দুরুদুরু বুকে শেষ পর্যন্ত তিলোত্তমার বাবার সামনে হাজির হলাম। প্ল্যান অবশ্য
আমার ছিলনা। এসব মেয়ের নিজেরই আদ্যপান্ত মনগড়া জিনিষপত্র। বাবার অনুমতি ছাড়া বিয়ের
জন্য হ্যাঁ বলবেনা। আরে বাবা, বিয়ে কি আমি এখনি করছি নাকি, সাততাড়াতাড়ি? একটা
চাকরি-বাকরি জুটুক, কিছু পয়সা জমাই, তবে না?
তবু না, মেয়ের সেই এক খেয়াল। শুনেছিলাম ‘কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম’, এখানে স্বয়ং
‘কর্ত্রীর ইচ্ছেয় কর্ম’ হতে বাধ্য হল।
তিলোত্তমা হষ্টেলে। সেই ফাঁকে আদেশ হল তার বাবার সাথে দেখা করতে হবে। রবিবারের
বিকেল। রোদ-ঝলমলে আকাশ। পাড়ার সত্যনারায়ন মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে একটা বড় মিষ্টির
প্যাকেট কেনা গেল। বিয়ের কথা যদিও বলছিনা, তবু বান্ধবীর বাড়ি বলে কথা। তিলোত্তমার
ভাইয়ের জন্য একটা বোর্নভিলে ক্যাডবেরির দাম করতে গিয়ে শুনলাম আশি টাকা। শালা! বলে
কি? আমার সব চাকুরিজীবি বন্ধুবান্ধবরা তাদের বান্ধবীদের সাথে প্রতি হপ্তাশেষে এরকম
খান দুই করে খাওয়া দাওয়া করে। কিন্তু আমি তো তা নয়। বোর্নভিলের আশা ত্যাগ করতে হল।
সত্যনারায়নের পাঁচ টাকা দামের বারোটা কলাকাঁদের প্যাকেটটা হাতে ঝুলিয়ে রওনা দিলাম।
বাড়ির সামনে পৌঁছে আরেক বিপত্তি। এটা বাড়ি না অট্টালিকা? খানিক কলিংবেল টিপে
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। এঘরের উপযুক্ত আমি নই। ভালোয় ভালোয় আজকের দিনটা কাটলে হয়।
তিলোত্তমাকে বলে দেব, আপাতত তোমার ঘরের কাছাকাছি ঘেঁসছি না। হেহে... একটা চাকরি
মারতে দাও হে, আমিও দেখাচ্ছি।
একটি বেয়ারা গোছের লোক এসে দরজা খুলে বসতে বলল। একটা ছোটো দেখে সোফার ওপর বসে
পড়লাম। এহে, এতক্ষণে নজরে পড়েছে, শার্টের হাতায় একটা কালির দাগ। এটা কাল অব্দিও
ছিলনা। নিশ্চয়ই মেসের মানুদার কাজ। এর ওর জামা পরে বেরিয়ে পড়ে। আজ এখানে
ইন্টারভিউ, তো কাল সেখানে। জামাটাকে দিল শেষ করে। গালের ওপর হাত ঘসে টের পেলাম
দাড়িটাও কাটতে ভুলেছি। শালা আজকের দিনটাই খারাপ।
সিঁড়িতে একটা পায়ের আওয়াজ পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। রাসভারি এক ভদ্রলোকের প্রবেশ। এই
কি তিলোত্তমার বাবা? প্রণাম করে নেব চট করে?
তিলোত্তমার বাবা ।। ‘আরে বোসো বোসো, দাঁড়ালে কেন?’
আমি ।। ‘এঁহেঁ... মানে ইয়ে...’
তিলোত্তমার বাবা ।। ‘চা খাও তো?’
আমি ।। ‘হ্যাঁ, তা...’
তিলোত্তমার বাবা ।। ‘বেশ বেশ, এই বেনী... চা আন। তা হ্যাঁ, তারপর, বল। খবর কি?
তিলু তো সারাক্ষণই তোমার নাম করে।’
আমি ।। (এটা শুনে বেশ ভালোই লাগল। তবে কি বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। হেঁহেঁ করে
কাজ চালালাম।)
তিলোত্তমার বাবা ।। ‘তবে তুমি কি কর সেটা ঠিক জানিনা। শুনেছি লেখালেখি কর?’
আমি ।। ‘আজ্ঞে ওই আর কি, টুকটাক।’
তিলোত্তমার বাবা ।। ‘কি লেখো? নভেল? আমি আবার রাশিয়ান নভেল এর বিশাল ভক্ত।
দস্তয়েভস্কি একদম গুলে খেয়েছি।’
আমি ।। ‘আজ্ঞে আমি নিতান্তই ছোটো গল্প। তবে একটা নভেলের প্লট আছে মাথায়।
আসলে...’
কথা শেষ হলনা। ভদ্রলোকের মোবাইলে ফোন এসেছে। ঘরের একপাশে একটা দরজা খুলে একটা
বারান্দার মতোন জায়গায় গিয়ে কথা বলতে লাগলেন। কোথায় একটা কুকুর ডাকছে। এই বাড়িরই
মধ্যে কোথাও। সেরেছে। আমার আবার কুকুরে ভয়। কামড়ায় যদি? কোনো এক ভদ্রমহিলার
কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম ভেতরে, ‘জ্যাকি, জ্যাকি...’। কুকুরের ডাকটা থেমে গেল।
এঘরের সিলিংটা অনেক
ওপরে। সারা ঘর জুড়ে মূর্তি, পেন্টিংস, হাতের কাজ ছড়ানো। আহা! বসার ঘর তো একেই বলে।
প্রায় দশ বছর আগে শেষ এরকম দেখেছিলাম। মামাবাড়িতে। মামারা সবাই বড়লোক। সাধ আর সাধ্য
দুটোই আছে। তাছাড়া...
এবার একটা গান কানে এল। দোতলা বা তিনতলায় কোথাও রেডিও চলছে মনে হয়। গজল, জগজিৎ
সিং। এ গান আমার চেনা। চোখদুটো আপনা থেকে বন্ধ হয়ে বাঁ হাতটা কপালে ভাঁজ হয়ে গেল।
“ঝুকি ঝুকি সি নজর, বেকরার হ্যায় কি নহি
দবা দবা সা সহি, দিল মে পেয়ার হ্যায় কি নহি
তু আপনে দিল কি জবান ধড়কনোকো
গিনকে বতা
মেরি তরাহ তেরা দিল, বেকরার
হ্যায় কি নহি
ও পল কে জিসমে মহব্বত জবান হোতি
হ্যায়
উস এক পল কা তুঝে ইন্তেজার হ্যায়
কি নহি
তেরি উম্মিদ পে ঠুকরা রহা হু
দুনিয়াকো
তুঝে ভি আপনে পে ইয়ে আয়েতবার
হ্যায় কি নহি...”
ভদ্রলোক
ফিরে এসেছেন। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। কেস
করেছে। চট করে চোখের জলটা মুছে ফেলে বললাম, ‘হেঁহেঁ...একটা ভালো গান চলছিল ভেতরে
কোথাও।’
তিলোত্তমার বাবা ।। ‘ওঃ। আমার বাবা।
সেভেন্টি-ফোর ইয়ারস। গজল, ক্লাসিকালের খুব ভক্ত। আমার আবার এসব একদম আসে না। উকিল
মানুষ, বুঝলে কিনা। মক্কেলদের দেখতে গিয়ে নিজের লাইফটির বারোটা বাজিয়েছি। তবে
চাইনা আমার মেয়ে বা ছেলে সেরকম হোক। বুঝলে না? এইতো দেখো মেয়ের জন্য সম্বন্ধ আসছে
ফোনে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছেলে। কিন্তু আমি সবাইকে বলে দিয়েছি, শখসাধ রাখো তো
বাপু, নাকি শুধুই ওই পেশা? উইথাউট এনি এক্সট্রাকারিকুলার এক্টিভিটিস মানুষকে কিরকম
একটা ঘোড়া বলে মনে হয়, কি বলো?’
চা এসেছে। ঘরটা হঠাৎ গরম লাগছে কেন এতো? একটা জানলা খুলে দিতে বললে ভালো হত
কি? বুকের মাঝখানটায় সুপুরির মতোন কি যেন আটকে আছে মনে হচ্ছে।
তিলোত্তমার বাবা ।। ‘তা তোমার কি মনে হয়, তিলোত্তমার ডাক্তারকে পছন্দ হবে, না
ইঞ্জিনিয়ারকে? কার সাথে মানাবে বলতো?’
আমি ।। ‘আজ্ঞে, আমি বলব?’
তিলোত্তমার বাবা ।। ‘হ্যাঁ, বল। তুমি তো ওর কাছের বন্ধুদের মধ্যে একজন। বলবে
তো বটেই। ওপিনিয়ন সব ব্যাপারে একটা থাকা ভালো, বুঝলে?’
তিলোত্তমার মুখটা মনে পড়ে গেল। হাসি হাসি। কাছের বন্ধু? লেকের ধারের সব
সিমেন্টের বেঞ্চগুলো কথা বলতে পারলে আমার হয়ে সওয়াল করত।
ঘন্টা দুই পরে যখন বেরিয়ে এলাম, যতীন দাস পার্কের কাছে সন্ধের আলোগুলো জ্বলে
উঠেছে। মনটা খারাপ লাগছে। তিলোত্তমা সবই জানত তাহলে। এতদিন বলেনি কেন কে জানে? হঠাৎই
হাতের দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠলাম। আজব। মিষ্টির প্যাকেটটা এখনো হাতেই ঝুলে মরছে যে!
তালেগোলে ওদের বাড়িতে দিয়ে আসতে বেমালুম ভুলেছি। ধুর ধুর।
মেসে ফিরে শুয়ে পড়লাম। মাসিকে বলে দিয়েছি রাতের খাবারটা না দিতে। রাতে মানুদা
ফিরলে এবারের সার্ফ এক্সেলের টাকাটা ওর কাছ থেকে বার করব। অভদ্র একখানা।
পাশের ঘর গুলো থেকে সন্ধের তাসের আড্ডার শব্দে মেস ভরে উঠল। ওপাশের নর্দমাটা
ডিঙ্গিয়ে একটা বেড়াল রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল। আমার টেবিল ক্লকটা টিকটিক করে নিজের
মনে গান গাইছে। ধীরে ধীরে সে শব্দটাও কান-সওয়া হয়ে যাবে। সন্ধে পেরিয়ে রাত নামল।
মেসের ছেলে গুলো দুপুরের বাকি-মাংস দিয়ে রুটি খাবে বলে চলে গেল। আমার কলাকাঁদের
প্যাকেটটা মাসিকে দিয়ে এসেছি। বাকিরা খাক পাতের শেষে।
চাদরটা ভালো করে মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। মাথাটা এবার একটু হাল্কা
লাগছে।
- Jan, '13
No comments:
Post a Comment