ব্যস্ত নার্সিংহোমের লম্বা করিডোরটায় দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা ছেলেটার হাতদুটো ধরে বললেন, "তুমি না থাকলে আজ মেয়েটার কি হতো জানিনা | একে তো ওই রাস্তাটায় মানুষজন কম, ভাগ্যিস তুমি ওই সময় ওখান দিয়ে যাচ্ছিলে | নইলে এত বড় দুর্ঘটনার পর বেশীক্ষণ একা পড়ে থাকলে হয়তো..."
"আজ কেমন আছে ও?" ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো |
"আগের থেকে ভালো | সকালে তো কথাও বলেছে | ডাক্তার বলেছে মাথার আর চোখের তলার ব্লাড ক্লটিংগুলো ঠিক হয়ে গেলে পায়ের প্লাস্টার সমেত চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে | তুমি আজ একবার কথা বলে যেতে চাও?"
ছেলেটা চোখ মেলে তাকালো | কি যেন ভাবলো | তারপর বলল, "নাহ থাক, সুস্থ হয়ে এসেছে যদি... আমি বরং কাল এসে আরেকবার খোঁজ নিয়ে যাব |"
কিন্তু পরের দিন ছেলেটা আর এলনা | তার পরের দিনও না | তিনদিন পর মেয়েটার মা-বাবা ওকে বাড়ি নিয়ে গেল |
নিঃশব্দ অন্ধকার সরোবরের পাশের রাজপথে ছ'দিন আগের এক সন্ধ্যেবেলায় পায়ে একটা সজোরে ধাক্কার সাথে সাথে অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেই ব্ল্যাক আউট হয়ে যাওয়ার পর, আর তার ঠিক ষোলো ঘন্টা পর চোখ মেলে তাকানোর মাঝখানে কি ঘটেছিল - মেয়েটা ওর মা-বাবার কাছ থেকে শুনলো | ওর মা ওকে বারবার ছেলেটার কথা বললো |
"কোনও নাম বলেছিল কি?" মেয়েটা জানতে চাইল |
ওর মা একটা নাম বলল | মেয়েটা খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্কভাবে চোখ ফিরিয়ে নিল |
"তুই চিনিস না? ছেলেটা বলল ও তোর পুরোনো বন্ধু!"
"চিনতাম হয়তো, অনেকদিন আগে | ...ঠিক মনে নেই |" মেয়েটা জানলার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল |
বাইরের আকাশটা ছাই রঙের মেঘে ঢাকা | উল্টোদিকের ফুটপাথে কাঠচাঁপা গাছের মাথাটা ঝোড়ো হাওয়ায় দুলছে | পড়ন্ত বিকেলের কাকগুলো বৃষ্টির আশঙ্কায় বাসার দিকে উড়ে চলেছে | শহরে বর্ষা এল |
শহরের অন্য কোনো প্রান্তে একটা আধখোলা জানলা দিয়ে দমকা ঝোড়ো হাওয়া এসে টেবিলের ওপর রাখা একগাদা সাদা ফুলস্কেপ কাগজকে গোটা ঘরময় উড়িয়ে দিল |
দূরে কোথাও একটা কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল | টিপটিপ বৃষ্টিটা এবার বড় বড় ফোঁটায় ঝরে পড়ে দূরের দৃষ্টিটাকে প্রায় ঝাপসা করে ফেলছে | মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটাকে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে ছেলেটা জানলার কাছে উঠে এল |
তারপর শহরে বর্ষা এলো | প্রকৃতি আরেকবার সেজে উঠল সবুজ রঙে | ধুয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে যত ধূলো-কাদা, মান-অভিমান |
একাকী ছেলেটা সারাদিন বসে আকাশপাতাল ভাবে | মেয়েটার কথা |
তিনমাস পরে শহরে দুর্গাপুজো এলো | ষষ্ঠীর সন্ধ্যেবেলা ভিড় থেকে দূরে রাস্তার পাশে কয়েকটা সিঁড়ির ওপর বসে ছেলেটা রাস্তার কয়েকটা বাচ্চার খেলা দেখছিল | বাচ্চাগুলোকে ও বেলুন কিনে দিল | সামনের দোকান থেকে খাবার আনিয়ে খাওয়ালো |
রাস্তার পাশের দেওয়ালটায় হেলান দিয়ে আর একটা পা ভাঁজ করে ঠেস দিয়ে, দূরের আলো দিয়ে সাজানো বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ছেলেটা ভাবলো, সুখ জিনিসটা আসলে কী? আলো দিয়ে একটা বাড়ি, একটা পাড়া, একটা গোটা শহর সাজিয়ে ফেলা যায়, কিন্তু তাতে ভেতরের দুঃখ যায় কি?
নিজের খেয়ালে ডুবে থাকা ছেলেটা খেয়াল করেনি, দূরে অন্ধকারে দুটো ছায়ামূর্তি ওর দিকে এগিয়ে আসছিল | যখন করলো, তখন দেরী হয়ে গেছে | পালানোর সময় নেই |
মেয়েটার মা আবছা অন্ধকারেও ওকে চিনতে পেরে এগিয়ে এল |
"আরে তুমি, এখানে? কেমন আছ?"
ছেলেটা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে একবার স্মিত হেসে মাথা নামাল | পরমুহুর্তে চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকাতে দেখল তার কঠোর দৃষ্টি ওর ওপর নিবদ্ধ |
"সেবার তো তুমি হঠাতই উধাও হয়ে গেলে | এবার কিন্তু তোমাকে একবার আমাদের বাড়ি আসতেই হবে |" ভদ্রমহিলা বলে চললেন |
ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল |
"না, থাক... আমি এমনিতেই গোটা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকি | আর আমি নিশ্চিত আপনার এবং আপনার মেয়েরও অন্যান্য কাজ থাকবে |"
ভদ্রমহিলা সামান্য হাসলেন | তারপর বললেন, "তোমরা কথা বলো | আমি এগোই |"
ছায়াটা দীর্ঘায়িত হতে হতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল | মেয়েটার অপলক দৃষ্টি এখনও ওর দিকে নিবদ্ধ | ওর দৃষ্টি মাটিতে | চারদিক জুড়ে এখন শুধুই নীরবতা |
মাঝখানে কতদিন হবে | সাত বছর? আট বছর?
"আই রেড হোয়াট ইউ রোট এবাউট মি |" মেয়েটা বলল |
ছেলেটা মুখ তুলে তাকালো | ও জানত না কি বলা উচিত |
মেয়েটা দূরের বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল |
"তা বলে বেলুন কিনে দিতে হলো?"
ছেলেটা মাথা নামাল | কাউকে সুখী দেখার আনন্দই কি সুখ? ও জানত না |
"আই জাস্ট ওয়ান্টেড টু সী দেম হ্যাপি | দ্যাট্স অল |"
"বাট হোয়াট এবাউট ইওর ওন হ্যাপিনেস?"
ছেলেটার চোখ দিয়ে জল নেমে এসেছিল | সেটা মেয়েটার দৃষ্টি এড়ালো না |
"শেষবার, আমি ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগ পাইনি |"
মেয়েটা দু'পা এগিয়ে এসে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে ওর ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা চুম্বন এঁকে দিল | তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসল |
শহরের অচেনা এক কোণে আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী আর মানুষজনের ভীড় থেকে দূরে আরেকটা সুখের জন্ম হল ||
"আজ কেমন আছে ও?" ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো |
"আগের থেকে ভালো | সকালে তো কথাও বলেছে | ডাক্তার বলেছে মাথার আর চোখের তলার ব্লাড ক্লটিংগুলো ঠিক হয়ে গেলে পায়ের প্লাস্টার সমেত চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে | তুমি আজ একবার কথা বলে যেতে চাও?"
ছেলেটা চোখ মেলে তাকালো | কি যেন ভাবলো | তারপর বলল, "নাহ থাক, সুস্থ হয়ে এসেছে যদি... আমি বরং কাল এসে আরেকবার খোঁজ নিয়ে যাব |"
কিন্তু পরের দিন ছেলেটা আর এলনা | তার পরের দিনও না | তিনদিন পর মেয়েটার মা-বাবা ওকে বাড়ি নিয়ে গেল |
নিঃশব্দ অন্ধকার সরোবরের পাশের রাজপথে ছ'দিন আগের এক সন্ধ্যেবেলায় পায়ে একটা সজোরে ধাক্কার সাথে সাথে অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেই ব্ল্যাক আউট হয়ে যাওয়ার পর, আর তার ঠিক ষোলো ঘন্টা পর চোখ মেলে তাকানোর মাঝখানে কি ঘটেছিল - মেয়েটা ওর মা-বাবার কাছ থেকে শুনলো | ওর মা ওকে বারবার ছেলেটার কথা বললো |
"কোনও নাম বলেছিল কি?" মেয়েটা জানতে চাইল |
ওর মা একটা নাম বলল | মেয়েটা খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্কভাবে চোখ ফিরিয়ে নিল |
"তুই চিনিস না? ছেলেটা বলল ও তোর পুরোনো বন্ধু!"
"চিনতাম হয়তো, অনেকদিন আগে | ...ঠিক মনে নেই |" মেয়েটা জানলার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল |
বাইরের আকাশটা ছাই রঙের মেঘে ঢাকা | উল্টোদিকের ফুটপাথে কাঠচাঁপা গাছের মাথাটা ঝোড়ো হাওয়ায় দুলছে | পড়ন্ত বিকেলের কাকগুলো বৃষ্টির আশঙ্কায় বাসার দিকে উড়ে চলেছে | শহরে বর্ষা এল |
শহরের অন্য কোনো প্রান্তে একটা আধখোলা জানলা দিয়ে দমকা ঝোড়ো হাওয়া এসে টেবিলের ওপর রাখা একগাদা সাদা ফুলস্কেপ কাগজকে গোটা ঘরময় উড়িয়ে দিল |
দূরে কোথাও একটা কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল | টিপটিপ বৃষ্টিটা এবার বড় বড় ফোঁটায় ঝরে পড়ে দূরের দৃষ্টিটাকে প্রায় ঝাপসা করে ফেলছে | মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটাকে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে ছেলেটা জানলার কাছে উঠে এল |
তারপর শহরে বর্ষা এলো | প্রকৃতি আরেকবার সেজে উঠল সবুজ রঙে | ধুয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে যত ধূলো-কাদা, মান-অভিমান |
একাকী ছেলেটা সারাদিন বসে আকাশপাতাল ভাবে | মেয়েটার কথা |
তিনমাস পরে শহরে দুর্গাপুজো এলো | ষষ্ঠীর সন্ধ্যেবেলা ভিড় থেকে দূরে রাস্তার পাশে কয়েকটা সিঁড়ির ওপর বসে ছেলেটা রাস্তার কয়েকটা বাচ্চার খেলা দেখছিল | বাচ্চাগুলোকে ও বেলুন কিনে দিল | সামনের দোকান থেকে খাবার আনিয়ে খাওয়ালো |
রাস্তার পাশের দেওয়ালটায় হেলান দিয়ে আর একটা পা ভাঁজ করে ঠেস দিয়ে, দূরের আলো দিয়ে সাজানো বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ছেলেটা ভাবলো, সুখ জিনিসটা আসলে কী? আলো দিয়ে একটা বাড়ি, একটা পাড়া, একটা গোটা শহর সাজিয়ে ফেলা যায়, কিন্তু তাতে ভেতরের দুঃখ যায় কি?
নিজের খেয়ালে ডুবে থাকা ছেলেটা খেয়াল করেনি, দূরে অন্ধকারে দুটো ছায়ামূর্তি ওর দিকে এগিয়ে আসছিল | যখন করলো, তখন দেরী হয়ে গেছে | পালানোর সময় নেই |
মেয়েটার মা আবছা অন্ধকারেও ওকে চিনতে পেরে এগিয়ে এল |
"আরে তুমি, এখানে? কেমন আছ?"
ছেলেটা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে একবার স্মিত হেসে মাথা নামাল | পরমুহুর্তে চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকাতে দেখল তার কঠোর দৃষ্টি ওর ওপর নিবদ্ধ |
"সেবার তো তুমি হঠাতই উধাও হয়ে গেলে | এবার কিন্তু তোমাকে একবার আমাদের বাড়ি আসতেই হবে |" ভদ্রমহিলা বলে চললেন |
ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল |
"না, থাক... আমি এমনিতেই গোটা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকি | আর আমি নিশ্চিত আপনার এবং আপনার মেয়েরও অন্যান্য কাজ থাকবে |"
ভদ্রমহিলা সামান্য হাসলেন | তারপর বললেন, "তোমরা কথা বলো | আমি এগোই |"
ছায়াটা দীর্ঘায়িত হতে হতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল | মেয়েটার অপলক দৃষ্টি এখনও ওর দিকে নিবদ্ধ | ওর দৃষ্টি মাটিতে | চারদিক জুড়ে এখন শুধুই নীরবতা |
মাঝখানে কতদিন হবে | সাত বছর? আট বছর?
"আই রেড হোয়াট ইউ রোট এবাউট মি |" মেয়েটা বলল |
ছেলেটা মুখ তুলে তাকালো | ও জানত না কি বলা উচিত |
মেয়েটা দূরের বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল |
"তা বলে বেলুন কিনে দিতে হলো?"
ছেলেটা মাথা নামাল | কাউকে সুখী দেখার আনন্দই কি সুখ? ও জানত না |
"আই জাস্ট ওয়ান্টেড টু সী দেম হ্যাপি | দ্যাট্স অল |"
"বাট হোয়াট এবাউট ইওর ওন হ্যাপিনেস?"
ছেলেটার চোখ দিয়ে জল নেমে এসেছিল | সেটা মেয়েটার দৃষ্টি এড়ালো না |
"শেষবার, আমি ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগ পাইনি |"
মেয়েটা দু'পা এগিয়ে এসে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে ওর ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা চুম্বন এঁকে দিল | তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসল |
শহরের অচেনা এক কোণে আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী আর মানুষজনের ভীড় থেকে দূরে আরেকটা সুখের জন্ম হল ||
osadharon...sabolil lekhon-shoili (y)
ReplyDeleteDhonyobad. :)
Delete