Saturday, December 8, 2012

যে মানুষ উড়তে চেয়েছিল


                       ভেবেছিলাম হরিদ্বারে এসে মনটা ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু হল না। স্টেশন থেকে অটো নিয়ে ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের’ দিকে রওনা দেওয়া মাত্র সেই খারাপ-লাগা অনুভূতিটা চেপে ধরল। একটা ভেজা স্যাঁতসেতে, উদাস, মন খারাপ-করা অনুভূতিযেন এখানে আমি আর স্বাগত নই। এটা ঠিক, যে পৃথিবীটা অনেক বড় জায়গা, কিন্তু নিজের থেকেই যখন নিজেকে পালাতে হয়, জায়গাটা তখন অনেক ছোটো হয়ে আসে।

আবার ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’। আবার সাধু মহারাজ। সেই চাবি, সেই ঘর। নীচের রেজিষ্টারে একবার চোখ বুলিয়েই চাবি নিয়ে এগোলাম। একতলার কোণার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটা ফি বছর আমার জন্যে বরাদ্দ। পুজোর সময়টা প্রতি বছর এখানেই। পাঁচ বছর আগে থেকেই এরকম চলছে। কল্যাণীদের সাথে পরিচয় হওয়ার সময় থেকে। কত কিছুই বদলে গেল এই পাঁচটা বছরে। ভাবলে এক এক সময়ে অবাক লাগে। কলকাতা থেকে আসা দুই পরিবারের হঠাৎ আলাপ হরিদ্বারে। আমার সাথে মা, বাবা। কল্যাণীর সাথে ওর বাবা আর দিদি, শিবানী। সেই এক দিন ছিল, আর আজ। 

                                বন্ধ ঘরের দরজা খুলতেই একরাশ বদ্ধ হাওয়া গায়ে, মুখে ঝাপটা মারল। বারান্দার দিকের জানালাটা খুলে দিলাম। মনে পড়ল আগের বার পুজোর সময়টাতেই খুব ঠান্ডা পড়েছিল। তার ওপর তোষক, বালিশ, কম্বলগুলো ছিল স্যাঁতসেতে। রাত্রে বিছানায় শুয়ে ঠক্‌ঠক্‌ করে কাঁপতাম।  ভোর পাঁচটা থেকে এখানে আবার মাইকে গান বাজে। ভক্তিমূলক গান। সব মিলিয়ে একটা ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। সাত-তাড়াতাড়ি পালিয়ে বেচেছিলাম সেবার। শুনেছিলাম অতিরিক্ত ঠান্ডায় হরিদ্বার-দেরাদুন-মুসৌরীতে অনেকে মারাও গিয়েছিল।
                           
                      এবার কাপড়-জামা ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবী পরার পালা। একবার বেরোতে হবে। ঘাটের দিকটা না গেলে ভালো লাগেনা। ঘরের দরজায় চাবি লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এখান থেকে অটো যাচ্ছে। রিকশাও। আবার যেসব লোকেদের সময়ের অভাব নেই তারা হেঁটেও পথ পাড়ি দিচ্ছে। একটা ফাঁকা রিকশা ডেকে উঠে পড়লাম।

হর-কি-পৌরীর ঘাট। এখানে হিমশীতল গঙ্গা কুলকুল করে বয়ে চলেছে। ঘাটের চারপাশে জনমানুষের ঢল। কোথাও স্নান চলছে। কোথাও বা পুজো। একটু এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে রুমাল বিছিয়ে বসে পড়লাম। আমার সামনে অবিরত ধারায় বয়ে চলেছে গঙ্গা। পড়ন্ত বিকেলের এক চিলতে আলো ওপরে মনসা পাহাড়ের গা থেকে পিছলে এসে পড়েছে ঘাটের ওপর। পিছনে গঙ্গার অপর পাশে দেরাদুন যাওয়ার রাস্তা আটান্ন নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে। বাসরাস্তার পাশেই বিশাল বড় এক শিবমূর্তি। আহ্‌ হরিদ্বার। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। 

                                           কল্যাণীর কথা মনে পড়ছে বারবার। উপায় নেই। মানুষের এই এক দোষ। কাছের মানুষ দূরে চলে গেলে শুধু তার কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ল পাঁচ বছর আগে এই হরিদ্বারেই আলাপ কল্যাণীদের সাথে। এবং প্রথম আলাপেই কি তুমুল হইচই। যেন কতদিনের চেনাশোনা। হরিদ্বার থেকে দুই পরিবারের একসাথে বাসে করে দেরাদুন, মুসৌরী। আমার সাথে কল্যাণীর চোখ চাওয়া-চাঊয়ি। মুচকি হাসি। এবং প্রেম।

সেবার মুসৌরীতে গিয়েও রাস্কিন বন্ডের সাথে দেখা করতে পারিনি। রাস্কিন বন্ড। যার লেখা পড়েই একরকম বড় হয়েছি। আইভি কটেজে ওনার বাসস্থানে গিয়ে জানতে পারলাম জরুরী কাজে তিনি দিল্লী গেছেন। ঠিক করেছিলাম, পরের বার এলে দেখা করে ফিরবই। কিন্তু পরের বার দেখা আর করা হয়নি। তার পরের বারও না।  

                           কল্যাণীর সাথে সম্পর্কটা অবশ্য টিকে গিয়েছিল। কলকাতায় ফিরে এসে সবার আগে ওর সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। সেই আমাদের ভালোবাসার সূত্রপাত। আর আজ এই।


সামনে গঙ্গার ঘাটে ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। এবার সন্ধ্যারতি শুরু হবে। কিন্তু সে জিনিষ দেখার মতোন মনের অবস্থা আমার নেই। প্যান্ট ঝেড়ে উঠে পড়লাম। এখানে মোতিবাজার রোডে একটা বাঙালী ধর্মশালা আছে। ওখানে একবার খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। হর-কি-পৌরীর ঘাট থেকে ডানদিকে হাটা পথ। দশ-পনেরো মিনিট হাঁটার পরেই রাস্তার পাশে ধর্মশালায় ঢোকার লোহার উঁচু দরজা। ম্যানেজার বাঙালী ভদ্রলোক। জিজ্ঞেস করতে হেসে অভ্যর্থনা জানালেন।  তারপর দশ-বারো মিনিট রেজিষ্টারের পাতা উল্টে-পাল্টে জানালেন, নাহ্‌ নেই। শুধু তাই না। গত ছ’ মাসে কল্যাণী ভট্টাচার্য্য নামের একা কোনো মহিলা এখানে আসেননি। এবং শোনামাত্র এতদিনের জমে থাকা আশঙ্কাটা এবার বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হওয়া শুরু হল।

                                            কল্যাণী সত্যিই নিরুদ্দেশ। যে কল্যাণী দু’দিন আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারত না, সেই মেয়ে। ওর দিদি শিবানীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ওর বাবা ছাড়া একমাত্র আমিই ছিলাম অর আপনজন। বিয়েটা হয়েও যেত হয়তো গত ডিসেম্বরে। কিন্তু হঠাৎই ওর বাবা মারা যাওয়াতে একটা বড় ধাক্কা খায় কল্যাণী। সময় চেয়েছিল কিছুটা। আর তারপর হঠাৎই একদিন এই খবর। কল্যাণীকে পাওয়া যাচ্ছে না।

মনে পড়ল শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল ওর সাথে সেদিনের কথা। কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল কল্যাণী।

“কি ব্যাপার?” আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

উত্তরে কিছু না বলে শুধু তাকিয়েছিল আমার দিকে। কয়েকটা সেকেন্ড। তারপর আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করেছিল আমি ওকে কতটা ভালোবাসি।

“তুমি আসার আগে এই পৃথিবীতে আমি শুধু চলে বেড়াতাম কল্যাণী। না ছিল উদ্দেশ্য, না ছিল কোনো লক্ষ্য। শুধুই রাস্তা। আর এখন তুমি পাশে থাকলে মনে হয় মাটির ওপর আর পা নেই আমার। ঊড়তে চাই আমি তোমার সাথে, কল্যাণী। সারা জীবন।”

                                                  আর সেটাই হয়ে গেল আমাদের শেষ কথা।


পরের দুটো দিন ফাঁকা। তাই ঠিক করলাম আগামীকাল দেরাদুন থেকে একবার ঘুরে আসব। আমার আবার আরেক বাতিক। লোকে দেখতে যায় নামী-দামী জায়গা। আমি খুঁজি একটু নিরালা, নির্জন পরিবেশ-লোকালয় থেকে দূরে। কয়েক বছর আগের ব্যাপার। এখানেরই কথা। হরিদ্বার থেকে গাড়ি ভাড়া করে দেরাদুন যাচ্ছি। দেরাদুনের কয়েক কিলোমিটার আগে একটা ছোটো ব্রীজের কাছে গাড়ি গেল খারাপ হয়ে। ড্রাইভার পাকা লোক। জানাল গাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সময় লাগবে।

কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলাম, “কত সময়?”

“তিন-চার ঘন্টা লাগবে স্যার।”

                       বোঝো। একে অজানা জায়গা। তার ওপর এতটা সময় কাটাই কিভাবে? যাহোক, ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে পাথুরে ঢাল বেয়ে নেমে গেলাম। আমার পেছনে পিচের রাস্তা বাঁদিকে সোজা চলে গেছে দেরাদুন পেরিয়ে মুসৌরী। একই রাস্তা ডানদিকে চলে গেছে হরিদ্বার। পাথুরে ঢালটা কয়েকশ’ গজ নেমে এসে একটা সমতল জায়গায় মিশেছে। এখানে খোলামেলা জায়গা অনেকটা। কয়েকটা ঘরবাড়ি। জায়গায় জায়গায় কাপড় শুকোচ্ছে। অক্টোবরের হাল্কা শীতের দুপুরে রোদের মিষ্টি হলুদ আলোয় পাথরের দেওয়ালগুলো খাড়া দাঁড়িয়ে। একটা ছোটো পাহাড়ি বস্তি।

                                      এই বস্তিতেই সেবার পরিচয় হল অনিল আর রাজিয়ার সাথে। আমার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে জেনে ডেকে এনে নিজেদের ঘরে বসিয়েছিল। চা খাইয়েছিল। অনিল আর রাজিয়ার তিন ছেলে-মেয়ে আমাকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছিল। তিনটে ফুটফুটে ছেলেমেয়ে। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল রাজিয়া। রাজন, লোকি আর বিল্লু।    

ঠিক করলাম, এবার দেরাদুন যাওয়ার পথে ওদের সাথে দেখা করেই যাব। রাতে খাওয়ার আগে বাসের খোঁজ করে রাখলাম। বাস ছাড়বে সকাল ছ’টা।

                              সকাল ছ’টা বেজে ঠিক বারো মিনিটে বাস ছাড়ল। চৌত্রিশ নম্বর পেরিয়ে আটান্ন নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়েতে ঢুকে বাসের গতি বাড়ল। বাঁদিকে বয়ে চলা গঙ্গার দিকে নজর গেল। কি পবিত্র, কি মনোরম, কি সুন্দর এই জায়গা। কি নিখুঁত মনে হয় পৃথিবীকে এখান থেকে। এরকম একটা জায়গায় বসে ভাবাই যায়না কল্যাণীর মতোন একজন স্রেফ উবে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে।      

দেরাদুন শহরে ঢোকার কিছুক্ষণ আগেই একটা বড় পুরোনো মন্দির পড়ে, রাস্তার বাঁ দিকে। ওখানেই নেমে পড়লাম। এরপর সোজা মিনিট দশেক হাটলেই সামনে একটা ব্রীজ। আর তার পাশেই ঢাল বেয়ে নিচে নেমে অনিল-রাজিয়াদের বস্তি। এতদিন পরে দেখা হবে, এই উৎসাহে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিলাম।

                         দরজা খুলে দিল রাজিয়াই। দরজা খুলে হঠাৎ আমাকে দেখে বিস্মিত হয়ে আনন্দের একটা আভাস খেলে গিয়েই আবার সেটা মিলিয়ে গেল ওর মুখ থেকে।

“চিনতে পারছ, রাজিয়া?” আমি হেসে বললাম।

রাজিয়া উত্তর দিলনা। ঘরের ভেতর থেকে দেখলাম অনিলও বেরিয়ে এসেছে। সঙ্গে রাজন আর বিল্লু। আর লোকি? লোকি কই?

শেষ প্রশ্নটা অস্ফুট স্বরে বেরিয়েই পড়ল।

                       রাজিয়া দেখলাম আমার দিকে চেয়ে। মুখটা থমথমে। চোখ জলে ভরা। অনিল পেছন থেকে ধীরে ধীরে বলল, “লোকি নেই ভাইয়া। আগের বছরের শীতেই সে...”

                                                 ঘরটা হঠাৎই খুব নিশ্চুপ হয়ে গেল।



পাথরের ঘরটা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম। অনিলদের বাড়িটার সামনে মস্ত বড় একটা পাথর। বসে পড়লাম মাথায় একটা হাত রেখে। মনে পড়ল আগের বছর এই পাথরটার ওপর বসেই ছোট্ট লোকি প্রথমবার আমাকে ডেকে বলেছিল, ‘আকাশ ভাইয়া’সময় কতকিছু কেড়ে নেয় মানুষের জীবন থেকে। লোকির কথা ভেবে কেঁদে ফেললাম। হতাশা, দুঃখ আর নিঃসঙ্গতাই মানুষের তিন সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। দু;খের দিনের বন্ধু। কিছু কিছু জায়গা আর লোকজনের সাথে কত স্মৃতি জুড়ে থাকে। হঠাৎ সেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেলে জীবনটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মনে হয় পৃথিবীটায় কি যেন নেই, কি যেন হারিয়ে গেল। জীবনটাই এরকম। আজ যার জন্য কাঁদছি, তার সাথে আমার সম্পর্ক বলতে শুধু ওই দুটো কথার – ‘আকাশ ভাইয়া’। দু’ বছর আগে যাকে চিনতামও না। সবটাই কেমন যেন বেহিসেবী, গোলমেলে। কিন্তু দুঃখদায়ক। গলার কাছটায় আবার একটা কান্না আটকাচ্ছে। কল্যাণীও কি কোনওভাবে...        

                                        দেরাদুন থেকে কোনওমতে পালিয়ে এলাম। এবার ভয় করছে। কল্যাণীর কি হল? আরেকটা দিন এখনও কাটাতে হবে এখানে। তারপর কলকাতা। কিন্তু সেখানে গিয়েই বা কোথায় পাব ওকে? 

                      পরের দিনটা হরিদ্বারেই ঘুরে বেড়ালাম। গঙ্গার ঘাট। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের চারপাশের কলোনীগুলো। এখানে ইউক্যালিপটাস গাছই বেশী। তবে দেবদারুও কিছু রয়েছে। আমার বরাবরই ইউক্যালিপটাস গাছ অসাধারন লাগে। তার প্রধান কারন এই গাছের পাতার গন্ধ। মোহময় এই গন্ধ। ইউক্যালিপটাসের তেল এই গাছের পাতা থেকেই আসে যা এই সমস্ত অঞ্চল থেকেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।          

বিকেলের দিকটা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের চারপাশটা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে লোকির কথা মনে পড়ল। মানুষ জীবনে যত স্বপ্ন দেখে তার অর্ধ্বেক শুধু স্বপ্নই রয়ে যায়। অধরা, বাস্তবের থেকে অনেক দূরে। আর বাকি অর্ধ্বেককে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে তার সারা জীবন শেষ হয়ে যায়। তাহলে প্রশ্ন হল, মানুষ স্বপ্ন দেখে কেন?  

                                   রাত্রিবেলা নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে তিনমাস আগে কল্যাণীকে লেখা একটা চিঠি খুলে বসলাম।



কল্যাণী, 
         কলকাতায় বর্ষা এসেছে। কয়েকদিন ধরেই তোর কথা ভাবছিলাম...কিন্তু তোর পরীক্ষা শেষের আগে তোকে বিরক্ত করা যাবেনা, তাই ভাবলাম এখানেই লিখি।

                              তোকে নিয়ে কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম...বা বলা যায় আমাদের নিয়ে। স্বপ্নে আমরা একটা পাহাড়ী পথে হাত-ধরাধরি করে হাঁটছিলাম। পথের দু’পাশে কত নাম-না-জানা রঙ-বেরঙের ফুল। কেন এরকম স্বপ্ন দেখলাম, জানি না। এও জানিনা তোর পাহাড় ভালো লাগে কিনা...কিন্তু আমি নিশ্চিত, জায়গাটা দেখলে তোর খুব ভালো লাগত।

                            সেই দিনের কথা তোর মনে পড়ে কিনা জানিনা, যেদিন জিজ্ঞেস করেছিলি, আমার তোকে এখনও ভালো লাগে কিনা। জানিনা, আমি যখন হ্যাঁ বলেছিলাম, বুঝতে পেরেছিলি কিনা, যে আজও আমি তোকে আগের মতোই ভালোবাসি। আমি জানি তুই অনেক ঝড়-ঝাপ্টার মধ্যে দিয়ে গেছিস, কিন্তু আমি এখনও তোর পাশে থাকতে চাই।

একবার বলেছিলি, আমরা এখনো একই রকম ভাবি। তাহলে আমরা একে অপরের জন্য কেন একই রকম আকর্ষণ অনুভব করতে পারিনা? কেন এতদিন পরে আমি তোর জীবনে একজন বিশেষ কেউ হতে পারিনা?

 মাঝে মাঝে তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। এমনি, সাধারন কথা, দু’জনের মধ্যে। কারন তুই আমার কাছে থাকলেই নিজেকে সুখী বলে মনে হয়। আমি জীবনে আর কারও জন্য এতটা অপেক্ষা করিনি যতটা তোর জন্য করেছি। কারন তোকে ছাড়া, জীবনটাকে এত একা মনে হয়...

                                                              ভালোবাসা নিস।
                                                                                  আকাশ।



                                     দূরপাল্লার ট্রেনগুলোর এই এক অসুবিধে। বেশিরভাগ বাতিই জ্বলেনা। হাতড়ে হাতড়ে কোনও মতে টর্চটা ব্যাগ থেকে বের করে নিজের সীট খুঁজতে হল। লোকজন বেশী নেই কামরায়। বেশীর ভাগই হয়তো মাঝরাত বা ভোরের দিকে উঠবে। ব্যাগপত্রগুলো সীটের তলায় চালান করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। স্টেশনের কয়েকটা দোকানে ভীড় করে থাকা লোকেদের কথাবার্তা আর মালপত্র নিয়ে ট্রেনে ওঠা লোকেদের ব্যাস্ততার মধ্যেই হাল্কা একটা হুইসেলের শব্দ কানে এল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনের দুলুনি, উল্টোদিক থেকে আসা একটা মালগাড়ীর চাকার ধাতব ঘষটানির শব্দ, পাশের কামরায় কয়েকজন হিন্দীভাষীর কাটা-কাটা কথা আর একনাগাড়ে চাকার শব্দ মেশানো আওয়াজের মধ্যে একটা অদ্ভুত জগৎ থেকে মুহুর্তের জন্য ভেসে উঠে আবার সেখানেই হারিয়ে গেলাম।

                       তিনফুট দেওয়ালটার ওপর আমি দাঁড়িয়ে। আমার পেছনে বিস্তীর্ণ ছাদের অন্ধকার, নিস্তব্ধতা আর একাকিত্ব। আমার সামনে মুক্তি। কত আলো। একশ ফুট নিচে রাজপথ। ব্যাস্ত পৃথিবী। আজ এই আলো আর ব্যাস্ততায় মিশে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

                           কল্যাণী কি সত্যিই আমার আর শিবানীর ব্যাপারে জেনে ফেলেছিল?   
    
                                                                 বুঝতে পারলাম গালের দুপাশটা ভিজে গেছে। দুচোখ দিয়ে জল নেমে এসেছে কখন, বুঝতে পারিনি। কিন্তু আর দেরী নয়। সময় হয়ে এসেছে। উড়তে চেয়েছিলাম আমি, কল্যাণীর সাথে। কিন্তু আজ প্রাণভরে একাই উড়ে বেড়াব। দিনের বেলা আকাশের দূর প্রান্তে ভেসে বেড়ানো কালো বিন্দুর মত দেখতে চিলগুলোর মত।

আমার নিচে রাজপথ, গাড়ি, মানুষজন সব মুহুর্তের মধ্যে বড় হতে হতে অন্ধকারে সবকিছু মিলিয়ে গিয়েই আবার এক ঝটকায় অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে চোখ-ধাঁধানো বাস্তবে ছিটকে ফিরিয়ে আনল। ঘেমে যাওয়া শরীরটাকে কোনোরকমে তুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ট্রেন লক্ষ্ণৌ স্টেশনে ঢুকছে।  

                               পরের দিন ট্রেন থেকে নেমে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিজের শহর ছেড়ে বাইরে গেলেই ফেলে আসা শহরটার জন্য মন কেমন করতে থাকে। কিন্তু হাওড়া ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরতে গিয়েই আজকের তারিখটা মনে পড়ে গেল। আরে! আজ তো একবার যাদবপুর যেতে হবে। ডঃ ভট্টাচার্য্যর কাছে।

                              এটা একদমই মাথায় ছিলনা। ব্যাগপত্র নিয়ে সোজাই রওনা দেওয়া উচিত মনে হল। ড্রাইভারকে বললাম, যাদবপুর যাব। বলে নিশ্চিন্তে পেছনের সীটে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। প্রতি মাসে একবার। এরকম চলছে দু-তিন বছর। আর কতদিন চলবে কে জানে? মাঝে মাঝে মনে হয় এই পৃথিবীটাই অলীক। উন্মাদের মত এক মিথ্যের পেছনে ছুটে চলেছে।

                 গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে পয়সা দিয়ে চেম্বারে ঢুকে গেলাম। আজ ভিড়টা একটু কম। ব্যাগপত্রগুলো পাশে রেখে ডাক্তার ভদ্রমহিলার মুখোমুখি বসলাম।

“কেমন আছেন?” হেসে প্রশ্ন করলেন তিনি।

এটা একদমই অকাজের কথা। আলগোছে একটা উত্তর দিলাম। শুনে মনে হলনা ওনার মনঃপূত হয়েছে বলে। আশা করি আজ তাড়াতাড়ি ছাড়া পাব। প্রতি মাসে হাজিরা দিতেও একঘেয়ে লাগে।

“এখনো হরিদ্বারের কথা মনে পড়ে? ”

“কিছু কিছু।” অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম।

“এখনও মনে হয় কল্যাণী নামে কাউকে আপনি সত্যিই চিনতেন?”

এবারে ভদ্রমহিলা বাড়াবাড়ি করছেন। প্রতিমাসে এখানে এভাবে ডেকে এনে একই কথা বারবার জিজ্ঞেস করার কোনো মানে আছে বলে আমার মনে হয়না। চোয়াল শক্ত করে উঠতে গিয়েও বসে পড়লাম। ভদ্রমহিলার দুই চোখের দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ।

“আকাশ বাবু, আপনি কল্যাণী বলে কাউকে কোনওদিন ভালোবাসেননি। যে কল্যাণীকে আপনি ভালোবাসতেন বলে মনে করেন, সেই নামে কেউ এই পৃথিবীতে ছিলনা, থাকবেও না।”

আমি নিশ্চুপ। ভদ্রমহিলা বলে চললেন, “মনে করার চেষ্টা করুন পাঁচ বছর আগে হরিদ্বার থেকে দেরাদুন যাওয়ার পথে ঘটা সেই দুর্ঘটনার কথা। মাথায় চোট পেয়েছিলেন আপনি। মনে করতে পারেন তার আগে আপনার জীবনে কল্যাণীর অস্তিত্ব?”

আমার দৃষ্টি এবার ঝাপসা হয়ে আসছে। ভদ্রমহিলা আরও কিছু বললেন কোনো কথা কানে ঢুকলনা। সম্বিত ফিরে পেলাম যখন উনি বললেন, “আপাতত আপনি পাশের ঘরে গিয়ে বসুন। একটু পর আপনার সাথে কথা বলছি।”

একটা ঘন্টা বাজিয়ে কাকে যেন ডাকলেন। একটি মেয়ে ঘরে ঢুকল কয়েক সেকেন্ড পর। ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শিবানী, এনাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও। আমার আর কয়েকটা কেস বাকি আছে। তারপর ওনার সাথে কথা বলব।”

মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে তার সাথে আসতে ইশারা করল। আমি কলের পুতুলের মতোন তার পেছনে পেছনে কয়েকপা গিয়েও থেমে গেলাম। ‘শিবানী? কিন্তু এই নামে তো...?’


বিদ্যুৎচমকের মতন পেছনে ফিরে তাকালাম। আর সঙ্গে সঙ্গে একগাদা কাগজের সাথে টেবিলে সাজিয়ে রাখা নেমপ্লেটটার দিকে চোখ গেল।

কল্যাণী ভট্টাচার্য্য।



আর তারই সামনে টেবিলে হাত রেখে মাথা নিচু করে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে চলেছে আমার বিগত কয়েক বছরের পুরোনো সাইকায়াট্রিস্ট।  






1 comment: