এখানে, শহরের এই প্রান্তে আকাশটা খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে আসে। যদিও পুরো
আকাশটা নয়, শুধু যে প্রান্তটায় সূর্যটা এদিনকার মত অস্ত যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। আমার
মাথার ওপরের আকাশ যদিও এখনো হলুদ, কোথাও বা মেঘের গা থেকে ছলকে পড়া নীল। এইসময় লেক-প্লেসের
চারদিকে লম্বা লম্বা গাছগুলো তাদের ডালের প্রান্তভাগ দিনের শেষ সুর্যালোক পাওয়ার
জন্য প্রসারিত করে দেয়। দিনের পাখিরা গোধূলির আলোয় ঘরে ফেরার তোড়জোড় শুরু করে। পাখিদের
চিৎকারে এই সময়টা লেকের চারপাশ ব্যস্ত হয়ে ওঠে। নীল জল আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে
কালো হয়ে ওঠে। লেকের ওপাশটায় যে ক্রিকেট কোচিং একাডেমিটা আছে তার প্র্যাক্টিস সেশন
এই সময় শেষ হয়। আমার পাশ দিয়ে বিভিন্ন মানুষের যাতায়াত। প্রকৃতির যত জীবন্ত আর
প্রাণহীনের দল এইসময় এক হয়ে যায়। দিন যে শুধু নিঃশব্দেই শেষ হয় তা নয়, বরং সে
অন্ধকারকে এক প্রেতাত্মার মতন ডেকে নিয়ে আসে। যখন দিনের সব রঙ মিলেমিশে একাকার হয়ে
যায়, যখন সকালের নীল বিকেলের হলুদের মধ্যে দিয়ে শেষে পশ্চিমের আকাশের রক্তবিন্দুতে
পরিণত হয়, সেই প্রেতাত্মার উদয় ঘটে। আমাদের স্বপ্ন আর সুখের হাতছানির মধ্যেই
জীবনের অবসান হয়। বিশ্বাসঘাত হয়।
আর
তারপরেই সেই গন্ধটা ভেসে আসে।
গন্ধটা ছাতিম ফুলের। গোটা লেক প্লেসটাই ছাতিম গাছে ভরা। আমার স্ত্রী একসময় এই ফুলগুলো খুব ভালোবাসত, আর আমিও। অনেকদিন
আগে আমরা যখন এখানে একসাথে হাটতাম, ফুলে ভরা গাছগুলোর নিচের দিকের ডালগুলো আমি হাত
দিয়ে নিচু করে ধরতাম, আর রিনিতা ফুলগুলো পাড়ত। নিজের হাতের তালুর ওপর ফুলগুলো রেখে
অনেকক্ষণ ধরে গভীর নিঃশ্বাষের সাথে ঘ্রাণ
নিত। ওই মুহুর্তগুলোতে আমি ওর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, আর নতুন
করে ভালোবেসে ফেলতাম। সিমেন্টের বেঞ্চগুলোর কোনও একটায় আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে
থাকতাম। আমার হাত থাকত ওর কাঁধে, আর ওর হাত আমার কোমর জড়িয়ে। চারদিকে সবুজের মেলা,
সামনে রবীন্দ্র সরোবরের নীল জল, আর ওপরে উন্মুক্ত আকাশ।
“ মৃতের ডান হাত ভেঙ্গে গেছিল, যেন সে কোনও এক প্রবল শক্তিকে বাধা দিতে গিয়ে
অমানবিক ভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল। মাথা দু’বার থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল, একবার ডানদিকের
কোনায়, আর একবার পেছনের দিকে... ”
এবার
বৃষ্টি এসে পড়ে। নরম, শান্ত জলের ফোঁটা। ঠিক রিনিতার মত। মিষ্টি রিনিতা। এরকম কেন
হয়, যখনই আমি তোমার কথা ভাবি, আমার চোখ জলে ভরে যায়? এরকম কেন হয়, তোমার কথা মনে
পড়লেই আমি এত একা হয়ে যাই? এত একা, চুপচাপ, গোটা পৃথিবী থেকে আলাদা। দেখ আজ
আবহাওয়া কত সুন্দর। আজ এই বৃষ্টিতে আবার আমার সাথে ভিজতে তোমার ভালো লাগবেনা?
তাকাও এই গাছগুলোর দিকে, দেখ এরা আজও তোমাকে ভোলেনি। তুমি কি ওদের আর চাওনা? তুমি
কি আমাকে আর চাওনা?
দূরে, রবীন্দ্র
সরোবরের অন্য দিকটা গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যায়। লেকের সরু রাস্তাটা আবছা, ধুসর হয়ে
আসে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলতে থাকে। আমি ভিজে যাই। অন্ধকারে বৃষ্টির একটানা শব্দ আমাকে
বাস্তব জগৎ থেকে অনেকদূরে নিয়ে চলে যায়। সে আমার স্বপ্নের জগৎ, রিনিতার জগৎ।
“মৃতের ওপর তিনবার অত্যাচার হয়েছিল। আর
একবার মৃত্যুর পরে...”
আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। রিনিতা। আমার রিনিতা। যখন পুলিশের কাছে তোমার দেহ
চাইতে গিয়েছিলাম, আমাকে দেখে তোমার করুণা হয়নি? তোমার রক্তে আর আমার চোখের জলে
আমার গোটা শরীর ভিজে গিয়েছিল...কত চেষ্টা করলাম তোমার শরীর থেকে সব রক্ত মুছে
নিতে, কিন্তু পারলাম না। শ্মশানে আমি একা ছিলাম রিনিতা, একদম একা।
আমি রাস্তার
ওপরে হাটু ভাঁজ করে বসি। পায়ের কাছে হাজার হাজার ছাতিম ফুল। বৃষ্টিতে ভেজা কয়েকটা
ফুল হাতের তালুর ওপর তুলে নিলাম। ফুলগুলো দেখে রিনিতার কথা মনে পড়ে গেল।
“আমি ছাতিম ফুল ভালোবাসি...”
“আর আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
একসময়
বিশ্বাস করতাম মানুষ মৃত্যুর পরে ছাতিম ফুল হয়ে যায়। আর সেই মুহুর্তে আমি রিনিতার
সঙ্গ অনুভব করলাম।
ভালোবাসা। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কীভাবে মানুষ এমন একজনকে ভালোবেসে যেতে পারে যে আর এই পৃথিবীতে নেই? কীভাবে মানুষ তার লেখার মধ্যে তার সেই ভালোবাসার
মানুষকে খুঁজে চলতে পারে? কী এমন আছে এই ভালোবাসাতে যা একজনকে আরেকজনের থেকে কোনওভাবে
আলাদা করতে পারেনা? এমনকী মৃত্যুও না।
দুর্বল পাদু’টোর ওপর
ভর করে উঠে দাঁড়াই। আঁকাবাঁকা পথটা ধরে রবীন্দ্র
সরোবরের অপর পাড়ের দিকে হাটতে শুরু করি। বৃষ্টি আর ডিসেম্বরের ঠান্ডায় কাঁপুনি
আসে। সরু পথটার দু’দিকে বুনো ঝোপ। নোংরা, কাঁটা আর কাদায় ভরা অন্ধকার ঝোপগুলো দেখে
নিজের কথা মনে পড়ে। আশাহীন, লক্ষ্যহীন, সঙ্গীহীন নির্বাক একটা মানুষ। মনে পড়ল সেই
লোকটির কথা, যে আমার লেখা পড়ে বলেছিল, যে তিনটে শব্দ দিয়ে আমি আমার গল্পের
চরিত্রগুলোর বর্ণনা করি- একাকিত্ব, নৈশব্দ আর অন্ধকার...সেগুলো আমার গল্পের মূল
ভিত্তি। যে কথাটা সে জানত না, একই তিনটে শব্দ আমার জীবনের সাথেও ওতপ্রোত ভাবে
জড়ানো, আজীবন।
একশ গজ
দূরে লেকের খাড়া একটা অংশ স্থানীয় রেলস্টেশনকে আলাদা করে রেখেছিল। ঘাস আর কাদায়
ভরা জায়গাটা পেরিয়ে লাইনের ওপর উঠে এলাম।
পৃথিবী জানবেনা। কিন্তু শুধু যে একজন নেই, সেইজন্যেই নয়, বরং তার সাথে মিলিত
হওয়ার এটাই শেষ সুযোগ। আহ, ঠান্ডালাগা ভাবটা এবার আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। একটু
আগেই যে আমি ঠান্ডা আর বৃষ্টিতে কেঁপে উঠছিলাম, সেই আমিই এখন তার স্ত্রীর সাথে
শেষবারের মত মিলিত হওয়ার জন্য উত্তেজিত।
দূরের সিগন্যাল লাল হয়।
অগাধ ভালোবাসা, রিনিতা।
এবার ট্রেনের
শব্দ ভেসে আসে। এই ট্রেনটাই কতদিন আমরা লেকের ওপাশটা থেকে বেঞ্চে বসে দেখতাম।
দ্রুতগামী ট্রেনের চলমান কামরার উজ্জ্বল আলোগুলোর লেকের জলে স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।
আজ শেষবারের মত।
সেই গন্ধটা
আবার ভেসে আসে। এবার তীব্রতর।
“তুমি এসেছ রিনিতা? তুমি আমার জন্যে এসেছ? আমাকে নিতে?” আমার সারা শরীর থরথর
করে কেঁপে ওঠে। ওর প্রিয় পোঙ্গল শাড়ীর এক কোণায় ও ছাতিম ফুলগুলো বেঁধে রাখত। সেই
ফুল আজ পুরোনো। আমি ছাড়া আর কে এই ফুল
ওকে সংগ্রহ করে দেবে?
“আসছি রিনিতা, আমি তোমার কাছে আসছি।”
শীতল ডিসেম্বরের কাঁপানো রাতে সংজ্ঞাহীন একটা
দেহ রেললাইনের ওপর লুটিয়ে পড়ে, শেষবারের মতো ।।
-24th Nov '11
শব্দচয়ন অনবদ্য...একটা বিষণ্ণ, করুণ সুর যেন দূর থেকে ভেসে আসছে...এই ভালবাসাই মানুষকে মানুষের সাথে বেঁধে রাখে অবিচ্ছেদ্য ভাবে...সমস্ত পরিবেশ টা খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে...এই ভাবে এগিয়ে চল... :)
ReplyDeletevalo:) aro bangla lekh..
ReplyDeleteThanks. Yeah, more of them are on the way... :)
ReplyDelete