ব্যতিক্রম স্থাপন করেছে। মহাবীরের কথায়, “এখানকার জল-হাওয়ার গুণে ও সবদিন থেকেই নিজের পূর্বপুরুষদের হার মানিয়েছে।” এখন প্রশ্ন হল, ‘জল-হাওয়ার গুণ’টা আসলে ঠিক কি? আর তাছাড়া মহাবীরের সর্বক্ষণের সঙ্গী টাইগার গেলই বা কোথায়?

                         দ্বিতীয় খটকা হল ওই সাহেব। তার পরিচয় কি ছিল? কেন তিনি মোমপাহাড়ের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতেন? কীজন্যেই বা তিনি এখানে আসার বছর খানেকের মধ্যে ওই পাহাড়ের একটা অংশকে ঘিরে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন? রক্ষিতের বিশ্বাস কোনও মূল্যবান গাছপালা লাগিয়ে তার সংরক্ষণের জন্যই এই ব্যবস্থা। আমার মন মানতে চাইছে না। কি এমন জিনিষ ছিল পাহাড়ের ওই অংশে, যা তিনি শহরের লোকের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন? এরকম নয় তো যে, পাহাড়ের ওপরে উনি এমন কিছুর সংস্পর্শে এসেছিলেন যার থেকেই উনি গোটা মেহবুবনগরের লোকেদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন? লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত পুরোনো স্থানীয় খবরের কাগজে এই সম্পর্কে কোনও উল্লেখ পেলাম না। শুধু একটা তথ্য পাওয়া গেল। রোমানিয়া থেকে আসা এক সাহেব নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে নাকি এখানে আত্মহত্যা করেছিলেন। জীবনের শেষ পনেরো-কুড়ি বছর তিনি কাটিয়েছিলেন মেহবুবনগরে। এই সাহেবই কি তাহলে সেই সাহেব? উত্তর পাওয়া গেল না।

রাত্রে শুতে যাওয়ার সময় একটা কথা মাথায় এল। ওই বানজারা প্রজাতি। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ওপর যারা মোমপাহাড়ের উত্তরের ঢালে বছরের অধিকাংশ সময়ে তাঁবু ফেলে বসবাস করে। এই পাহাড় এবং ওই সাহেব সম্পর্কে কেউ জানলে একমাত্র ওরাই জানবে।

কিন্তু একমাত্র বাধা হল ভাষা। আমি তেলুগু ভাষা ভালো জানিনা। বিশেষতঃ স্থানীয় বানজারা যে তেলুগু ব্যবহার করে তা মূলভাষা থেকে অনেকটাই আলাদা। ঠিক করলাম মহাবীরের দোকানের যে ছেলেদুটি আমাদের সাথে সেদিন সঙ্গী হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজনকে সঙ্গে নিয়ে বানজারাদের সাথে দেখা করব। দোভাষীর কাজ হবে।

                  ছেলেটির নাম রামরাও প্রসাদ। পরের দিন আমি আর প্রসাদ পাহাড়ের রাস্তায় শেষ অবধি গিয়ে এবার পাহাড়ের দিকের চড়াইয়ের রাস্তা না নিয়ে বামদিকে, পাহাড়কে ডাইনে ফেলে গোল করে ঘুরে ওপাশের ঢালে যাওয়ার রাস্তা নিলাম। আধঘন্টাটাক চলার পর কালচে নীল রঙের তাঁবুগুলো চোখে পড়ল। এপাশে ওপাশে পাথরের ওপর রোদে জামাকাপড় শুকোচ্ছে। ফাঁকা একচিলতে জমির ওপর কয়েকটা পরিবারের থাকার অস্থায়ী ব্যবস্থা।

আমি সরাসরি কাজের কথায় চলে গেলাম। প্রসাদ ছেলেটার সাহায্য নিয়ে ওদের এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করছি, এমন সময়ে ওদের মধ্যে থেকেই একজন অত্যন্ত বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। এনার গলায় রুপোর বেড় তিন-চারখানা, উর্দ্ধবাহুতেও রুপোর গহনা। মনে হল ইনি এদের গোষ্ঠীপ্রধান, এবং কিছু সাহায্য করতে পারেন। দোভাষী ছেলেটির সাহায্যে প্রশ্ন করলাম, এখানে প্রায় ত্রিশ বছর আগে যে সাহেব এসেছিলেন তাকে উনি চিনতেন কিনা।

                বৃদ্ধ মাথা নেড়ে, বিড়বিড় করে কিছু বললেন। প্রসাদ আমার দিকে ফিরে হিন্দীতে ফিসফিসিয়ে বলল, “চিনতেন না। জঙ্গলে ওনাকে দেখেছিলেন কয়েকবার, দূর থেকে।”

এবার আসল প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলাম।

“সাহেব কি এখানে পাহাড়ে কোনও বিশেষ গাছপালা লাগাতে আসতেন?”

বৃদ্ধ যেন সহসা চমকে উঠলেন। তারপর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নানারকম ভঙ্গী করে কয়েকটা কথা অস্ফুট উচ্চারণ করলেন। আকাশের দিকে চোখ করে ডানহাতটা গোল করে ঘোরালেন কয়েকবার। তারপর ক্লান্ত হয়ে উবু হয়ে বসে পড়লেন। আশেপাশের বাকীরা তাকে ধরাধরি করে একটা তাঁবুর মধ্যে নিয়ে চলে গেল।

          বুঝলাম, আর কিছু জানার যে আশা ছিল, তাও শেষ হয়ে গেল।


ফেরার পথে প্রসাদ ছেলেটা একটাও কথা বলল না। শহরে ঢোকার পর যেন হঠাৎ চমক ভেঙে আমার দিকে তাকাল। দু’-এক মুহুর্ত চুপ করে বলল, বৃদ্ধ বানজারার শেষ কয়েকটা কথার মানে করলে যা দাঁড়ায় তা হল, সাহেব এই পাহাড়ে একা আসেননি। তার সাথে ছিল একটি জীবন্ত বাদামী বল।

           কথাগুলো ভালোভাবে বোঝার আগেই আমার অবাক চোখের সামনে দিয়ে সে ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে ঢালু রাস্তা বেয়ে বাসস্ট্যান্ডের পেছনে তার বাড়ির দিকে চলে গেল।

এর পরের দিন আরও একটা মৃত্যুর খবর এল। এবারের মৃত্যুটা মোমপাহাড়ের ওপরে নয়, বরং পাহাড়ের পাদদেশে যেখানে রাস্তাটা দু’ভাগে ভাগ হয়েছে, ঠিক সেখানে। এক দুর্ভাগা সাইকেল-আরোহী পাশের গ্রাম থেকে ওই পাহাড়ি রাস্তা ধরে ফিরছিল। মৃত্যুর ধরণটা ঠিক আগের মতই। গোটা শরীর যেন ধাতব কোনও তীক্ষ্ণ ছুরির সাহায্যে তীব্র আক্রোশে ফালা ফালা করে ফেলা হয়েছে।

        কয়েকদিন ধরেই আমার মনে একটা ব্যাপার খচখচ করছিল। কয়েকটা টুকরো টুকরো সত্য, এমনভাবে গোটা ঘটনাটা জুড়ে রয়েছিল, কয়েকটা সত্য – কিন্তু এতো এলোমেলো, সামনে রয়েছে, তবু যেন দেখতে পাচ্ছিনা, এরকম


মহাবীরের মৃত্যুর পর পুরো দু’সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল। ঠিক করলাম, আরেকবার যাব জেলা লাইব্রেরীতে। কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি সারাদিন পুরোনো কাগজপত্র, মেহবুবনগরের ওপর লেখা বই পড়েও নতুন কিছুই পেলাম না। শুধু একটা জিনিষ জানা গেল। রোমানিয়ার যে সাহেবের আত্মহত্যার উল্লেখ পেয়েছিলাম, তিনিই এই সাহেব। ব্যস, ওইটুকুই। এর বেশী আর কিছুই জানা সম্ভব হল না। হতাশ মনে সন্ধ্যের অন্ধকার ঠেলে বাসায় ফিরে এলাম।

                   কিন্তু মনের মধ্যে সেই অস্বস্তিকর ভাবটা রয়েই গেল। মহাবীরের ‘স্রেফ হাওয়া হয়ে যাওয়া’র অর্থ কি? সাহেব একটা পাহাড়কে কেন ঘিরে দিয়েছিলেন? ‘জল-হাওয়ার গুণ’ আসলে ঠিক কি? টাইগার কোথায় গেল? মৃত্যুগুলো কিভাবে ঘটছে – কে এই শয়তান? ‘একটি জীবন্ত বাদামী বল’ কথার মানে কী হয়?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে জেগে উঠলাম। পাশে রাখা রেডিয়াম দেওয়া হাতঘড়িতে সময় দেখলাম রাত আড়াইটে। পাশের বিছানায় রক্ষিত ঘুমোচ্ছে।

পায়ে স্লীপারটা গলিয়ে ধীরে ধীরে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। কখন মাঝরাতে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকে গোটা শহরটা এক এক পলকে দিনের আলোর মতনই দৃশ্যমান। মোমপাহাড়ের ওপরের সাদা ক্রশটা ভারী বর্ষণের মধ্যেও বিদ্যুতের আলোয় মাঝে মাঝে হালকা দেখা যাচ্ছে।           
            
          কথায় বলে, মানুষ জেগে থাকা অবস্থায় যা যা বলে, যা যা শোনে তা তার মনের চেতনা আর অবচেতনা- এই দুই অংশে জমা থাকে। এবং যখন চেতনা আমাদের সঠিক পথে চালনা করতে ব্যর্থ হয়, তখন অবচেতন মন আমাদের সেই রাস্তা চিনিয়ে দিতে সাহায্য করে।

ঠিক দশ মিনিট আগে আমি যে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি, তাতে আমি ফিরে গিয়েছিলাম রোমানিয়ায়, সাহেবের নিজের দেশে। দেখলাম সেখানে আমি ছুটে চলেছি জঙ্গলে জঙ্গলে, আর আমার পেছনে তাড়া করে আসছে দুটো হলুদ চোখ। সেই চোখ কোনও মানুষের নয়। সেই চোখ টাইগারেরও নয়। সে চোখ মোমপাহাড়ের ওই শয়তানের।


              বাকিটা রাত একইভাবে বারান্দায় পায়চারি করে আর বৃষ্টি দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিলাম। মনের ভেতরের ধোঁয়াশাটা একটু পরিষ্কার হয়েছিল। মাথায় একটা প্ল্যান এসেছিল, সকালবেলা রক্ষিত ঘুম থেকে উঠতে তাকে প্ল্যানটা জানালাম। রক্ষিত দেখলাম সায় দিল। প্ল্যানমাফিক বনদপ্তরের অফিসে আর পুলিশ স্টেশনে গিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করলাম। বনদপ্তর আমাদের সাথে তিনজন রাইফেলধারী কর্মী পাঠালো। পুলিশের পক্ষ থেকেও আমাদের সাহায্যের জন্যে দু’জন কনস্টেবলকে দেওয়া হল। এরাও সশস্ত্র। ঠিক হল আমরা সাতজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ওই পাহাড়টায় উঠব। আমার সন্দেহ আমি আগেই সবাইকে জানিয়ে রেখেছি, তাই প্রত্যেকেই সতর্ক। পরদিন দুপুর দুটো নাগাদ আমরা পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ যখন আমরা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছলাম, তখনও জীবন্ত কোনও প্রাণী আমাদের নজরে আসেনি। চূড়াটার সমতল জায়গা জুড়ে শুধু একটা অতি-প্রাচীন চার্চের ভগ্নাবশেষ। আর সেটার সামনে একটা খোলা জমি পেরিয়ে শহরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে কুড়ি-বাইশ ফুট উঁচু ওই একটা ক্রশ।   

কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার মত অবস্থা আমাদের নেই। ঠিক হল পাহাড়ের ওদিকের ঢাল বেয়ে নেমে নদীর ধার অবধি গিয়ে আমরা খুঁজে আসব। আমাদের স্থির ধারণা, মোমপাহাড়ের শয়তানকে আজ আমরা খুঁজে পাবই।

                  এদিকের ঢালটা দেখা গেল অপেক্ষাকৃত আরো ছোটো। চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা পাহাড়টা থেকে নেমে এসে পাথুরে একটা সমতল জমিতে এসে পড়লাম। এখান থেকে সামনে মিনিট দশেক হাঁটলেই নদী।
কিন্তু নদী অবধি যেতে হলনা। পাথুরে জমিটায় এসেই সামনে প্রায় একশ’ গজ দূরে নদীর ধারেই নুড়ি-পাথরের ওপর একটা বাদামী রঙের বিশাল আকারের জন্তুর দেহকে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল। আর তার ঠিক দশ-বারো হাত দূরেই দেখলাম পড়ে আছে আরেকটা নিথর দেহ। টাইগার।

তিন বনকর্মী রাইফেল উঁচিয়ে সাবধানে প্রথমে এগিয়ে গেল। কিন্তু তার দরকার ছিলনা। নদীর ধারে মহাবীরের সর্বক্ষণের বিশ্বস্ত সঙ্গী কক্যাসিয়ান মাউন্টেন হাউন্ডের শেষ শিকারে পরিণত হয়েছিল মোমপাহাড়ের সাক্ষাৎ ‘শয়তান’, রোমানিয়ার সাহেবের মোমপাহাড়ে নিয়ে আসা সেই ‘জীবন্ত বাদামী বল’ – সাড়ে নয় ফুট লম্বা প্রকান্ড একটি ইউরেশিয়ান বাদামী ভালুক, চলতি কথায় যাকে বলা হয় গ্রিজলী।  

         বনকর্মীরা তাদের কাজ করল। শহরের লোকজনের মন থেকে মোমপাহাড়ের শয়তানের ভয় দূর করার দরকার ছিল। ভালুক এবং টাইগার- দুইয়েরই দেহকে শহরে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল। আমরাও ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে এলাম। মোমপাহাড়ের আতঙ্কের অবসান ঘটিয়ে রহস্যের উন্মোচন হল।



আশির দশকের শেষের দিকে রোমানিয়া থেকে এক সাহেব এসে আস্তানা গেড়েছিলেন এই মেহবুবনগরে। সঙ্গে এনেছিলেন রোমানিয়ার কুখ্যাত ইউরেশিয়ান প্রজাতির বাদামী ভালুকের সদ্যোজাত একটি বাচ্চা। কেন বা কিভাবে তিনি অতদূর থেকে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বাচ্চাটিকে নিয়ে এসেছিলেন, বলা দুষ্কর। এবং এখানে নিয়ে এসে তিনি বাচ্চাটিকে ছেড়ে দিলেন ওই স্বতন্ত্র পাহাড়ের বুকে। কিন্তু হয়তো বছর কয়েকের মধ্যেই বুঝেছিলেন এই মূর্তিমান ঘাতক কোনওরকমে পাহাড় থেকে নীচে নেমে শহরে এসে পৌঁছলে সমূহ বিপদ। তাই বনদপ্তরের তৎকালীন কিছু কর্মচারীর সহায়তায় গোপনে পাহাড়ের তিনদিকের ঢাল শক্ত তারজালি দিয়ে বেঁধে দেন। খোলা রাখেন শুধু নদীর দিকের ঢালটি।

             এরপর ধীরে ধীরে সময় এগিয়ে যায়। যে গ্রিজলী ভালুকের গড় বয়স চব্বিশ বা পঁচিশ হওয়ার কথা সেই ভালুক আজ মোমপাহাড়ে বসবাস করেছে ত্রিশ বছরেরও ওপর। এমনটা কিভাবে সম্ভব?

এখানে আমার একটা নিজস্ব ধারণা আছে। মহাবীর বলেছিল, এখানকার জল-হাওয়ার গুণে টাইগার আকারে এবং বয়সে তার পূর্বপুরুষদের টেক্কা দিয়েছে। কিন্তু আমার মন বলে অন্য কথা। সে বলেছিল টাইগারকে সে অনেক সময়েই খনিজ লবণের চাহিদা মেটানোর জন্য ওই হলুদ পাথর চাটতে দেখেছে, যা এই পাহাড়ের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমার মনে হয়, হলুদ, মোমের মতন দেখতে এই পাথরে এমন কিছু আছে, যা জন্তুর আকৃতি এবং বয়সে প্রভাব ফেলে। যার ফল আমরা টাইগার এবং ভালুকের ওপর দেখেছি।

             মহাবীরের পক্ষে এতকিছু জানা সম্ভব ছিলনা। সেই রবিবার সে একাই টাইগারকে নিয়ে রওনা দিয়েছিল মোমপাহাড়ের উদ্দেশ্যে। এদিকে ভারী বর্ষণে আগে থেকেই ঘেরা অংশের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে লোহার শক্ত তার ভেঙে যায়। এরপর, হয় মহাবীর টাইগারকে নিয়ে ওপরের অংশে প্রবেশ করার পথে আক্রান্ত হয়েছিল, অথবা জন্তু নিজেই ঘেরা অংশ থেকে বেরিয়ে এসে মহাবীরকে আক্রমণ করে এবং তাকে টেনে হিঁচড়ে ওপরে নালা অবধি নিয়ে যায়। বেচারা টাইগার! খুব সম্ভবতঃ তার চোখের সামনেই তার মনিবকে শেষ করে ওই গ্রিজলী। কিন্তু কক্যাসিয়ান হাউন্ড জানত, সম্মুখ সমরে ভাল্লুকের হাতে তার মৃত্যু নিশ্চিত, তাই পাহাড়ের উপরেই লুকিয়ে থাকে সে। প্রায় সতেরো দিন, দিন-রাত ভালুকের পিছু করার পর নদীতে জল খাওয়ার সময়ে একদিন পেছন থেকে গ্রিজলীর ঘাড়ে লাফ দিয়ে কশেরুকা ভেঙে দেয় টাইগার। জবাবে ভালুকও আঘাত করে। সেই মারণ আঘাতে ছিটকে পড়ে টাইগার। শিকার ও শিকারি দুজনেরই মৃত্যু আসে, তৎক্ষণাৎ। মোমপাহাড়ের শয়তানের জীবনের ওপর শেষ যবনিকা নেমে আসে।


এরপর প্রায় একমাস লেগেছিল আমাদের জীবন স্বাভাবিক হতে। তবে মেহবুবনগরে আর মন টিকছিল না। তাই অফিসে ট্রান্সফারের আর্জি জানিয়ে দিয়েছিলাম। নভেম্বরের মাঝামাঝি আমি আর রক্ষিত দুজনেই কলকাতায় ফিরে এসে এখানকারই অফিসে যোগ দিলাম। আট-নয় মাসের মধ্যেই অন্ধ্রপ্রদেশে আমাদের যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা থেকে দূরে থাকাটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল।

কিন্তু এখনও মনে পড়ে টাইগারের প্রভুভক্তির কথা, মহাবীরের বন্ধুত্বের কথা। আর শেষ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে উঠলেই মনে হয় বাইরে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখব অঝোর বৃষ্টি, বৃষ্টির রুপোলি পর্দা আর রাত্রির গাঢ় অন্ধকার ভেদ করা বিদ্যুৎচমক, আর সেই আলোয় দূরে মোমপাহাড়ের ওপর জেগে থাকা আবছা এক সাদা ক্রশ।


আর তারই নীচে হয়তো অন্ধকারের বুক চিরে অশরীরি ছায়ামূর্তির মতো অনন্তকাল ধরে খেলা করে বেড়াবে একটি ইউরেশিয়ান গ্রিজলী, একজন নির্ভীক যুবক এবং তার প্রভুভক্ত, ছায়াসম সঙ্গী একটি কক্যাসিয়ান মাউন্টেন হাউন্ড ।।