Saturday, March 29, 2014

The Winner Stands Alone

মেরে হাথো, হুয়া যো কিস্সা শুরু,
উস্সে পুরা, তো করনা হ্যায় মুঝে ||


এই কথাটা বলা যতটা সোজা, করা ততটাই কঠিন | আমাদের মধ্যে কতজন নিজের জীবনের সফলতা বা অসফলতার দায়িত্ব মাথা পেতে নিতে পারবে? আমরা কতজন জীবনে যে রাস্তায় একলা চলা শুরু করেছিলাম, তার শেষ দেখার সাহস রাখি?

প্রশ্নটা কঠিন | তবে এর উত্তরও আমাদের জীবনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে |

আমি সাধারনতঃ ব্লগের ব্যক্তিগত পোস্ট শেয়ার করি না | তবে ব্যতিক্রম, জীবনে মাঝেমধ্যে রাখা ভালো |

This is from my blog entry of 2nd January, 2012.

লুকিয়ে থাকার গল্প

"ক্ষুধার্ত, আমি পাহাড় থেকে নেমে এলাম। আমার পরণের কাপড় ময়লা। আমার দেহে রাত জাগার ক্লান্তি। কিন্তু আমার চোখে মুখে ভোরের আলো। আর আমার মনে আশা। কিসের তা জানিনা। জানলেও আমি ছাড়া আর কেউ জানবেনা। জানা আর অজানার মধ্যে কতোই বা তফাৎ।

আমি লুকিয়ে আছি। পৃথিবীর থেকে। কেউ জানেনা। কিন্তু নিজের কাছ থেকে সত্য গোপন করে লাভ নেই। লুকিয়েই আছি আমি...এবং অবশ্যই কারন আছে। তবে সেটা বলা শক্ত।

 তবে আমি ফিরব। খুব তাড়াতাড়ি। এবং সবাই জানবে। জানবে যে আমি ফিরেছি। আমি সেই দিনের স্বপ্ন দেখি। রোজ দেখি। আমি জানি, আমি ক্ষুধার্ত। আর আমার ক্ষুধা মিটবে, খুব তাড়াতাড়ি।


কিন্তু যতদিন না সেই দিন আসে, আমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে। মানুষের থেকে। নিজের থেকে। "

-Jan 2nd '12


একটা সময় ছিল, জীবনের অনেকগুলো ব্যাপারই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল | লক্ষ্যভ্রষ্ট, নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদে সরিয়ে নিয়েছিলাম অনেক কিছু থেকে | একদম একা হয়ে পড়েছিলাম | কারনটা অবশ্য নিজেরই কিছুটা হঠকারিতা আর স্বপ্নকে ছুঁতে চাওয়ার আশা | তা যাইহোক, সেই স্বপ্ন কে আমি পাইনি | একবার না, দ্বিতীয়বারের চেষ্টাতেও না | তারপর হঠাত মনে হয়েছিল নিজেকে এবার ভাঙা দরকার | তাই করেছিলাম | সরিয়ে দিয়েছিলাম মানুষজনকে অনেক দূরে | এতটা দূরে, যাতে তারা ফিরে আসার রাস্তাটাকে ঘৃণা করে | ভেবেছিলাম, 'যদি আমার কাছে হারাবার মতন কিছু না থাকে, তাহলে আমি আর নতুন করে কি হারব? সামনে যদি সত্যি কিছু থাকে, তাহলে সেটা জেতার রাস্তা |'

আমার প্ল্যান কাজ করলো | রাস্তা একদিন সত্যিই খুঁজে পেলাম | কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে গেছে | কয়েকটা মুখ বিবর্ণ, স্মৃতি থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে গেছে |


অনেক সময় পর, আজ যখন গ্রেটার হায়দরাবাদের উঁচু উঁচু ফ্লাইওভার গুলো দিয়ে কাস্টমারের গাড়িতে করে ইন্সপেকশন থেকে ফিরি, বন্ধ এসি গাড়ির কাঁচের জানলাটার মধ্যে থেকে নিচে শহরটাকে মোহময় লাগে | ছোট ছোট বাড়িগুলো একই ধাঁচের | তবু জেগে আছে নিজেদের জীবনের গল্প নিয়ে |


আর মনে পড়ে, একসময় অন্ধকার, নীরবতা আর একাকিত্বকে আপন করে নিয়েছিলাম |

And it was worth the risk I took. Including the sacrifices.

Saturday, March 15, 2014

কাঁচের চুড়ির শব্দ



মেয়েটা রোজ আসে |

সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটার মধ্যে এপাড়ার যত অফিসের বাবুরা আছে, তাদের যাতায়াত কমে আসে | এপ্রিলের প্রখর রোদে সামনের কালচে ছাই রঙের পিচের রাস্তাটা একা আগুনের হলকার মত পুড়তে থাকে | মাঝে মাঝে শুধু দু-একটা দূর নীল আকাশের গা থেকে ছিটকে পড়া চিলের ডাক | উল্টোদিকের তিনতলা বাড়িটার ছাদে সকালের কাচা রঙ-বেরঙের কাপড়জামা ঝুলছে |

মেয়েটা রোজ এপাড়ায় আসে | বেগুনী রঙের সালোয়ার, হালকা রঙের কামিজ | কাঁধে একটা ভারী শান্তিনিকেতনি ব্যাগ |

ছেলেটা গ্রিল দেওয়া জানলাটায় হেলান দিয়ে বসে দূর রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে | কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা ভেদ করে উদাসী দৃষ্টিটা চলমান জীবনের মধ্যে কোনও অচেনা গল্প খুঁজে বেড়ায় |

ছোট্ট, আধা অন্ধকার ঘরটা অগোছালো, কাগজ আর বইয়ে ছড়াছড়ি | কাঠের টেবিলটার ওপর রাখা দোয়াত আর পেনটার দিকে তাকিয়ে থাকলে মাঝে মাঝে একটা স্বপ্নজগতের সৃষ্টি হয় | পাশের বাগান থেকে সন্ধ্যেবেলা ভেসে আসা থোকা বেলফুলের গন্ধের মতই যেন কাগজের ওপরের লেখাগুলো ভেসে ভেসে ওর চারপাশে খেলা করে | কালো গোটা গোটা অক্ষরগুলো হাতে হাত রেখে নাচতে থাকে | ও চাইলেও সেগুলোকে ধরতে পারেনা | লেখাগুলো অধরা, অসমাপ্তই পড়ে থাকে | শুধু অবেলার ছিটকে পড়া চিলের ডাকগুলো স্বপ্নের চটক ভাঙিয়ে দেয় |

হাওয়ায় ঘরের কোণায় শূন্য খাঁচাটা দুলছে | এটা ওর আসার আগে থেকে ছিল | হয়তো আগের ভাড়াটে যাওয়ার আগে ফেলে গেছে | কালো, ফাঁকা, বদ্ধ খাঁচাটার অস্তিত্ব ঘরটাকে আরো একাকী করে দেয় | জানলার একপাশে একটা সরু সুতোয় ঝোলানো কয়েকটা কাঁচের চুড়ি, একটার সাথে আরেকটা বাঁধা | মাঝে মাঝেই দমকা হাওয়ায় টুং- টাং শব্দে বেজে ওঠে |




কাছেই কোথাও একটা গোলমালের আওয়াজ কানে আসে | পাশের ঘরের ভদ্রমহিলার কন্ঠস্বর | ছেলেটা দরজা খুলে এগিয়ে দাঁড়ায় |

"এখানে সেলসম্যানদের কে ঢুকতে দিয়েছে? নিচের বোর্ডে কি লেখা আছে দেখোনি?"

ছেলেটা অবাক বিস্ময়ে চোখ তুলে তাকায় | ওর থেকে হাত পাঁচ-ছয় দূরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু করে |

"আর যেন আমার বাড়ির দরজার সামনে না দেখি |" টানা বারান্দাটার ওপাশের ঘরের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে যায় |

ঘরের সামনে দুটো টবে হলুদ-সাদা ম্যাগনোলিয়া আর সাদা গোলাপের মেলা | বাইরের রোদ বারান্দার একপাশে কেমন ঢেউ-খেলানো একটা জ্যামিতিক চিত্র এঁকে রেখেছে |

মেয়েটা আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ায় |

"একটু খাওয়ার জল..."

         ছেলেটা কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে থাকে | তারপর বলে, "আসুন |"


     ঘরে বসার জায়গার বড়ই অভাব | রঙ-চটা, আধময়লা একটা তোষক, আর একটা নড়বড়ে কাঠের চেয়ার | ছেলেটা চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে জলের গ্লাসটা কাগজপত্র ডাই করে রাখা টেবিলটার এক কোণায় রাখে |

"আমি আপনাকে আগেও কয়েকবার দেখেছি | আপনি... "

মেয়েটা গ্লাসের জলটা শেষ করে খালি গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখে | তারপর কাঁধের শান্তিনিকেতনি ব্যাগটা থেকে 'এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা' -এর দুটো ভল্যুম বের করে ওর দিকে এগিয়ে দেয় |

"আমাদের কোম্পানী খুব কম দামে বাজারে এনেছে | বাইরে কিনলে দু' হাজার দুশো পড়বে, কিন্তু আমরা মাত্র আঠেরোশোয় দিচ্ছি | একটা নিয়ে পড়ে দেখুন |" মেয়েটা এক নিঃশ্বাসে বলে চলে |

ছেলেটা বইটা হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে | 'এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা' | একজন উঠতি, অনামী লেখকের জীবনে এটার কি মূল্য ও জানেনা |

মেয়েটা একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে | ছেলেটা কিছুক্ষণ পরে চোখ তুলে তাকাল |

"আপনি এটা নিলে আমি এগারো টাকা কমিশন পাব |" নিঃশব্দ, একলা ঘরটায় মেয়েটার দীর্ঘশ্বাস পড়ল |

ছেলেটা বইখানা খানিকক্ষণ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলো | তারপর টেবিলের ওপর বইটা রেখে উঠে গিয়ে কোণের ছোটো একটা দেরাজের ভেতরের একটা ব্যাগ থেকে চারটে পাঁচশো টাকার নোট বের করে এনে মেয়েটার হাতে দিল |

"বাকিটা আপনি রেখে দিন |" ছেলেটা খানিকটা হাসার চেষ্টা করলো |

মেয়েটা খানিকক্ষণ একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে রইল | তারপর মুচকি হেসে বলল, "এক শর্তে | আপনাকে আজকে আমার সাথে লাঞ্চ করতে হবে |" এই বলে সে ওর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা লাঞ্চবক্স বের করলো |


দুজনেই এবার দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল |




দু'মাস পরে একটা পড়ন্ত বিকেলে একই বাড়ির ছাদে ছেলেটা আর মেয়েটা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল | মধ্য কলকাতার সংকীর্ণ গলিগুলো বাড়িটাকে ঘিরে এদিক ওদিক অদৃশ্য হয়েছে | যেদিকে চোখ যায় শুধু পুরোনো আমলের ছোটো-বড় বাড়িঘরগুলো নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে | রাস্তার পাশগুলো টেলিফোন আর ইলেকট্রিকের উঁচু কালো তারে ঢাকা | কালচে হলুদ বাড়িগুলোর দোতলার ঝুলবারান্দা গুলো দুপুরে শুকোতে দেওয়া জামা-কাপড়ে ভর্তি | পশ্চিমে একটা চারতলা বাড়ির ডানদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে | দূরে একটা মসজিদে নামাজ পড়া শুরু হল |

মেয়েটা আস্তে আস্তে সরে এসে ছেলেটার কাঁধে মাথা রাখল |


ছেলেটার ভেতরে একটা ঝড় চলছিল | সাত বছর আগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় ওর মনে শুধুই লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল | আর ও জানত, পৃথিবীর কোনো বাঁধন ওকে সেই স্বপ্নকে পাওয়া থেকে আটকাতে পারবেনা |

ওকে পালাতে হবে | এখান থেকে অনেক দূরে |



গ্রীষ্ম চলে গিয়ে বর্ষা এল | প্রকৃতি দ্রুত বদলে গিয়ে সবুজ রঙে সেজে উঠল চারদিকে | কয়েকটা মানুষের জীবনও কি তাড়াতাড়ি বদলে গেল |

মেয়েটা আজ আকাশী নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে | ছেলেটার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে | খুব কম কথা বলে আজকাল ছেলেটা | শুধু ওর চশমাটার ফাঁক দিয়ে উদাসী দৃষ্টি আর করুণ একটা হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকে |

কিন্তু মেয়েটা ওকে ভালোবাসে | সেই প্রথম দিন থেকে |

বিকেল থেকে আকাশটা মেঘলা | ঠিক আঠেরোটা সিঁড়ির ধাপ গুনে দোতলায় উঠে বাঁদিকের দরজাটায় আওয়াজ করতে গিয়েও থেমে গেল ও |

দরজাটা খোলা |

বারান্দায় দরজার উল্টোদিকে ফুলগাছ গুলো জল না পেয়ে মরে গেছে |

খোলা দরজাটা দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকতে গিয়েও মেয়েটা দরজার সামনেই আটকে গেল |


ঘরের এককোণে শূন্য খাঁচাটা জানলা দিয়ে আসা দমকা হাওয়ায় দুলছে | কাঁচের চুড়িগুলো নিজেদের মনে একা একা টুংটাং খেলা করছে | পুরোনো টেবিলটার ওপরে ডাই করে রাখা বইগুলো কেউ যেন সযত্নে সরিয়ে নিয়েছে | গোটা ঘরময় শুধু একগাদা বাতিল করা কাগজ | কয়েকটা আসন্ন বৃষ্টির হাওয়ায় ওর পায়ের কাছে উড়ে বেড়াচ্ছে | পুরোনো খাটটার ওপর আধময়লা তোষকটা অদৃশ্য | শুধু টেবিলটার ওপর পড়ে আছে দুটো জিনিষ |

একটা এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা | আর তার ওপর একটা কালো, মোটা ফ্রেমের চশমা |


শূন্যে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে গিয়েও না পেরে মেয়েটা দরজার কাছেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল |

শত সহস্র না-বলা কথা, রাগ-অভিমান-ভালবাসা সব সেই রুদ্ধ কন্ঠে, অশ্রুজলে আটকে রয়ে গেল | "না... না... " শব্দে মেয়েটা কাঠের দরজাটা আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো |

     দূরে কোথাও কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল | ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা এবার বড় বড় ফোঁটায় জানলা দিয়ে এসে ঘরের একদিকটা ভিজিয়ে ফেলবে | দক্ষিণের বাতাসটা বৃষ্টির কাঁধে চড়ে ঘরের মধ্যে হঠাত একপাক ঘুরে গেল | ঘরের মধ্যে কাগজগুলো এবার এদিক থেকে ওদিক উড়ে চলেছে | হয়তো ওদের মধ্যে আনমনে লিখে ফেলা কিছু চেনা-অচেনা শব্দ নিঃশব্দেই একটা গল্প রচনা করবে |



বুকফাটা একটা কান্নাকে ভেদ করে সুতোয় বাঁধা কাঁচের চুড়িগুলো টুংটাং শব্দে হাওয়ার তালে তালে বাজতে লাগলো | আর তারপর দূরে কোথাও গুরুগম্ভীর বাজ পড়ার শব্দে সেই আওয়াজও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল ||


Saturday, March 1, 2014

একটি সুখের জন্ম

ব্যস্ত নার্সিংহোমের লম্বা করিডোরটায় দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা ছেলেটার হাতদুটো ধরে বললেন, "তুমি না থাকলে আজ মেয়েটার কি হতো জানিনা | একে তো ওই রাস্তাটায় মানুষজন কম, ভাগ্যিস তুমি ওই সময় ওখান দিয়ে যাচ্ছিলে | নইলে এত বড় দুর্ঘটনার পর বেশীক্ষণ একা পড়ে থাকলে হয়তো..."

"আজ কেমন আছে ও?" ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো |

"আগের থেকে ভালো | সকালে তো কথাও বলেছে | ডাক্তার বলেছে মাথার আর চোখের তলার ব্লাড ক্লটিংগুলো ঠিক হয়ে গেলে পায়ের প্লাস্টার সমেত চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে | তুমি আজ একবার কথা বলে যেতে চাও?"

ছেলেটা চোখ মেলে তাকালো | কি যেন ভাবলো | তারপর বলল, "নাহ থাক, সুস্থ হয়ে এসেছে যদি... আমি বরং কাল এসে আরেকবার খোঁজ নিয়ে যাব |"

কিন্তু পরের দিন ছেলেটা আর এলনা | তার পরের দিনও না | তিনদিন পর মেয়েটার মা-বাবা ওকে বাড়ি নিয়ে গেল |


নিঃশব্দ অন্ধকার সরোবরের পাশের রাজপথে ছ'দিন আগের এক সন্ধ্যেবেলায় পায়ে একটা সজোরে ধাক্কার সাথে সাথে অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেই ব্ল্যাক আউট হয়ে যাওয়ার পর, আর তার ঠিক ষোলো ঘন্টা পর চোখ মেলে তাকানোর মাঝখানে কি ঘটেছিল - মেয়েটা ওর মা-বাবার কাছ থেকে শুনলো | ওর মা ওকে বারবার ছেলেটার কথা বললো |

"কোনও নাম বলেছিল কি?" মেয়েটা জানতে চাইল |

ওর মা একটা নাম বলল | মেয়েটা খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্কভাবে চোখ ফিরিয়ে নিল |

"তুই চিনিস না? ছেলেটা বলল ও তোর পুরোনো বন্ধু!"

"চিনতাম হয়তো, অনেকদিন আগে | ...ঠিক মনে নেই |" মেয়েটা জানলার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল |

বাইরের আকাশটা ছাই রঙের মেঘে ঢাকা | উল্টোদিকের ফুটপাথে কাঠচাঁপা গাছের মাথাটা ঝোড়ো হাওয়ায় দুলছে | পড়ন্ত বিকেলের কাকগুলো বৃষ্টির আশঙ্কায় বাসার দিকে উড়ে চলেছে | শহরে বর্ষা এল |

শহরের অন্য কোনো প্রান্তে একটা আধখোলা জানলা দিয়ে দমকা ঝোড়ো হাওয়া এসে টেবিলের ওপর রাখা একগাদা সাদা ফুলস্কেপ কাগজকে গোটা ঘরময় উড়িয়ে দিল |

দূরে কোথাও একটা কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল | টিপটিপ বৃষ্টিটা এবার বড় বড় ফোঁটায় ঝরে পড়ে দূরের দৃষ্টিটাকে প্রায় ঝাপসা করে ফেলছে | মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটাকে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে ছেলেটা জানলার কাছে উঠে এল |


তারপর শহরে বর্ষা এলো | প্রকৃতি আরেকবার সেজে উঠল সবুজ রঙে | ধুয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে যত ধূলো-কাদা, মান-অভিমান |

একাকী ছেলেটা সারাদিন বসে আকাশপাতাল ভাবে | মেয়েটার কথা |


তিনমাস পরে শহরে দুর্গাপুজো এলো | ষষ্ঠীর সন্ধ্যেবেলা ভিড় থেকে দূরে রাস্তার পাশে কয়েকটা সিঁড়ির ওপর বসে ছেলেটা রাস্তার কয়েকটা বাচ্চার খেলা দেখছিল | বাচ্চাগুলোকে ও বেলুন কিনে দিল | সামনের দোকান থেকে খাবার আনিয়ে খাওয়ালো |

রাস্তার পাশের দেওয়ালটায় হেলান দিয়ে আর একটা পা ভাঁজ করে ঠেস দিয়ে, দূরের আলো দিয়ে সাজানো বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ছেলেটা ভাবলো, সুখ জিনিসটা আসলে কী? আলো দিয়ে একটা বাড়ি, একটা পাড়া, একটা গোটা শহর সাজিয়ে ফেলা যায়, কিন্তু তাতে ভেতরের দুঃখ যায় কি?

নিজের খেয়ালে ডুবে থাকা ছেলেটা খেয়াল করেনি, দূরে অন্ধকারে দুটো ছায়ামূর্তি ওর দিকে এগিয়ে আসছিল | যখন করলো, তখন দেরী হয়ে গেছে | পালানোর সময় নেই |

মেয়েটার মা আবছা অন্ধকারেও ওকে চিনতে পেরে এগিয়ে এল |

"আরে তুমি, এখানে? কেমন আছ?"

ছেলেটা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে একবার স্মিত হেসে মাথা নামাল | পরমুহুর্তে চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকাতে দেখল তার কঠোর দৃষ্টি ওর ওপর নিবদ্ধ |

"সেবার তো তুমি হঠাতই উধাও হয়ে গেলে | এবার কিন্তু তোমাকে একবার আমাদের বাড়ি আসতেই হবে |" ভদ্রমহিলা বলে চললেন |

ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল |

"না, থাক... আমি এমনিতেই গোটা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকি | আর আমি নিশ্চিত আপনার এবং আপনার মেয়েরও অন্যান্য কাজ থাকবে |"

ভদ্রমহিলা সামান্য হাসলেন | তারপর বললেন, "তোমরা কথা বলো | আমি এগোই |"


ছায়াটা দীর্ঘায়িত হতে হতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল | মেয়েটার অপলক দৃষ্টি এখনও ওর দিকে নিবদ্ধ | ওর দৃষ্টি মাটিতে | চারদিক জুড়ে এখন শুধুই নীরবতা |

মাঝখানে কতদিন হবে | সাত বছর? আট বছর?

"আই রেড হোয়াট ইউ রোট এবাউট মি |" মেয়েটা বলল |

ছেলেটা মুখ তুলে তাকালো | ও জানত না কি বলা উচিত |

মেয়েটা দূরের বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল |

"তা বলে বেলুন কিনে দিতে হলো?"

ছেলেটা মাথা নামাল | কাউকে সুখী দেখার আনন্দই কি সুখ? ও জানত না |

"আই জাস্ট ওয়ান্টেড টু সী দেম হ্যাপি | দ্যাট্স অল |"

"বাট হোয়াট এবাউট ইওর ওন হ্যাপিনেস?"


ছেলেটার চোখ দিয়ে জল নেমে এসেছিল | সেটা মেয়েটার দৃষ্টি এড়ালো না |

"শেষবার, আমি ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগ পাইনি |"

মেয়েটা দু'পা এগিয়ে এসে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে ওর ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা চুম্বন এঁকে দিল | তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসল |



শহরের অচেনা এক কোণে আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী আর মানুষজনের ভীড় থেকে দূরে আরেকটা সুখের জন্ম হল ||