মেয়েটা রোজ আসে |
সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটার মধ্যে এপাড়ার যত অফিসের বাবুরা আছে, তাদের যাতায়াত কমে আসে | এপ্রিলের প্রখর রোদে সামনের কালচে ছাই রঙের পিচের রাস্তাটা একা আগুনের হলকার মত পুড়তে থাকে | মাঝে মাঝে শুধু দু-একটা দূর নীল আকাশের গা থেকে ছিটকে পড়া চিলের ডাক | উল্টোদিকের তিনতলা বাড়িটার ছাদে সকালের কাচা রঙ-বেরঙের কাপড়জামা ঝুলছে |
মেয়েটা রোজ এপাড়ায় আসে | বেগুনী রঙের সালোয়ার, হালকা রঙের কামিজ | কাঁধে একটা ভারী শান্তিনিকেতনি ব্যাগ |
ছেলেটা গ্রিল দেওয়া জানলাটায় হেলান দিয়ে বসে দূর রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে | কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা ভেদ করে উদাসী দৃষ্টিটা চলমান জীবনের মধ্যে কোনও অচেনা গল্প খুঁজে বেড়ায় |
ছোট্ট, আধা অন্ধকার ঘরটা অগোছালো, কাগজ আর বইয়ে ছড়াছড়ি | কাঠের টেবিলটার ওপর রাখা দোয়াত আর পেনটার দিকে তাকিয়ে থাকলে মাঝে মাঝে একটা স্বপ্নজগতের সৃষ্টি হয় | পাশের বাগান থেকে সন্ধ্যেবেলা ভেসে আসা থোকা বেলফুলের গন্ধের মতই যেন কাগজের ওপরের লেখাগুলো ভেসে ভেসে ওর চারপাশে খেলা করে | কালো গোটা গোটা অক্ষরগুলো হাতে হাত রেখে নাচতে থাকে | ও চাইলেও সেগুলোকে ধরতে পারেনা | লেখাগুলো অধরা, অসমাপ্তই পড়ে থাকে | শুধু অবেলার ছিটকে পড়া চিলের ডাকগুলো স্বপ্নের চটক ভাঙিয়ে দেয় |
হাওয়ায় ঘরের কোণায় শূন্য খাঁচাটা দুলছে | এটা ওর আসার আগে থেকে ছিল | হয়তো আগের ভাড়াটে যাওয়ার আগে ফেলে গেছে | কালো, ফাঁকা, বদ্ধ খাঁচাটার অস্তিত্ব ঘরটাকে আরো একাকী করে দেয় | জানলার একপাশে একটা সরু সুতোয় ঝোলানো কয়েকটা কাঁচের চুড়ি, একটার সাথে আরেকটা বাঁধা | মাঝে মাঝেই দমকা হাওয়ায় টুং- টাং শব্দে বেজে ওঠে |
কাছেই কোথাও একটা গোলমালের আওয়াজ কানে আসে | পাশের ঘরের ভদ্রমহিলার কন্ঠস্বর | ছেলেটা দরজা খুলে এগিয়ে দাঁড়ায় |
"এখানে সেলসম্যানদের কে ঢুকতে দিয়েছে? নিচের বোর্ডে কি লেখা আছে দেখোনি?"
ছেলেটা অবাক বিস্ময়ে চোখ তুলে তাকায় | ওর থেকে হাত পাঁচ-ছয় দূরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু করে |
"আর যেন আমার বাড়ির দরজার সামনে না দেখি |" টানা বারান্দাটার ওপাশের ঘরের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে যায় |
ঘরের সামনে দুটো টবে হলুদ-সাদা ম্যাগনোলিয়া আর সাদা গোলাপের মেলা | বাইরের রোদ বারান্দার একপাশে কেমন ঢেউ-খেলানো একটা জ্যামিতিক চিত্র এঁকে রেখেছে |
মেয়েটা আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ায় |
"একটু খাওয়ার জল..."
ছেলেটা কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে থাকে | তারপর বলে, "আসুন |"
ঘরে বসার জায়গার বড়ই অভাব | রঙ-চটা, আধময়লা একটা তোষক, আর একটা নড়বড়ে কাঠের চেয়ার | ছেলেটা চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে জলের গ্লাসটা কাগজপত্র ডাই করে রাখা টেবিলটার এক কোণায় রাখে |
"আমি আপনাকে আগেও কয়েকবার দেখেছি | আপনি... "
মেয়েটা গ্লাসের জলটা শেষ করে খালি গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখে | তারপর কাঁধের শান্তিনিকেতনি ব্যাগটা থেকে 'এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা' -এর দুটো ভল্যুম বের করে ওর দিকে এগিয়ে দেয় |
"আমাদের কোম্পানী খুব কম দামে বাজারে এনেছে | বাইরে কিনলে দু' হাজার দুশো পড়বে, কিন্তু আমরা মাত্র আঠেরোশোয় দিচ্ছি | একটা নিয়ে পড়ে দেখুন |" মেয়েটা এক নিঃশ্বাসে বলে চলে |
ছেলেটা বইটা হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে | 'এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা' | একজন উঠতি, অনামী লেখকের জীবনে এটার কি মূল্য ও জানেনা |
মেয়েটা একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে | ছেলেটা কিছুক্ষণ পরে চোখ তুলে তাকাল |
"আপনি এটা নিলে আমি এগারো টাকা কমিশন পাব |" নিঃশব্দ, একলা ঘরটায় মেয়েটার দীর্ঘশ্বাস পড়ল |
ছেলেটা বইখানা খানিকক্ষণ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলো | তারপর টেবিলের ওপর বইটা রেখে উঠে গিয়ে কোণের ছোটো একটা দেরাজের ভেতরের একটা ব্যাগ থেকে চারটে পাঁচশো টাকার নোট বের করে এনে মেয়েটার হাতে দিল |
"বাকিটা আপনি রেখে দিন |" ছেলেটা খানিকটা হাসার চেষ্টা করলো |
মেয়েটা খানিকক্ষণ একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে রইল | তারপর মুচকি হেসে বলল, "এক শর্তে | আপনাকে আজকে আমার সাথে লাঞ্চ করতে হবে |" এই বলে সে ওর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা লাঞ্চবক্স বের করলো |
দুজনেই এবার দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল |
দু'মাস পরে একটা পড়ন্ত বিকেলে একই বাড়ির ছাদে ছেলেটা আর মেয়েটা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল | মধ্য কলকাতার সংকীর্ণ গলিগুলো বাড়িটাকে ঘিরে এদিক ওদিক অদৃশ্য হয়েছে | যেদিকে চোখ যায় শুধু পুরোনো আমলের ছোটো-বড় বাড়িঘরগুলো নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে | রাস্তার পাশগুলো টেলিফোন আর ইলেকট্রিকের উঁচু কালো তারে ঢাকা | কালচে হলুদ বাড়িগুলোর দোতলার ঝুলবারান্দা গুলো দুপুরে শুকোতে দেওয়া জামা-কাপড়ে ভর্তি | পশ্চিমে একটা চারতলা বাড়ির ডানদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে | দূরে একটা মসজিদে নামাজ পড়া শুরু হল |
মেয়েটা আস্তে আস্তে সরে এসে ছেলেটার কাঁধে মাথা রাখল |
ছেলেটার ভেতরে একটা ঝড় চলছিল | সাত বছর আগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় ওর মনে শুধুই লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল | আর ও জানত, পৃথিবীর কোনো বাঁধন ওকে সেই স্বপ্নকে পাওয়া থেকে আটকাতে পারবেনা |
ওকে পালাতে হবে | এখান থেকে অনেক দূরে |
গ্রীষ্ম চলে গিয়ে বর্ষা এল | প্রকৃতি দ্রুত বদলে গিয়ে সবুজ রঙে সেজে উঠল চারদিকে | কয়েকটা মানুষের জীবনও কি তাড়াতাড়ি বদলে গেল |
মেয়েটা আজ আকাশী নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে | ছেলেটার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে | খুব কম কথা বলে আজকাল ছেলেটা | শুধু ওর চশমাটার ফাঁক দিয়ে উদাসী দৃষ্টি আর করুণ একটা হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকে |
কিন্তু মেয়েটা ওকে ভালোবাসে | সেই প্রথম দিন থেকে |
বিকেল থেকে আকাশটা মেঘলা | ঠিক আঠেরোটা সিঁড়ির ধাপ গুনে দোতলায় উঠে বাঁদিকের দরজাটায় আওয়াজ করতে গিয়েও থেমে গেল ও |
দরজাটা খোলা |
বারান্দায় দরজার উল্টোদিকে ফুলগাছ গুলো জল না পেয়ে মরে গেছে |
খোলা দরজাটা দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকতে গিয়েও মেয়েটা দরজার সামনেই আটকে গেল |
ঘরের এককোণে শূন্য খাঁচাটা জানলা দিয়ে আসা দমকা হাওয়ায় দুলছে | কাঁচের চুড়িগুলো নিজেদের মনে একা একা টুংটাং খেলা করছে | পুরোনো টেবিলটার ওপরে ডাই করে রাখা বইগুলো কেউ যেন সযত্নে সরিয়ে নিয়েছে | গোটা ঘরময় শুধু একগাদা বাতিল করা কাগজ | কয়েকটা আসন্ন বৃষ্টির হাওয়ায় ওর পায়ের কাছে উড়ে বেড়াচ্ছে | পুরোনো খাটটার ওপর আধময়লা তোষকটা অদৃশ্য | শুধু টেবিলটার ওপর পড়ে আছে দুটো জিনিষ |
একটা এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা | আর তার ওপর একটা কালো, মোটা ফ্রেমের চশমা |
শূন্যে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে গিয়েও না পেরে মেয়েটা দরজার কাছেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল |
শত সহস্র না-বলা কথা, রাগ-অভিমান-ভালবাসা সব সেই রুদ্ধ কন্ঠে, অশ্রুজলে আটকে রয়ে গেল | "না... না... " শব্দে মেয়েটা কাঠের দরজাটা আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো |
দূরে কোথাও কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল | ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা এবার বড় বড় ফোঁটায় জানলা দিয়ে এসে ঘরের একদিকটা ভিজিয়ে ফেলবে | দক্ষিণের বাতাসটা বৃষ্টির কাঁধে চড়ে ঘরের মধ্যে হঠাত একপাক ঘুরে গেল | ঘরের মধ্যে কাগজগুলো এবার এদিক থেকে ওদিক উড়ে চলেছে | হয়তো ওদের মধ্যে আনমনে লিখে ফেলা কিছু চেনা-অচেনা শব্দ নিঃশব্দেই একটা গল্প রচনা করবে |
বুকফাটা একটা কান্নাকে ভেদ করে সুতোয় বাঁধা কাঁচের চুড়িগুলো টুংটাং শব্দে হাওয়ার তালে তালে বাজতে লাগলো | আর তারপর দূরে কোথাও গুরুগম্ভীর বাজ পড়ার শব্দে সেই আওয়াজও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল ||
No comments:
Post a Comment